ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় শিক্ষার্থীর ভাবনা

প্রকাশিত: ০৫:১১, ১৬ এপ্রিল ২০১৭

জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় শিক্ষার্থীর ভাবনা

অনেকে অনেক কিছুই লুকোতে চায়। কেউ লুকোতে চায় অবৈধভাবে উপার্জিত কালো টাকা, কেউ বা কালো চেহারা, আবার কেউ লুকোতে চায় চাদরের নিচে থাকা ককটেল কিংবা বোমার মতো বিস্ফোরক দ্রব্য। যে বোমার বিস্ফোরণে এক সময় ঘাতক নিজেই নিজের শিকার হয়ে ওঠে। হিংস্র এসব কর্মকা-ের মাধ্যমে এরা কেন বসবাসযোগ্য এই পৃথিবীতে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে। আজকের তরুণ প্রজন্ম কেন এসব হিংস কাজে জড়িয়ে পড়ছে। কেন তারা জঙ্গীবাদের মতো ন্যক্কারজনক কর্মকা-ে জাড়াচ্ছে? সম্প্রতি সিলেট, মৌলভীবাজার, টঙ্গীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গীবাদের উত্থান এদেশে জঙ্গীদের ভীত কতটা মজবুত তাই প্রমাণ করে। যদিও জঙ্গীদের আস্তানায় সফল অভিযান চালিয়ে তাদের সকল অপচেষ্টা ব্যর্থ করতে সমর্থ হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, এসব জঙ্গী কর্মকা-ে দেশের তরুণদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ জড়িয়ে যাচ্ছে। ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে এসব তরুণকে বিপথগামী করছে একটি স্বার্থান্বেষী মহল। তাদেরই হিংস্র থাবার কবলে পড়ে জীবন দিতে হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষকে। দেশ ও জাতি গঠনে যাদের অগ্রগামী সৈনিক হওয়ার কথা, আজ তারাই হয়ে উঠছে আত্মঘাতী। তাই দেশ ও জাতির ভবিষ্যতকে সমুজ্জ্বল করতে তরুণ সমাজকে এই বিপদগামী পথ থেকে ফিরিয়ে আনার বিকল্প নেই বলে মনে করছেন অনেকেই। কেন দেশে এই জঙ্গীবাদের উত্থান? জানতে কথা হয়েছিল দেশের প্রথমসারির কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া কয়েক তরুণ শিক্ষার্থীর সঙ্গে। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানায়, দেশে জঙ্গীবাদের উত্থানের কারণ ও তা নিরসনের কিছু উপায় সম্পর্কে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী বাহারুল হক সুমন। জঙ্গীবাদ উত্থানের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জীবন সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা দিয়ে তরুণদের বিপথে গমন করতে প্ররোচিত করছে কিছু মানুষ। পরিবারের বেখায়েলীপনা, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, কিছু সহপাঠির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অনেক তরুণ জঙ্গীবাদের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে। তরুণদের মানবিক শিক্ষার মাধ্যমে মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারলেই এর সমাধান সম্ভব। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী আতাউর রহমান বলেন, ধর্মের অপব্যাখ্যার মাধ্যমে তরুণদের জঙ্গীবাদের মতো ন্যক্কারজনক কর্মকা-ে জড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। একদল স্বার্থান্বেষী মহল তাদের নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য ইসলাম প্রতিষ্ঠার নামে তরুণদের ভুল পথে পরিচালিত করছে। আর তরুণরা এদের ধূর্ততা না বুঝেই নিজের জীবনকে হিংস্র কাজে বিলিয়ে দিচ্ছে। কথা হয়েছিল বুয়েটের আর্কিটেকচার বিভাগের শিক্ষার্থী শ্রীবাস দেবনাথের সঙ্গে। সঙ্গ দোষেই তরুণরা জঙ্গীবাদের সঙ্গে জড়াচ্ছে বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, পরিবার ছেড়ে বহু শিক্ষার্থী মেস বা হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে। শিক্ষার্থীদের এসব মেস বা হোস্টেলকে লক্ষ্য করে জঙ্গীরা তৎপর হয়ে কাজ চালায়। পরিবার থেকে দূরে থাকায় সহজেই তাদের মগজ ধোলাই করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় বলে তিনি মনে করেন। হল মেস কিংবা হোস্টেলে থাকা এসব শিক্ষার্থীর সঙ্গে তাদের পরিবার যদি সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখে, তবে জঙ্গীবাদ থেকে তাদের বিরত রাখা সম্ভব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান বলেন, না বুঝেই জঙ্গীবাদের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে তরুণ সমাজের একটা অংশ। জান্নাত পাওয়ার ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে তাদের বিপথে পরিচালিত করা হচ্ছে। ইসলাম ধর্মে জঙ্গীবাদের কোন স্থান নেই, তা তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে। তাহলেই জঙ্গীবাদ মোকাবেলা করা সম্ভব হবে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী সেলিনা পারভিন। তিনি বলেন, হতাশার কারণেই জঙ্গীবাদের সঙ্গে তরুণদের একটি অংশ জড়িয়ে যাচ্ছে। জীবনে আকাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে না পারার হতাশায় যখন তারা ভোগে, তখন সেই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে থাকে কিছু অসাধু ব্যক্তি। জীবনের