ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বরিশালে মাদকের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ঘোষণা

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ২০ মে ২০১৭

বরিশালে মাদকের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ঘোষণা

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা মাসোহারা গ্রহণের অভিযোগে এক অফিসার ইনচার্জকে (ওসি) স্টান্ডরিলিজ করা হয়। সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে তার স্থলে মাদক নির্মূলে বিশেষ ক্ষমতা দিয়ে পাঠানো হয় ফিরোজ কবির নামের আরেক ওসিকে। মাত্র একমাসের ব্যবধানে মাদকবিরোধী অভিযানে দক্ষিণাঞ্চলের প্রভাবশালী এক ইয়াবা ডিলারসহ প্রায় দেড় শতাধিক মাদক বিক্রেতা ও সেবীদের গ্রেফতার করেছেন ওসি ফিরোজ কবির। আর এ ঘটনায় ৮৫টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য। ঘটনাটি বরিশালের মাদকের স্বর্গরাজ্য হিসেবে খ্যাত গৌরনদী উপজেলার। সূত্রমতে, গত ২ এপ্রিল শতভাগ মাদকমুক্ত করতে গৌরনদী মডেল থানায় ওসি মোঃ ফিরোজ কবির যোগদান করেই স্থানীয় সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করে ঘোষণা করেন, ‘হয় গৌরনদীতে মাদক ব্যবসায়ীরা থাকবে, না হয় ওসি ফিরোজ কবির থাকবে।’ মাদক নির্মূলে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিপ্ত শপথ নিয়ে কাজ শুরু করে ওসি ফিরোজ কবির দিনরাত অবিরাম অভিযান চালিয়ে গত একমাসে শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের পাকড়াও করতে সক্ষম হয়েছেন। থানা সূত্রে জানা গেছে, গত একমাসে মাদক বিরোধী বিশেষ অভিযানে থানা পুলিশ ইয়াবা, গাঁজা ও ফেনসিডিলসহ প্রায় দেড় শতাধিক মাদক ব্যবসায়ী ও সেবীকে গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। সূত্রে আরও জানা গেছে, ইতোমধ্যে ওসি ফিরোজ কবির অভিযান চালিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় ও প্রভাবশালী ইয়াবা ডিলার গৌরনদীর কটকস্থল গ্রামের মানিক মাঝিকে গ্রেফতার করেন। তার (মানিক) দেয়া স্বীকারোক্তি মতে বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ বিভিন্নস্থানে অভিযান চালিয়ে তিনজন আঞ্চলিক মাদক ব্যবসায়ীকেও গ্রেফতার করা হয়। স্থানীয়রা জানান, তৎকালীন থানার ওসির সঙ্গে গভীর সখ্য থাকায় মানিক মাঝি দীর্ঘদিন থেকে দাপটের সঙ্গে মাদকের রমরমা ব্যবসা করে আসছিল। সর্বশেষ গৌরনদীর পার্শ্ববর্তী কালকিনি উপজেলার ইয়াবা ডিলার গিয়াস নলিকে গ্রেফতার করেন ওসি ফিরোজ কবির। এছাড়াও উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে টরকী এলাকা থেকে বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ বিক্রেতা আল-মাদানি সিকদার, সুন্দরদী এলাকা থেকে সোহাগ ও আরিফ হাওলাদার, নলচিড়ার বোরাদী গরঙ্গল এলাকা থেকে সুমন সরদার, উপজেলার একমাত্র নারী মাদক বিক্রেতা কসবার নুরজাহান বেগম, সেবী গৌরনদী উপজেলা এলজিইডির উপ-সহকারী প্রকৌশলী মঈনুল আজম শামীমসহ বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্যসহ প্রায় দেড় শতাধিক মাদক ব্যবসায়ী ও সেবীকে গ্রেফতার করা হয়। ফলে এক সময়ের মাদকের স্বর্গরাজ্য বলে খ্যাত গৌরনদী থেকে গত একমাসে শতকরা ৮০ ভাগ মাদক বিক্রি ও সেবন বন্ধ হয়ে গেছে। এর আগে মানিক মাঝির ছোটভাই হিরা মাঝি ও তার সহযোগী ইউপি সদস্য মামুনুর রশিদ মনু মোল্লা, শহিদুল ইসলামকে বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ গ্রেফতার করে জেলা ডিবি পুলিশ। ওইসময় গ্রেফতারকৃতদের দেয়া স্বীকারোক্তিতে তৎকালীন গৌরনদী মডেল থানার ওসির বিরুদ্ধে ইয়াবা ডিলার মানিক মাঝির কাছ থেকে প্রতিমাসে এক লাখ টাকা করে মাসোহারা গ্রহণের অভিযোগ ওঠে। ফলে তাৎক্ষণিক সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্মকর্তারা ওই সময়ের ওসিকে স্টান্ডরিলিজ করেন। গৌরনদীকে মাদকমুক্ত করতে নবাগত ওসি ফিরোজ কবিরের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করে গৌরনদী থেকে প্রকাশিত একমাত্র সংবাদ সপ্তাহ পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক কাজী আল-আমিন বলেন, মাদক বিক্রেতা জঙ্গীর চেয়েও ভয়ঙ্কর। আর সেই ভয়ঙ্কর ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কিভাবে কঠোর অবস্থান নিতে হয় তা গত একমাসে গৌরনদীবাসীকে দেখিয়ে দিয়েছেন ওসি ফিরোজ কবির। তাই মাদকের বিরুদ্ধে পুলিশের পাশাপাশি সর্বস্তরের জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করলে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে এ উপজেলাকে শতভাগ মাদকমুক্ত ঘোষণা করা সম্ভব হবে। এজন্য তিনি সবাইকে এগিয়ে আসারও আহ্বান করেন। এ বিষয়ে গৌরনদী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র মোঃ হারিছুর রহমান বলেন, মাদক বিক্রেতা কিংবা সেবনকারী কোন দলের নয়। তাদের একটাই পরিচয় সে মাদক ব্যবসায়ী বা সেবনকারী। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার জন্য পুলিশকে সব ধরনের সহায়তা প্রদান করতে স্থানীয় সংসদ সদস্য আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। এমনকি গ্রেফতারকৃতদের ছাড়াতে দলের কেউ কোন ধরনের ততবির করতে গেলে তাদেরও গ্রেফতারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। গৌরনদী মডেল থানার চৌকস অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোঃ ফিরোজ কবির বলেন, উর্ধতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে গৌরনদীকে মাদক মুক্ত করার বিশেষ দায়িত্ব নিয়ে যোগদান করেছি। মাদক ব্যবসায়ী কোন দলের কত ক্ষমতাধর ব্যক্তি তা বিবেচ্য বিষয় নয়, কোন মাদক ব্যবসায়ী ও সেবনকারীকে ছাড় দেয়া হবে না। গৌরনদীকে শতভাগ মাদকমুক্ত না করা পর্যন্ত থানা পুলিশের এ অভিযান অব্যাহত থাকবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। ওসির আলোচিত ফেসবুক উক্তি নিয়ে তোলপাড় ॥ নিজস্ব ফেসবুক পেজে ‘আমার কিছু অব্যক্ত কথা-ভেবেছিলাম কিছু লিখব না বা অব্যক্ত কথা প্রকাশও করব না’ শিরোনামে মাদক নিয়ে একটি লেখা গত ১৩ মে পোস্ট করার পর সর্বত্র ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়েছে। মুহূর্তের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক পাঠকদের কাছে লেখাটি ভাইরাল হয়ে যায়। মাত্র দুইদিনে (১৫ মে) সকাল পর্যন্ত হাজারো লাইক, শেয়ার ও কমেন্টে ধন্য করা হয়েছে গৌরনদী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোঃ ফিরোজ কবিরকে। পাঠকদের জন্য পুরো লেখাটি হুবহুব তুলে ধরা হলো। ‘যখন দেখি প্রতিনিয়ত মাদকাসক্ত সন্তানদের পিতা-মাতারা আমার কাছে এসে তাদের মাদকসেবী সন্তান সম্পর্কে তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেন, তখন তাদের কষ্টগুলো আমার হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়। একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তির পিতা-মাতা ও পরিবারই বোঝেন এর কি যন্ত্রণা। আমি ক্রমাগত এই ধরনের মানুষের মুখোমুখি। এমনও দেখা গেছে একজন দিনমজুর সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রম করার পরে তার পরিবারের সদস্যদের মুখে আহার যোগানের জন্য বাজার থেকে চাল কিনে নিয়ে বাড়িতে ফেরেন, তখন তারই মাদকাসক্ত সন্তান সেই চালটুকু ছিনিয়ে নিয়ে মাদক ক্রয়ের যোগান দিয়েছে। বিষয়টি আসলে খালি চোখে অনুভব করার মতো নয়। এ জন্য দায়ী কে? আমরা না হয় নাই ব্যক্ত করলাম। কিন্তু এর থেকে ফিরে আসার পথ তো আছে। সেই পথটার দূরত্ব দূর গ্রহের কোন নক্ষত্রের মতো নয়। আপনি আমি তথা সমাজের সকলে যদি এক পা করে এগিয়ে আসি তাহলে মাদক নামক ভয়াল গ্রাসের হাত থেকে এই সমাজের প্রতিটি মানুষকে রক্ষা করা সম্ভব। আমি যখন এই জনপদের মাটিতে জীবনে প্রথমবারের মতো পা রেখেছিলাম তখন আমার ভেতরে একটা ভাললাগা বোধ কাজ করেছিল। যখন জানতে পারলাম এই জনপদটি মাদক নামক বিষ বৃক্ষে আবক্ষে নিমজ্জিত, তখন