ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

৩০৫ রান করেও হেরে গেল বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ২ জুন ২০১৭

৩০৫ রান করেও হেরে গেল বাংলাদেশ

বাংলাদেশের ইনিংস তখন শেষ হয়েছে মাত্র। স্টেডিয়ামে বসা দর্শকরা স্টেডিয়ামের বাইরে এসেই নাচতে গাইতে শুরু করে দিলেন। সঙ্গে ঢোল-বাদক বাজাতে লাগলেন। উৎসবের আমেজ তৈরি হয়ে গেল। এমনই অবস্থা হলো, যেন জিতে গেছে ইংল্যান্ড! হেরে গেছে বাংলাদেশ! সত্যিই তাই হলো। শেষপর্যন্ত বাংলাদেশ ৮ উইকেটে হেরে গেল। অসাধারণ ব্যাটিং করলেন বাংলাদেশ ওপেনার তামিম ইকবাল। তার ব্যাটিংঝড়ের পরও হলো বাংলাদেশের। জো রুটের ব্যাটিং তা-বে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির শুরুটা শুভ হল না বাংলাদেশের। স্বাগতিক ইংল্যান্ড ঠিকই শুভ সূচনা করে নিল। এ হারে বাংলাদেশও র‌্যাংকিংয়ের ছয় থেকে আবার সাতে নেমে গেল। শুরুটা দুর্দান্ত হলো। কিন্তু শেষটায় তা ধরে রাখা গেল না। তামিম ইকবালের ব্যাটিংঝড়ের সঙ্গে মুশফিকুর রহীমের অসাধারণ ব্যাটিংয়ে বড় সংগ্রহই গড়া গেল। কিন্তু বোলাররা জয় এনে দিতে পারলেন না। তাই তামিমের ব্যাটিংঝড়েও কোন কাজই হলো না। ওভালে তামিম বীরত্বগাথা লেখা হতে পারত। কিন্তু সেঞ্চুরিয়ান রুট তা হতে দিলেন না। বাংলাদেশ অধিনায়ক মাশরাফি আগেরদিন যা বলেছিলেন, তার সারমর্ম দাঁড়ায়, এখানে ৩০০-৩৫০ রান হচ্ছে। ব্যাটসম্যানদেরই যা করার করতে হবে। বোলারদের এখানে অতি ভাল কিছু করতে হবে। ব্যাটসম্যানরা নিজেদের কাজটুকু করে দিলেন। ওপেনার তামিমের ১২৮ রানের ইনিংসের সঙ্গে মুশফিকের ৭৯ রানের ইনিংস এবং দুইজনের তৃতীয় উইকেটে ১৬৬ রানের রেকর্ড জুটি দলকে অনেক দূর নিয়ে যায়। শেষপর্যন্ত ৬ উইকেট হারিয়ে ৫০ ওভারে ৩০৫ রানও করে বাংলাদেশ। যা ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথমবারের মতো তিনশ’ রানের স্কোর। এই রান নিয়েও জিততে পারল না বাংলাদেশ! মাশরাফি যে বলেছিলেন, অতি ভাল কিছু করতে হবে বোলারদের। সেই ভালটাই বোলাররা করতে পারল না। আর তাই ২ উইকেট হারিয়ে ৪৭.২ ওভারে ৩০৮ রান করল ইংল্যান্ড। হারও হলো বাংলাদেশের। শ্রীলঙ্কা (৯৩ রেটিং) থেকে আবার ১ রেটিং পয়েন্ট কমে গিয়ে র‌্যাংকিংয়ের সাতে নামল বাংলাদেশ। এর আগে বাংলাদেশ ১০টি ম্যাচে তিনশ’ রানের বেশি করেছিল। পাকিস্তানের বিপক্ষে ২০১৪ সালের এশিয়া কাপের ম্যাচটি ছাড়া সব ম্যাচেই জিতেছিল বাংলাদেশ। তার মানে তিনশ’ রান করলে তাতে জেতার ভারই বেশি। এবারও তিনশ’ রানের চেয়ে ৫ রান বেশি করল। কিন্তু জিততে পারল না বাংলাদেশ। ওভালে আড়াইশ রান মুড়িমুড়কির মতো হয়। তিনশ রানও একই ধারায় হয়। সাড়ে তিনশ’ রান অবশ্য হয়েছে দুইবার। তবে ইংল্যান্ডের স্টেডিয়ামগুলোতে, বিশেষ করে তিনশ’ রানের বেশি করলে লড়াই করা যায়। কিন্তু সাড়ে তিনশ’ করলে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা যায়। বাংলাদেশ সাড়ে তিনশ’ রান করার ইঙ্গিত দিয়েছিল। শেষপর্যন্ত করতে পারল না। আর তাতে হারের খপ্পরে পড়ল বাংলাদেশ। ২০১১ সালের ও ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে জিতে বাংলাদেশ। বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে সম্প্রতি সময়ে বাংলাদেশই বাজিমাত করেছে। কিন্তু এবার আর হলো না। না হওয়ার কারণ? খেলাটি হচ্ছে ইংল্যান্ডের মাটিতে। ইংল্যান্ড দলটিও অনেক শক্তিশালী। ব্যাটসম্যানে ভরা দল। তাদের জানাও আছে প্রায় ২৪ হাজার দর্শক ধারণ ক্ষমতার ওভালে কিভাবে খেলতে হয়। আর তাইতো বাজিমাত করল ইংল্যান্ডই। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির উদ্বোধনী ম্যাচে বাজিমাত করল। যেখানে বাংলাদেশ তিনশ’ রানের বেশি করায় মনে হয়েছিল একটা ধাক্কা খেতে পারে ইংল্যান্ড। উল্টো সহজভাবেই জিতে গেল। কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই জেসন রয়কে আউট করে দেন মাশরাফি। দুর্দান্ত ক্যাচ ধরেন মুস্তাফিজুর রহমান। স্টেডিয়ামে সে কী উত্তেজনা। দেশ থেকে ওভালে উপস্থিত থাকা দর্শক এবং প্রবাসী ক্রিকেটপ্রেমীরা মিলে ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ রব এমনভাবে তোলেন, যেন জিতে গেছে বাংলাদেশ! কিন্তু এরপরই সময় যত গড়ায়, অন্ধকার যেন নেমে আসতে থাকে। আরেকটি উইকেটই যেন ফেলা যাচ্ছিল না। এ্যালেক্স হেলস ও জো রুট মিলে এগিয়ে যাচ্ছেন তো যাচ্ছেন। কোন কিছু করেই উইকেট ফেলা যাচ্ছিল না। দুইজন মিলে যখন ১৫৯ রানের জুটি গড়ে ফেলেন, তখন ব্রেক থ্রু এনে দেন সাব্বির। ৯৫ রানে থাকা হেলসকে আউট করে দেন। ব্রেক থ্রু এনে দিলেও বোলাররা যে উইকেট থেকে কোন সুবিধা পাচ্ছিলেন না, তা বোঝাই যাচ্ছিল। তৃতীয় উইকেটেও তাই আরাম আয়েশেই এগিয়ে যেতে থাকেন রুট ও ইয়ন মরগান। ২০৩ রানের সময় অবশ্য মাশরাফির বলে মরগানের ক্যাচ ধরেন তামিম। কিন্তু বল ঘাসে লাগে। তাই ক্যাচটি হয়নি। তামিম এত কষ্ট করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ক্যাচটি ধরেন। কিন্তু টিভি রিপ্লেতে দেখা গেল বলটি ঘাসে লেগেছে। তাই নট আউট দেয়া হয়। তাতে তামিম অখুশি হন। এরপর আর কোন সুযোগই মিলেনি। জো রুট সেঞ্চুরি করলেন। ক্যারিয়ারের চতুর্থ সেঞ্চুরি করলেন। দুইজন মিলে একশ রানের জুটিও গড়লেন। মরগান হাফসেঞ্চুরি করলেন। যেন ঠিক তামিম ও মুশফিকের জুটির প্রতিশোধ নিলেন। যখন ২৯০ রানে চলে যায় ইংল্যান্ড, তখন বাংলাদেশ ক্রিকেটারদের শরীরী ভাষাও আর না খেলার মতো হয়ে যায়। দেখতে দেখতে ৪৭ ওভারেই ৩০০ রান করে ফেলে ইংল্যান্ড। শেষপর্যন্ত রুট অপরাজিত ১৩৩ ও মরগান অপরাজিত ৭৫ রান করে দলকে জয় এনে দিয়ে মাঠ ছাড়েন। বাংলাদেশের একজন বোলারও নিজেকে মেলে ধরতে পারলেন না। অথচ বাংলাদেশের শুরুটা দুর্দান্ত হয়। তামিমের সঙ্গে সৌম্য সরকারের ৫৬ রানের জুটি হয়। এরপর তামিম-ইমরুল কায়েসও এগিয়ে যাচ্ছিলেন। ৯৫ রানে ইমরুল আউট হওয়ায় মনে হয়েছে সমস্যা