ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মোহাম্মদ কামরুল হাসান

শামার কণ্ঠে রবীন্দ্র সুধা

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ১৩ এপ্রিল ২০১৭

শামার কণ্ঠে রবীন্দ্র সুধা

রবীন্দ্রসঙ্গীত বাঙালী জাতীয় পরিচয়ের অন্যতম শৈল্পিক বাহন। যে সুরে বাঙালী জনগোষ্ঠীর জীবনবোধ ও শৈলী বর্ণিত হয়, জনগণের কণ্ঠ থেকে সুর ঝংকৃৃত হয়। এ কারণে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি বাঙালীর আকর্ষণ আজও দুর্নিবার। রবীন্দ্রসঙ্গীত সর্ববাঙালীর মিলন সাগর। এ সুরে কেবল বাঙালীর সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা প্রস্ফুটিত হয়নি। বরং বিশ্বজনীন মানুষের যে আকাক্সক্ষা ও জীবনাভূতির বহিঃপ্রকাশ তাও উঠে আসে এ সঙ্গীতের সুর ও মূর্ছনায়। তাই শতবর্ষকাল পেরিয়েও এ সঙ্গীত আজও জনপ্রিয় ও সমাদৃত। কবিগুরু নিজেও তেমন উপলব্ধি করেছিলেন। তাঁর গান রয়ে যাবে বাঙালীর হৃদয়ে। কবির এ অমোঘ বাণী সত্য করেছেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের জনপ্রিয় শিল্পীরা। বাংলাদেশের শামা রহমান সমসাময়িক রবীন্দ্র সঙ্গীত অঙ্গনের এমনি একজন শিল্পী, যিনি এ সুরের প্রতি তার গভীর আন্তরিক অনুরাগ ও সুরে ঠাঁই পেয়েছেন দর্শক হৃদয়ে। শামা রহমান কেবল দুই বাংলায় নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি, বরং বিশ্ব দরবারে এ সঙ্গীতকে উপস্থাপন করেছেন আপন মহিমায়। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে অবস্থিত দুই বাংলার শ্রোতা-দর্শকের পাশাপাশি প্যারিসে অবস্থিত জাতিসংঘের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ইউনেস্কোর প্রধান কার্যালয়কেও উদ্ভাসিত করেছেন রবীন্দ্র সঙ্গীতের মূর্চনায়, ছড়িয়েছেন তাঁর প্রতিভার আলো। রবীন্দ্র সাহিত্য ও সুরের আবহে বড় হওয়া শামা রহমানের সঙ্গীতে হাতেখড়ি মাত্র সাত বছর বয়সে। বাবা-মা দুজনই বাংলাদেশের প্রথিতযশা রাজনীতিক। রাজনীতির পাশাপাশি পিতা-মাতার সংস্কৃতিচর্চা শামা রহমানকে সঙ্গীতে আত্বনিয়োগ করতে গভীরভাবে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। প্রয়াত ওস্তাদ ফজলুল হকের কাছে প্রথম জীবনে ধ্রুপদী সঙ্গীতের তালিম নেন শামা রহমান। পরবর্তীতে ছায়ানট ও বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে হয় তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। সে শিক্ষার ধারা এখনও অব্যাহত রেখেছেন শামা রহমান। সময়-সুযোগ পেলে অবসরে সময় কাটান গীতবিতান পড়ে। প্রতিদিন প্রতিক্ষণ তাকে নবরূপে ধরা দেয় এ গান, সুর ও কথা। প্রকৃতির সান্নিধ্যে থাকা নিভৃতচারী এ শিল্পী প্রচুর গান শোনেন। ছবি,গান ও আর্কিটেকচার তার কাজের মূল অনুপ্রেরণা। সম্প্রতি রাজধানী ঢাকার একটি পাঁচতারকা হোটেলে অধ্যাপক রেহমান সোবহানকে গুণীজন সংবর্ধনা দেয়া হয়। দেশবরেণ্য এ গুণীজনের পছন্দসই শিল্পীর তালিকায় শামা রহমান। এ কারণে রেহমান সোবহানের এ সংবর্ধনাকে প্রাণোজ্জ্বল করতে শামা রহমানকে আমন্ত্রণ জানান আয়োজক প্রতিষ্ঠান। কেবল রেহমান সোবহান নন, আন্তর্জাতিক পরিম-লে প্রশংসার স্বীকৃতিপ্রাপ্ত স্যার ফজলে হাসান আবেদেরও পছন্দের শিল্পী শামা রহমান। এ নিয়ে তার জীবনে রয়েছে মজার একটি স্মৃতি। যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া অঙ্গরাজ্যে একবার স্যার ফজলে হাসান আবেদকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। আয়োজকরা জানতেন শামা রহমান স্যার ফজলে হাসান আবেদের প্রিয় শিল্পী। এ কারণে আয়োজকরা স্যার ফজলে হাসান আবেদকে সারপ্রাইজ দিতে স্যার আবেদের অগোচরে অনুষ্ঠানে শামা রহমানকে আমন্ত্রণ জানান এবং শিল্পী শামাকে বিষয়টি গোপন রাখার অনুরোধ করেন। সে যাই হোক, নির্ধারিত দিনে সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। স্যার ফজলে