নিজের বিবেক থেকেই একটি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আমি এই জনপদকে মাদকমুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ্। এরই প্রেক্ষিতে আমার এই মাদক বিরোধী অভিযান/যুদ্ধ। আমি এই জনপদের প্রতিটি মানুষকে কথা দিয়েছিলাম আপনাদের সঙ্গে আছি, আমি আমার কথা রাখব ইনশাল্লাহ। আমার এই মাদক বিরোধী কার্যক্রম যখন পরিপূর্ণভাবে চলমান তখন বিভিন্ন বাধা আমার সামনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। আমি সেই প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। মাদকের বিরুদ্ধে মূল অভিযান আমার এখনো শুরু হয় নাই। আগামীতে হবে।-ইনশাল্লাহ্ সম্প্রতি একটি ঘটনা আমার হৃদয়ে অনেক রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে যেখানে গোটা গৌরনদীবাসী তথা আপমর জনতা মাদক নামক ভয়াল গ্রাস হতে মুক্তি চায়। সন্তানদের সুন্দর ভবিষ্যত কামনা করেন। সে সমস্ত অভিভাবকগণ, কলম সৈনিক, সুশীল সমাজ, গণ্যমান্য ব্যক্তি ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দগণ আমাকে স্ব উৎসহে উৎসাহ জুগিয়েছেন ও সাধুবাদ জানিয়েছেন সর্বোপরি পাশে থেকেছেন। এমতাবস্থায় দেখা যায় একটি মাদক ব্যবসায়ী পরিবার যে পরিবারের দুইজন সদস্য এবং উক্ত দুইজন সদস্যের বিরুদ্ধে গৌরনদী মডেল থানায় এক ডজন তথা ১২টি নিয়মিত মামলা যাহা মাদক, ডাকাতিসহ পুলিশের ওপর হামলা মামলা রয়েছে এবং সেই সমস্ত মামলার অভিযোগপত্র বর্তমানে বিজ্ঞ আদালতে বিচারাধীন। উক্ত মামলার পলাতক আসামিদ্বয়ের বিরুদ্ধে ১৬টি গ্রেফতারি পরোয়ানা গৌরনদী মডেল থানায় মূলতবী আছে। পাঠক আপনাদের কাছে প্রশ্ন রেখে গেলাম কোন ভাল পরিবারের সন্তানদের বিরুদ্ধে কি কখনও এগুলো মামলা বা গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকতে পারে? যখন সেই পরিবারের একজন সদস্যকে বিজ্ঞ আদালতের মাদক মামলায় দুটি গ্রেফতারি পরোয়ানাভুক্ত পলাতক আসামি হওয়ায় পুলিশ গ্রেফতার করল তখন উক্ত আসামি মনির সরদার পালানোর চেষ্টা করেছিল। পুলিশকে উদ্দেশে করে অশ্লীল ভাষায় কথাবার্তা বলেছিল। সে গ্রেফতার এড়ানোর জন্য ধস্তাধস্তি করেছিল। তখন পালানোর চেষ্টাকালে মাটিতে পরে গিয়ে ডান হাতের কাঁধের জয়েন্টে কিছুটা আঘাত পেয়েছিল। এ সময় পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে মৃদু লাঠিচার্জ করে। উক্ত কাজে পুলিশের কোন অসৎ উদ্দেশ ছিল না এবং আসামি মনির সরদারের হাতও কিন্তু ভেঙ্গে যায় নাই। আসামির হাতে কোন প্লাস্টার নাই। শুধুমাত্র একটি এলবো ব্যাগ ঝুলানো আছে যা আপনারা ছবিতে দেখেছেন। আসামির হাতের এক্সরে কপি বিজ্ঞ আদালতে জমা দেয়া আছে। এইরূপ একটি মাদক ব্যবসায়ী তথা জঘণ্য সব অপরাধে অভিযুক্ত পরিবারের জন্য এত মায়াকান্না হয়, মিথ্যা কাহিনী সাজানো হয় তাহলে সাধারণ অসহায় জনগণ এর পাশে দাঁড়াবে কে? পাঠক আপনাদের মাঝেই এই প্রশ্ন রেখে গেলাম। পেপার পত্রিকায় দেখলাম পুলিশ নাকি টাকার জন্য প্রবাসীকে পিটিয়েছে। পুলিশ যদি টাকার জন্যই কাজ করে থাকে তাহলে হিরা মাঝি, মানিক মাঝি, গিয়াস নলিসহ অসংখ্য ব্যবসায়ীরা গ্রেফতার হতো না। কারণ তাদের গ্রেফতার না করণে পুলিশ অনেকটাই অবৈধ লাভবান হতো। তাহলে সেটা যখন হয় নাই প্রবাসীকে টাকার জন্য পুলিশ পিটিয়েছে এই ঘটনাটি কতটুকু যুক্তিযুক্ত তা বিচার করার দায়িত্ব আমি আপনাদেরই দিয়ে গেলাম। এএসআই (নিরস্ত্র) মহিউদ্দিন কখনই উক্ত আসামি মনির সরদারের পরিবারের কাছে তিন লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে নাই বা অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যক্তি স্বার্থে চরিতার্থ করার জন্য লাঠিচার্জ করে নাই। সম্পূর্ণ বিষয়টি ছিল পুলিশের নিয়মিত দায়িত্বের অংশ। কারণ আসামি কখনোই নিজের ইচ্ছায় পুলিশের কাছে ধরা দেয়নাই ও বিজ্ঞ আদালতে আত্মসম্পর্ণ করে নাই। আসামিকে কৌশলে ধরে নিয়ে আসতে হয়। এই আসামির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।
×