ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকা চেম্বারের এই প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক একশ’ কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করে

২ হাজার নতুন উদ্যোক্তা প্রকল্প ॥ ঋণ পেয়েছেন ৯ জন

প্রকাশিত: ০৫:২১, ৩ মে ২০১৭

২ হাজার নতুন উদ্যোক্তা প্রকল্প ॥ ঋণ পেয়েছেন ৯ জন

রহিম শেখ ॥ ৫ মাসের মধ্যে ২ হাজার নতুন উদ্যোক্তা তৈরির ঘোষণা দিয়েছিল ঢাকা চেম্বার (ডিসিসিআই)। প্রকল্পটির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক একশ’ কোটি টাকার একটি পুনঃঅর্থায়ন তহবিলও গঠন করে। তবে এ উদ্যোগের সাড়ে তিন বছরে সব শর্ত পূরণ হয়েছিল মাত্র ৯ জনের। যাচাই বাছাই শেষে এই ৯ জনকেই বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে সহযোগিতা করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর উদ্যোক্তা তৈরির এ প্রকল্প থেকে আর কেউ উঠে আসেনি। ফলে সম্পূর্ণরূপে মুখ থুবড়ে পড়েছে প্রকল্পটি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত উদ্যোক্তা তৈরিতে ডিসিসিআইয়ের নিজস্ব প্রশিক্ষক না থাকায় অঙ্কুরেই পরিকল্পনাটি নষ্ট হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও ঢাকা চেম্বার সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালের ২৫ মে এক সংবাদ সম্মেলন করে জুন থেকে অক্টোবরের মধ্যে নতুন দুই হাজার উদ্যোক্তা তৈরির ঘোষণা দেয় ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)। সরকারী ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজসহ সারাদেশে প্রচারণা চালিয়ে বিভিন্ন খাতে এ উদ্যোক্তা তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এরপর ওই বছরের ১৩ জুন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাতের উন্নয়নে ঢাকা চেম্বারের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সমঝোতা স্মারকে চুক্তি স্বাক্ষর হয়। চুক্তিতে বলা হয়, সারাদেশের ৪০ হাজার উদ্যোক্তার মধ্য থেকে সৃষ্টিশীল, সম্ভাবনাময়ী ও বাস্তবায়নযোগ্য ২০০০ প্রকল্প খুঁজে বের করা হবে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক পর্যালোচনায় দেখা যায়, এর আওতায় সে বছরই ৩ হাজার ২৯ তালিকাভুক্ত উদ্যোক্তার মধ্যে ৯টি সঠিক থাকায় ঋণ প্রদানের জন্য তা ব্যাংকে পাঠানো হয়েছিল। যারা যথাসময়ে ব্যাংক ঋণ পেয়েছে। তবে এমওইউ এর শর্ত অনুযায়ী ডিসিসিআইয়ের ২ হাজার উদ্যোক্তা খুঁজে বের করার কথা ছিল। বর্তমানে প্রকল্পটির কাজে তেমন কোন অগ্রগতি নেই। ৯টিতেই থেমে রয়েছে। জানা গেছে, ২০১৩ সালের অক্টোবরে নতুন উদ্যোক্তা তৈরির প্রকল্পের জন্য ১০০ কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলো এ তহবিল থেকে ৫ শতাংশ সুদে অর্থ নিয়ে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ সুদে তা নতুন উদ্যোক্তাদের ঋণ হিসেবে দিতে পারে। তবে তহবিল গঠনের সাড়ে তিন বছর পার হয়ে গেলেও এখনও পর্যন্ত কোন ব্যাংক পুনঃঅর্থায়ন তহবিলের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আবেদন করেনি। এতে করে নতুন উদ্যোক্তা তৈরির জন্য গঠিত একশ’ কোটি টাকার তহবিলের পুরোটাই অব্যবহৃত থেকে গেছে। এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে জানান, দুই হাজার উদ্যোক্তা তৈরির প্রকল্পটি নিয়ে সব আশা-ভরসা শেষ হয়ে গেছে। উদ্যোক্তা তৈরিতে ডিসিসিআই যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা তারা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। এখন যা পরিস্থিতি, তাতে প্রকল্পটি বন্ধ হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, এমওইউর এর শর্তানুযায়ী ৬৪ জেলার চেম্বার অব কমার্সের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ডিসিসিআই প্রকল্প ও উদ্যোক্তা খুঁজে বের করবে। কিন্তু জেলা পর্যায়ে কোন প্রকার প্রচারণা চালানো হয়নি এবং সহযোগিতাও গ্রহণ করা হয়নি বলে জানা গেছে। উদ্যোক্তাদের মধ্য থেকে সেরা প্রকল্প ও এর উদ্যোক্তাদের পুরস্কৃত করার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত তা করেনি ডিসিসিআই। নিজস্ব ট্রেনিং সেন্টার, আন্তর্জাতিক দক্ষ প্রশিক্ষক, উদ্বুদ্ধকারী, অভিজ্ঞ পরামর্শদাতা ও পেশাজীবী দ্বারা প্রাতিষ্ঠানিক ও হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দেয়ার শর্ত ছিল। ডিসিসিআই নিজস্ব প্রশিক্ষকের ও ট্রেনিং প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষিত করা। কিন্তু ডিসিসিআইয়ের নিজস্ব কোন ট্রেনিং ইনস্টিটিউট নেই। নেই কোন প্রশিক্ষক। