ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় লন্ডনে সন্ত্রাসী হামলা

রোমহর্ষক, বিভীষিকাময়

প্রকাশিত: ০৩:৩৬, ৫ জুন ২০১৭

রোমহর্ষক, বিভীষিকাময়

লন্ডন ব্রিজ ও বারো মার্কেটে সন্ত্রাসী হামলাকে লোমহর্ষক ও ভয়ানক বলে আখ্যায়িত করেন প্রত্যাক্ষদর্শীরা। স্থানীয় সময় শনিবার রাত দশটার কিছুক্ষণ পর এ হামলার ঘটনা ঘটে। এ সময় রাজধানী লন্ডন শহর কিছুটা ব্যস্ত, জনাকীর্ণ ও কোলাহলপূর্ণ ছিল। অনেকে সন্ধ্যার পর রাতের খাবার ও পানীয় সেবনে বের হয়েছিলেন। কেউ কেউ বারে চ্যাম্পিয়ন লীগের ফাইনাল খেলা দেখছিলেন। ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানে কাজ করেন বেথানি আটকিন। বারো মহাসড়কের একটি ছোট্ট সেতুর নিচের রেস্তরাঁয় তিনি বসেছিলেন। বেথানি বলেন, আমরা সেতুর নিচে রেস্তরাঁর বাইরে ছাতার নিচে বসেছিলাম। তখন একটি ভ্যান সেতু থেকে পড়ে যায়। আমরা দাঁড়িয়ে যাই, সবাই ছোটাছুটি করছিলেন। আমি একজনকে দেখলাম, তার শরীর থেকে রক্ত ঝড়ছে। আমি জানতাম না তিনি কীভাবে আহত হয়েছেন। নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে আমি রেস্তরাঁর ভেতরে দৌড় দিলাম। কিন্তু সেটি ছিল খালি। বাইরে বেরিয়ে দেখি আরেকজন আহত হয়ে পড়ে আছেন। বেথানি বলেন, সেতু থেকে ২০ মিটার দূরে মাটিতে পড়ে ছিলেন রক্তাক্ত এক নারী। বেথানি লন্ডন ব্রিজ হাসপাতালের দিকে দৌড় দিলেন, সেখানে গিয়ে দেখেন সড়কে ব্যাপক হট্টগোল। এক লোক ভয়াবহ চিৎকার করছেন, বাকিরা আতঙ্কে আর্তনাদ করে তার কাছ থেকে পালাচ্ছেন। এটা ছিল আরেক বিভীষিকা। হামলা শুরুর আট মিনিটের মাথায় পুলিশ সবাইকে নিরাপদে সরে যেতে বলে। ব্রিটেনের স্পেকটেটরের সাংবাদিক উইল হেভেন তখন সেতুটি পার হচ্ছিলেন। তিনি স্কাই নিউজকে বলেন, ‘রাত ১০.১০ মিনিট হবে। আমি তখন একটা উবার ক্যাবে করে লন্ডন ব্রিজ পার হচ্ছিলাম। হঠাৎ সেতুর বাঁ পাশে কেউ একজন ফুটপাথে পড়ে গেলে তাঁকে ঘিরে ছোট্ট ভিড় লেগে যায়। আমি ভাবছিলাম কেউ একজন সেতু থেকে পড়ে গেছেন। আমি সেতু থেকে কিছুটা সামনে চলে গেছি। সেখানেও দেখলাম একজন পড়ে আছেন। আমার মনে হলো মারাত্মক কিছু একটা ঘটেছে। অন্য গাড়িগুলোও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। উবার চালক বললেন, খারাপ কিছু ঘটেছে। এর মধ্যে আমরা সাইরেন শুনতে পেলাম। আমাদের দিকেই আসছিল। পাশের একটা কালো ক্যাবের চালক জানালেন, এখানে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে। রাস্তা তখন লোকে লোকারণ্য। দ্বিতীয় আরেকটি ক্যাবের চালক বললেন, এখানে কয়েক দফা ছুরিকাঘাতের ঘটনা ঘটেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ২৫ বছরের এক যুবক গার্ডিয়ানকে বলেন, তিনি সেতুর ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে গেলে একজন পুরুষ ও এক গর্ভবতী