ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জাহাজীকরণ জটিলতায় ৫ মাস ধরে বিদেশে পাঠানো বন্ধ

পাটখড়ি থেকে চারকোল-রফতানি বাণিজ্যে অপার সম্ভাবনা

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ১৬ মে ২০১৭

পাটখড়ি থেকে চারকোল-রফতানি বাণিজ্যে অপার সম্ভাবনা

এমদাদুল হক তুহিন ॥ ‘দেশে পাটখড়ি থেকে চারকোল উৎপাদনের অপার সম্ভবনা। বাইরের দেশে এর ব্যাপক চাহিদা। ২০১৩ সালে উদ্যোক্তা হিসেবে এই খাতের সঙ্গে যুক্ত হই। নতুন খাতে কিছু করব বলেই এগিয়ে আসি। পর পর রাজবাড়ী ও নারায়ণগঞ্জে গড়ে তুলি দুটি কারখানা। অর্ডার পেতে থাকি। তবে কয়েক মাস ধরে জাহাজীকরণ বন্ধ থাকায় থমকে আছে এ খাতের রফতানি। ক্রেতারা অন্য দেশের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে। ফলে যাত্রা শুরুর অল্প সময়ের মধ্যে রুদ্ধ হতে চলছে অমিত সম্ভাবনার এ খাত’-কথাগুলো বলছিলেন চারকোল বিডি ইন্টারন্যাশনালের উদ্যোক্তা মনিরুল ইসলাম মিতু। জনকণ্ঠকে একই কথা জানালেন বাংলাদেশ চারকোল উৎপাদন ও রফতানিকারক সমিতির (প্রস্তাবিত) আহ্বায়ক মির্জা জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, দেশে চারকোলের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বর্তমানে এর শিপমেন্ট বন্ধ। দুর্ঘটনাজনিত কারণে বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুর পোর্টে কন্টেনার পরিবহনে সমস্যা তৈরি হয়েছে। ফলে কয়েক মাস ধরে চারকোল রফতানি বন্ধ। আশা করছি, সমস্যা কাটিয়ে উঠে দ্রুতম সময়ের মধ্যে ফের রফতানি শুরু হবে। আর খাতটির সঙ্গে জড়িত একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বহির্বিশ্বে প্রতিনিয়তই চারকোলের চাহিদা বাড়ছে। দেশী উদ্যোক্তারাও আগ্রহী হয়ে উঠছে এ খাতের প্রতি। সংশ্লিষ্টদের মতে, পাটখড়ি থেকে কার্বন দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। একইসঙ্গে আভাষ দিচ্ছে নতুন এক সম্ভবনার। যাত্রা শুরুর ৫ বছরের মাথায়, ৫ মাস ধরে রফতানি বন্ধ থাকায় অধরাই থেকে যাচ্ছে ‘বিপুল হাতছানি’। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য থেকে জানা গেছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশ থেকে ৫৪ কোটি টাকার চারকোল রফতানি হয়। বাংলাদেশ চারকোল উৎপাদন ও রফতানিকারক সমিতির তথ্যমতে বর্তমানে দেশ থেকে ১৫০ কোটি টাকার চারকোল রফতানি হচ্ছে। ভবিষ্যতে দেশের উৎপাদিত সকল পাটখড়ি ব্যবহার করে রফতানি আয় আড়াই হাজার কোটি টাকাও স্পর্শ করা সম্ভব। এটি সম্ভব হলে একই সঙ্গে সৃষ্টি হবে ব্যাপক কর্মসংস্থান। এভাবেই ফিরে আসতে পারে পাটের হারানো সোনালি ঐতিহ্য Ñপ্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের। প্রসঙ্গত, চারকোল বা এক্টিভেটেড কার্বন পাটখড়ি থেকে উৎপাদিত একটি পণ্য। এছাড়া কাঠের গুঁড়া, নারকেলেরছোবড়া ও বাঁশ থেকেও চারকোল উৎপাদন হয়ে থাকে। দেশে এখন পর্যন্ত পাটখড়ি থেকেই চারকোল উৎপাদিত হয়ে আসছে। জানা গেছে, বিশেষ চুল্লিতে পাটখড়ি লোড করে তাতে আগুন দেয়া হয়। ১০-১২ ঘণ্টা রাখার পরে চুলা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়া হয়, যাতে চুলার ভেতরে কোন প্রকার অক্সিজেন প্রবেশ করতে না পারে। এভাবে ৪ দিন রাখার পরে এটি কার্বনে পরিণত হয়। পরে সেই কার্বন প্যাকেজিং করে রফতানি হয় বিদেশে। এ প্রসঙ্গে পাট অধিদফতরের মহাপরিচালক মোছলেহ উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, দেশে চারকোল উৎপাদনের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। আর পাটখড়ি থেকে চারকোল বা কার্বন উৎপাদন দেশের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক। কারণ, ১০ টাকার পাটখড়ি দিয়ে যদি ৮ ডলারের চারকোল উৎপাদন করতে পারি এবং তা বিদেশে বিক্রি করতে পারি; তবে তা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে যথেষ্ট সহায়ক। খাতটি জনপ্রিয় হয়ে উঠলে দেশের রফতানি আয় বৃদ্ধিতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিষয়টি একদম নতুন হওয়ায় খাতটি এখনও সুনির্দিষ্ট কারও নিয়ন্ত্রণে নেই। এ খাতে যারা ব্যবসা করছে তাদের লাইসেন্সের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে। প্রাথমিকভাবে আমরা দিক নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছি। বৈশ্বিক তথ্য থেকে দেখা গেছে, বিশ্বে প্রতিবছর ৮.