হতাশা থেকেই তারা এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সুমাইয়া সুলতানা বলেন, তরুণ বয়সে যে কোন বিষয়ের প্রতি এক ধরনের কৌতূহল কাজ করে মানুষের। ধর্মীয় বিষয়ের প্রতি অনেকটা কৌতূহল বশত কারণেই অনেকে জড়িয়ে পড়ে জঙ্গীবাদে। যখন তাদের ধর্মের দোহাই দিয়ে ভুলভাবে প্রভাবিত করা হয়, তখন তারা আর ফিরে আসতে পারে না। বয়সের এ সময়টা যদি পরিবারের সঙ্গে কাটানো যেত তাহলে এভাবে তরুণদের প্ররোচিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকত না। তবে সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে দেশ থেকে জঙ্গীবাদ নির্মূল করা সম্ভব বলে জানান কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শতাব্দী যুবায়ের। তিনি বলেন, আমাদের সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছন্ন হওয়ার কারণেই জঙ্গীবাদের মতো অশুভ কর্মকা-ের উত্থান হয়েছে। আমরা যদি আমাদের মূল সংস্কৃতিকে নিজেদের মধ্যে ধারণ করি তাহলে এরকম ন্যক্কারজনক কাজে কেউ নিজেদের জড়াবে না। তাই সংস্কৃতি চর্চার প্রতি জোর দেয়া উচিত। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘খোলা জানালা’র সভাপতি অপরূপ দাস অয়ন বলেন, মৌলবাদীদের মদদ, সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে বাধা এবং ধর্মের অপব্যাখ্যার কারণেই মূলত জঙ্গীবাদের সৃষ্টি। তিনি বলেন, দেশ থেকে মৌলবাদ প্রতিরোধ না করলে জঙ্গীবাদ নির্মূল করা সম্ভব নয়। জঙ্গীবাদের তৈরির পেছনে বিরাট একটি শক্তিশালী গোষ্ঠীর মদদ রয়েছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব ছাত্রদের। জঙ্গী নির্মূলে আগে ছাত্র সমাজকেই এগিয়ে আসতে হবে। রুখে দাঁড়াতে হবে সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে। তা না হলে জঙ্গীবাদ নির্মূল সম্ভব না। তবে জঙ্গীবাদ নির্মূলে দেশের পুলিশ বাহিনী, সেনাবাহিনীসহ অন্য সকল সরকারী প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও বেশি জোরালো ভূমিকা পালন করা দরকার বলে মনে করেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী স্বপন আহমেদ। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে জঙ্গী আস্তানায় যে রকম সেনাবাহিনী ও পুলিশ প্রশাসন সফল অভিযান চালিয়েছে, তা অতীতে করলে জঙ্গীদের শেকড়ের এত বিস্তৃতি ঘটত না। তিনি বলেন, জঙ্গীরা এখন দেশজুড়ে তাদের নেটওয়ার্ক স্থাপন করেছে। তাই পূর্বের চেয়ে বর্তমানে এদের নির্মূল করা অনেকটা কষ্টসাধ্য হবে। জঙ্গীবাদের সকল বেড়াজাল থেকে তরুণ সমাজ তথা দেশ ও জাতিকে মুক্ত করতে সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলা প্রয়োজন বলে মনে করেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম নাট্য সংগঠন দিক থিয়েটারের সভাপতি তনু দীপ। তিনি বলেন, নিজেদের পরিচয় আমরা এখন ভুলে যাচ্ছি। আমরা এখন নিজেদের সংস্কৃতি ভুলে গিয়ে বিদেশী সংস্কৃতির প্রতি বেশি আসক্ত। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আমাদের যে স্বাতন্ত্র্যতা আছে তা ভুলে যাওয়ার কারণেই তরুণ সমাজের আজ এত অধঃপতন। এমন অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে বলে তার অভিমত। তরুণ সমাজকে নিজেদের সংস্কৃতির ছায়াতলে নিয়ে আসতে হবে। মৌলবাদের ভ্রান্ত ধারণা থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তবেই জঙ্গীবাদ নির্মূল সম্ভব করা হবে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবৃত্তি বিষয়ক সংগঠন ‘মাভৈ’-এর সভাপতি কাসিব মুন্না বলেন, জঙ্গীবাদ বর্তমান সময়ের একটি বড় বিভীষিকা। সবচেয়ে বড় আশঙ্কার ব্যাপার হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া অনেক শিক্ষার্থীর সম্পৃক্ততা পাওয়া যাওয়া এর সঙ্গে। আত্মকেন্দ্রিক চিন্তা-ভাবনা, প্রাঞ্জল বিনোদনের অভাব, একাকীত্ব, হতাশা, সংস্কৃতিবিমুখ মনোভাব তরুণদের জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ার মূল কারণ তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, এই সঙ্কট নিরসনে তরুণদের খেলাধুলায় উদ্বুদ্ধকরণ, সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে অংশগ্রহণ বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। এতে অভিভাবকদের সচেষ্ট ভূমিকা সবচেয়ে কার্যকরী হবে বলে তাঁর বিশ্বাস। একটি দেশের মেরুদ- হচ্ছে ওই দেশের তরুণ সমাজ। দেশ ও জাতি গঠনে আগামী দিনে তাদেরই হাল ধরতে হবে, দিতে হবে নেতৃত্ব। দেশের এই সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতকে নিজেদের হীনস্বার্থ হাসিলের জন্য বিপথে পরিচালিত করার পাঁয়তারা আটছে একদল অসাধু ব্যক্তি। তাদের সকল কূটকৌশল, ধূর্ততাকে নস্যাৎ করে সঠিক পথ বেছে নিতে হবে তারুণদেরই। সকল বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে দেশ ও জাতির অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাবে তরুণরা; এই প্রত্যাশা সকলের। হোসাইন ইমরান
×