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট থেকে ৮৬২ জনকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। যা নিয়ম বহির্ভূত। এজন্য তাদের ঋণের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়নি। ফলে তারা উঠে আসতে পারেনি উদ্যোক্ত হিসেবে। এজন্য অবশ্য ডিসিসিআইকে তিরষ্কারও করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের এক উর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, তাদের যে নীতি মেনে উদ্যোক্তা নিয়ে আসার কথা ছিল তা তারা করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের কাছে যাদের নিয়ে এসেছে তাদের কোন মতে ধরে আনা হয়েছে। যথার্থ কোন ট্রেনিংও দেয়া হয়নি। এজন্য এদের অর্থায়নের কোন ব্যবস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক করতে পারেনি। ডিসিসিআইকে বলা হয়েছে ভবিষ্যতে তারা যেন এ ধরনের উদ্যোক্তা না নিয়ে আসে। সব শর্ত পূরণ করেই তাদের আসতে হবে। সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালের নবেম্বরে ‘উদ্যোক্তা ও আবিষ্কার প্রদর্শনীর’ মাধ্যমে ২ হাজার উদ্যোক্তা তৈরির প্রকল্প শুরু হয়। রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ এ প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। এরপর উদ্যোক্তা তৈরির এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক, ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) ও ইনস্টিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার বাংলাদেশের সঙ্গে আলাদা আলাদ চুক্তি করা হয়েছিল। প্রকল্পটির যাত্রা শুরু হয় ডিসিসিআইয়ের তৎকালীন সভাপতি সবুর খানের হাত ধরে। সে সময় বিভিন্ন সভা সেমিনারে তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে ও বিরাট জনশক্তির চাহিদা পূরণে নতুন ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা সৃষ্টির কোন বিকল্প নেই। এ লক্ষ্যে তরুণদের মধ্যে থেকে ২ হাজার নতুন উদ্যোক্তা তৈরির এ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। জানা গেছে, উদ্যোক্তা তৈরির এ প্রকল্পের আওতায় ২০১৫ সালে শহরে ৫শ’, গ্রাম পর্যায়ে ১ হাজার এবং ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মধ্য থেকে ৫শ’টি নতুন প্রকল্প তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছিল ডিসিসিআই। ডিসিসিইয়ের লক্ষ্য ছিল, এসব প্রকল্পের সঙ্গে দেশের জনসংখ্যার বিরাট অংশ যুক্ত হয়ে অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখবে। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নের নির্ধারিত সময় ২০১৫ সাল পেরিয়ে গেলেও লক্ষ্যমাত্রা ধারে-কাছেও যেতে পারেনি ডিসিসিআই। তবে ঋণ সহায়তা পাওয়া উদ্যোক্তাদের ব্যবসায় উন্নতি হচ্ছে কি না, তা মনিটরিং করছে ডিসিসিআই। এজন্য সংগঠনটি পরামর্শক নিয়োগ দিয়েছে বলে জানা গেছে। প্রকল্পটির বর্তমান পরামর্শকের দায়িত্বে রয়েছেন সাবেক ব্যাংকার কাজী সাইফুর রহমান। তিনি বলেন, ৩০২৯টি আবেদনের মধ্যে থেকে ৮৬২ জনকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এর মধ্যে থেকে মাত্র ৯ জনকে ঋণ সহায়তা দেয়া হয়। যদিও ডিসিসিআইয়ের নিজস্ব কোন প্রশিক্ষক নেই, আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে অর্থাৎ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (এসসিআইটিআই) থেকে ৮৬২ জনকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এদের মধ্যে থেকে ২০১৬ সালে আরও ২২টি প্রজেক্টকে লোন সহায়তার জন্য বিভিন্ন ব্যাংকে পাঠানো হয়েছে। ঝিমিয়ে পড়া এ প্রকল্প সচল করতে ডিসিসিআইয়ের উদ্যোগ সম্পর্কে সাইফুর রহমান বলেন, নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য মেলার আয়োজন করা হচ্ছে। এছাড়া এ বছর বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরামের সঙ্গে ৭টি বিভাগের সাত বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিনার করার কথা রয়েছে। এতে শিক্ষার্থীদের আইডিয়া শেয়ার করা ও তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা তৈরি করার চেষ্টা করা হয়েছে। এ উদ্যোগের প্রধান উদ্যোক্তা ডিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি সবুর খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
×