নারীকে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। তিনি বলেন, প্রথমে আমি ভেবেছিলাম সড়ক দুর্ঘটনা। কিন্তু কাছে যেতেই দেখি রক্তাক্ত আরও কয়েকজন পড়ে আছেন। একজন তখন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। ওই গর্ভবতী নারী বেঁচে আছেন কিনা; তা জানি না। আমি গাড়ি থেকে বের হয়ে আসি, প্রচুর লোক তখন ভয়ে আর্তচিৎকার করছেন। তখন একটি এ্যাম্বুলেন্স আসতে দেখলাম। মার্ক নামের এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, তিনি একটি ভ্যানকে লোকজনের ভিড়ের ওপর উঠে যেতে দেখেছেন। মার্ক বলেন, আমার দৃষ্টিতে যতদূর দেখা গেছে, তাতে পাঁচ থেকে ছয়জনকে পড়ে থাকতে দেখেছি। তাদের কেউ ইতোমধ্যে মারা গেছেন, কেউ কেউ মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়ছিলেন। পুলিশের নৌকা তখন নদীতে খোঁজাখুঁজি করছিল। সেতু থেকে ফেলে দেয়া হয়েছে, নদীতে তাদের খোঁজ করছিল পুলিশ। ঘটনার পরপরই লন্ডনের পানশালা ও বারগুলোতে গম্ভীরতা নেমে আসে। এ্যালেক্স শুলমার নামের একজন বলেন, তিনি মুডলার্ক পানশালায় বসে ছিলেন। তখন ঘাড়ে রক্তাক্ত অবস্থায় এক নারীকে তিনি বারে ঢুকতে দেখেন। তার গলায় ছুরির আঘাত রয়েছে। জেফ হুইটসে নামের এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, বছর বিশেক একটি মেয়েকে দেখলাম পানশালার দিকে টলোমলো করে হাঁটছে। বন্ধুরা তাকে সাহায্য করছে। মেয়েটি মারাত্মক আহত। তিনি বলেন, তার গায়ে ছুরিকাঘাতের গভীর ক্ষত ছিল। সারা শরীর রক্তাক্ত। ক্ষত থেকে সবেগে রক্ত ঝরছে। এটা খুবই ভয়ঙ্কর, সত্যিই ভয়ঙ্কর ঘটনা ছিল। সাতচল্লিশ বছরের গেরার্রড ভোলস জাহাজের পানশালায় বসে চ্যাম্পিয়নস লীগ খেলা দেখছিলেন। তিনি ছিলেন লন্ডন ব্রিজের দক্ষিণ দিকের শুরুতে। তিন ব্যক্তি একটি মেয়েকে ১০ কি ১৫ বার ছুরিকাঘাত করছে বলে দেখেছেন তিনি। তিনি বলেন, মেয়েটি সাহায্য চেয়ে আবেদন করলেও আমার কিছুই করার ছিল না। জানিনা মেয়েটি বেঁচে আছে কিনা। আমি প্রায় দেড়ঘণ্টা ওই এলাকায় হেঁটেছি। আধঘণ্টা আমার চোখ থেকে পানি ঝরেছে। আমি জানি না, কি করব। ভোলস বলেন, হামলাকারীরা আমাকে ছুরিকাঘাত করতে আসলে আমি তাদের দিকে চেয়ার, গ্লাস ও বোতল ছুরে মারি। সন্ত্রাসীরা সবাইকে ছুরি মারছিল। বারো মার্কেট থেকে কয়েকশ’ মিটার দূরে তখন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কয়েকজন লোক ভ্যান থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে সবাইকে এলোপাতির ছুরিকাঘাত করছিল। এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, তাঁরা প্রথমে সবাইকে লাথি ও ঘুষি মারতে শুরু করে। তারপর ছুরি বের করে। তারা ছিল উন্মাদের মতো। একটি মেয়ে তাদের দিকে তাকালে তার ওপর ছুরি মারতে শুরু করে তারা। পুরো লন্ডনব্রিজ জুড়ে ছিল ছোপ ছোপ রক্ত। -গার্ডিয়ান
×