হবে। কিন্তু তৃতীয় উইকেট জুটিতে তামিম ও মুুশফিক মিলে বড় জুটি গড়ে দলকে এগিয়ে দেন। দুইজন মিলে ১৬৬ রানের জুটি গড়েন। যা ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের যে কোন জুটিতে সর্বোচ্চ রান। তামিমকে দুর্দান্ত সঙ্গ দিয়ে যান মুশফিক। তামিম এর মধ্যে সেঞ্চুরিও করে ফেলেন। ১২৪ বলে সেঞ্চুরি করেন তামিম। ইংল্যান্ডের মাটিতে ওয়ানডেতে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের কোন ব্যাটসম্যান সেঞ্চুরি করল। সেই সেঞ্চুরিটি আবার বিশেষ গৌরব এনে দিল তামিমকে। ওভালে ওপেনার হিসেবে এক ম্যাচে সবচেয়ে বেশি রান করলেন তামিম। যখন তামিম-মুশফিক মিলে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন মনে হয়েছিল ৩৫০ রান করে ফেলবে বাংলাদেশ। তাহলে জিতেও যাবে। কিন্তু যেই দলের ২৬১ রান হল, ক্যারিয়ারের নবম ও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় সেঞ্চুরি করা তামিম আউট হয়ে গেলেন। প্লানকেটের শট বলে পুল করতে গিয়ে ক্যাচ আউট হলেন। ১৪২ বলে ১২ চার ও তিন ছক্কায় ১২৮ রানের ইনিংস খেলে সাজঘরে ফেরেন তামিম। তখন সবাই যেন তামিম বন্দনায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। স্টেডিয়ামে আগত দেশী, প্রবাসী দর্শকের সঙ্গে ইংলিশ দর্শকরাও দাড়িয়ে হাততালি দিতে থাকে। অসাধারণ ইনিংসের জন্য তামিমকে সাধুবাদ দিতে থাকে। সবার মুখে মুখে শুধু তামিম থাকে। কিন্তু তামিম আউট হতেই বাংলাদেশের সেরা ব্যাটসম্যান মুশফিকও যে সাজঘরে ফিরবেন, বাংলাদেশের রানের গতিও কমে যাবে; তা কেউ ভাবতে পারেনি। কোন রান যোগ হয়নি। ৭২ বলে ৮ চারে ৭৯ রান করা মুশফিকও আউট হয়ে যান। তখন থেকেই যেন সাড়ে তিনশ’ হওয়ার আশা শেষ হয়ে যায়। তার আগেই অবশ্য সাড়ে তিনশ’ হবে না বোঝা যাচ্ছিল। তবে তামিম ও মুশফিক যখন আউট হন, তখন ছিল ৪৫ ওভার। হাতে তখনও ৫ ওভার ছিল। প্রতি ওভারে ১০ করে নেয়া গেলেও ৩১০ হওয়ার কথা। শেষমুহূর্তে যেহেতু রান বেশি নেয়ার চেষ্টা করে সব দলই। উইকেট থাকলে তো সুযোগটি ভালভাবেই কাজে লাগায়। বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানরা তা করতে পারল না। শেষ পাঁচ ওভারে রান আসল ৪৩। সাকিবের (১০) ব্যাটিং ব্যর্থতা যেন চোখে পড়ছে। আবারও ব্যর্থ হলেন। সাব্বির রহমান রুম্মনকে (২৪) তিন নম্বর থেকে ছয় নম্বরে খেলিয়ে কাজ হলো না। তবে ৬ উইকেট যখন পড়ল, তখন বাংলাদেশের স্কোরবোর্ডে ৩০০ রান যোগ হয়ে গেল। প্রথমবারের মতো ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিনশ’ রান করল বাংলাদেশ। ৫০তম ওভারের প্রথম বলে আউট হলেন সাব্বির। পরের ৫ বলে মাহমুদুল্লাহ (৬*) ও মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত (২*) মিলে ৫ রান যোগ করলেন। তাতে বাংলাদেশ ৩০৫ রান করল। এই রান কোনভাবেই ইংল্যান্ডকে ঠেকিয়ে রাখতে পারল না। সহজ জয়ই তুলে নিল ইংল্যান্ড। তামিমের ঝড়ো ইনিংসের পরও হারল বাংলাদেশ।
×