হাসান আবেদ ও শামা রহমান দুজনই একই হোটেলে উঠেছেন। কিন্তু স্যার ফজলে হাসান আবেদ শামা রহমানের আমন্ত্রণের বিষয়টি ঘূণাক্ষরেও টের পাননি। শামা রহমানের মধ্যে এক ধরনের উত্তেজনা কাজ করছিল। কী অদ্ভুত এক লুকোচুরি খেলা। কি অসাধারণ মজার অনুভূতি। হোটেলে আসা-যাওয়ার মুহূর্তে সর্বক্ষণ শামা রহমানকে সতর্ক থাকতে হয়। খোঁজ রাখতে হয় স্যার ফজলে হাসান আবেদ লবিতে উপস্থিত আছেন কি-না। পাছে শামা রহমানের উপস্থিতি স্যার ফজলে হাসান আবেদ জেনে যাবেন। এ ছিল ভয়। তখন সারপ্রাইজ হওয়ার ব্যাপারটা আর থাকবে না। যথারীতি অনুষ্ঠান শুরু হলো। সংবর্ধনা শেষে যখন মঞ্চে শামা রহমানকে গান গাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হলো তখন আবেগে চোখ ভিজে এলো স্যার আবেদের। শামা রহমানের উপস্থিতিতে তিনি রীতিমতো অভিভূত হলেন। সত্যিকারার্থেই মঞ্চে শামার উপস্থিতি অনুষ্ঠানের শোভা বাড়িয়ে দেয়। সিলেটে বেঙ্গলের আয়োজনেও উপস্থিত ছিলেন শামা রহমান। পেয়েছেন অগণিত দর্শকের স্নিগ্ধ ভালবাসা। সে ভালবাসায় সিক্ত হয়ে ইদানিং ক্রমেই মেলে ধরছেন নিজেকে। প্রচার কিংবা প্রকাশ করা মূল উদ্দেশ্য নয়; বরং রবীন্দ্র বাণী সর্বসাধারণ ও নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেয়া তার মূল লক্ষ্য। নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত আগ্রহ নিয়ে শোনেন এ শিল্পী। তাদের অনেকের সুর ও গান তার ভাল লাগে। স্যার ফজলে হাসান আবেদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের পাশাপাশি প্যারিসের স্মৃতি আজও শামা রহমানকে বিমোহিত করে। কবিগুরুর সার্ধশত বছর উপলক্ষে জাতিসংঘের ইউনেস্কোর প্রধান কার্যালয়ে রবীন্দ্র সঙ্গীত পরিবেশনা আয়োজিত হয়। প্যারিসের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিশ্বের সব দেশের বরেণ্য কূটনীতিক ও গুণীজনরা। এমন অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতিনিধিত্ব করা অত্যন্ত দুর্লভ ও গর্বের বিষয়। আনন্দকণ্ঠের সঙ্গে সাক্ষাতকালে শামা রহমান বিষয়গুলো জানান। সার্ধশত বছর উপলক্ষে ইউনেস্কো শামা রহমানের গাওয়া পাঁচটি এ্যালবাম রিলিজ হয়। প্রেম, প্রকৃতি, পূজা, স্বদেশ ও বিচিত্রা নামে তার এ্যালবামসমূহ বাজারে আসে। এছাড়া গীতাঞ্জলির শতবর্ষ উপলক্ষে ইউনেস্কো শামা রহমানের আরও চারটি এ্যালবাম রিলিজ করে। এছাড়া বাংলাদেশে রিলিজ হয় বেঙ্গল গ্যালারির ব্যানারে তার বেশকিছু এ্যালবাম ও ভারতের একটি নামকরা রেকর্ডিং কোম্পানি তার দুটি গাওয়া গান সে দেশের বাজারে ছাড়ে। শামা রহমান একজন নিভৃতাচারী শিল্পী হলেও তার শৈশব কেটেছে রাজনৈতিক ব্যস্ত আবহে। একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরি কিংবা যে কোন জাতীয় দিবসে মায়ের হাত ধরে গান গেয়ে ট্রাকে চড়ে হাজির হতেন শহীদ মিনার কিংবা নানা অনুষ্ঠানে। এ কারণে দেশ ও মানুষের প্রতি তার সহজাত আবেগ ও ভক্তি, যা আজও তার সত্তায় বিরাজমান। দেশের বরেণ্য চিত্রশিল্পীদের আঁকা ছবি তাকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করে। শিল্পী কামরুল হাসান তার পছন্দের শিল্পী। পটুয়া কামরুল হাসানের আঁকা ছবি তাকে ভীষণভাবে মুগ্ধ করে। এছাড়া শিল্পী আমিনুল ইসলাম ও বর্তমান সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় শিল্পী সাহাবুদ্দিনের কাজ তার ভাল লাগে। শামা রহমানের বৈঠকখানায় কেবল পেইন্টিং, বই ও নানা শিল্পকর্ম। ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীদের আঁকা ছবি তার পছন্দের। গান কিংবা ঘুড়ে বেড়ানোর সুযোগে যখনই বিদেশে যান তখনই সময় কাটান বিভিন্ন গ্যালারি ঘুরে। প্রকৃতির সান্নিধ্যও তাকে আনন্দ দেয়। এ কারণে ছাদে বাগান করতে ভালবাসেন এ শিল্পী। সম্প্রতি তার একটি এ্যালবামের রেকর্ডিং কাজ চলছে। শীঘ্রই তা বাজারে আসবে। ছবি : ইবনুল আসেফ জাওয়াদ
×