১ শতাংশ হারে চারকোলের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৮ সালে বিশ্বে চারকোলের চাহিদা হবে ২১ লাখ মেট্রিক টন। এই তথ্য ক্লিভল্যান্ডভিত্তিক শিল্প বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফ্রিডোনিয়া গ্রুপ ইনকর্পোরেশনের। আর গ্র্যান্ড ভিউ রিসার্চের তথ্যমতে, ২০২৪ সালে চারকোলের বৈশ্বিক বাজার হবে ১০.১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। মূলত পানি, গ্যাস ও তেল বিশুদ্ধকরণে চারকোল ব্যবহৃত হয়। এছাড়া ব্যাটারির কালি, প্রিন্টারের সেল, প্রসাধন সামগ্রী, স্টিল ইন্ডাস্ট্রিতেও এটি ব্যবহৃত হচ্ছে। বিদেশে চারকোল থেকে ফেস ওয়াশ, ফটোকপিয়ারের কালি, পানির ফিল্টার, বিষ ধ্বংসকারী ওষুধ, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, দাঁত পরিষ্কার করার ওষুধ তৈরি হয়। এছাড়াও বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনে এ কার্বন ব্যবহৃত হচ্ছে। তথ্য থেকে জানা গেছে, দেশে প্রতিবছর প্রায় ৩০ লাখ টন পাটখাড়ি উৎপন্ন হয়। এর মধ্যে যদি ৫০ ভাগ পাটখড়িও চারকোল উৎপাদনে সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায় তবে প্রতিবছর প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার টন চারকোল উৎপাদন করা সম্ভব; যা বিদেশে রফতানি করে প্রতিবছর প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। চীন ছাড়াও দেশে এ পণ্যের ব্যাপ্তি বাড়লে ভবিষ্যতে জাপান, ব্রাজিল, তুর্কিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজার ধরা সম্ভব হবে। ২০১২ সালে দেশে এই শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। সে বছরই চীনে চারকোল রফতানি শুরু হয়। জানা গেছে, দেশে পাটখড়ি থেকে কার্বন তৈরির পথ দেখান চীনা নাগরিক ওয়াং ফেই। পাবনায় অবস্থিত এসজেজে জয়েন্ট কোম্পানির ব্যবস্থাপক ওয়াহেদুজ্জামানের তথ্যমতে, ওই চীনা নাগরিকের দেখানো পথ অনুসরণ করেই দেশে গড়ে উঠেছে চারকোল কারখানা। বর্তমানে দেশের কয়েকটি জেলায় এ কারখানা বিস্তৃত হয়েছে। উল্লেযোগ্য জেলাগুলো হচ্ছেÑ জামালপুর, নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহী, পাবনা, রাজবাড়ী, ফরিদপুর ও গাজীপুর।বর্তমানে দেশে অন্তত ত্রিশটি চারকোল কারখানা রয়েছে। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছেÑ সানবিম কর্পোরেশন, মাহফুজা এ্যান্ড আহান এন্টারপ্রাইজ, জামালপুর চারকোল লিমিটেড ও রিগারো প্রাইভেট লিমিটেড। চারকোল শিল্পের সম্ভাবনা ও প্রতিবন্ধকতা জানতে কথা হয় চারকোল বিডি ইন্টারন্যাশনালের উদ্যোক্তা মনিরুল ইসলাম মিতুর সঙ্গে। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, প্রতিবছর প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার কার্বন রফতানি করা সম্ভব। বাইরের দেশে এর ব্যাপক চাহিদা। অনেক ক্রেতা রয়েছে তারা অর্ডার দিচ্ছেন। কিন্তু জাহাজীকরণ বন্ধ থাকায় তাদের অর্ডারকৃত কার্বন পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। খাতটির সমস্যা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে প্রধান সমস্যাটি হচ্ছেÑ চারকোল রফতানিতে জাহাজীকরণ বন্ধ। ৪ থেকে ৫ মাস ধরে কোন রফতানি হচ্ছে না। ফলে বিদেশী ক্রেতারা বাংলাদেশ ফেলে অন্য দেশের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। সম্ভাবনার বিপুল হাতছানি থাকা সত্ত্বেও খাতটি এখন মার খাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ চারকোল উৎপাদন ও রফতানিকারক সমিতির আহ্বায়ক মির্জা জিল্লুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, দেশে চারকোলের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বর্তমানে এর শিপমেন্ট বন্ধ। দেশে ও সিঙ্গাপুর পোর্টে অসর্তকর্তাজনিত কারণে কার্বনের কন্টেনারে আগুন ধরে যায়। এটি একটি দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনা তো দুর্ঘটনাই। এ কারণেই কয়েক মাস ধরে চারকোল রফতানি বন্ধ আছে। শিপিং এজেন্ট এ্যাসোসিয়েশন ও পাট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমরা বৈঠক করেছি। সিঙ্গাপুরেও এ বিষয়ে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে। আশা করি শীঘ্রই জাহাজীকরণের এই সমস্যা কেটে যাবে।
×