ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

বৈষম্যের বিপরীতে নাট্যোৎসব

প্রকাশিত: ০৬:৩৫, ৬ এপ্রিল ২০১৭

বৈষম্যের বিপরীতে নাট্যোৎসব

মুনীর চৌধুরী যেমন ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয়ে অধ্যাপক থাকাকালে সরাসরি ভাষা আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার কারণে কারাবরণ করেন, অনেকটা তেমনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে অধ্যাপনা এবং রেজিস্ট্রার থাকার মধ্যবর্তী সমযে আনন্দমোহন কলেজে শিক্ষকতাকালীন ভাষা আন্দোলনে যুক্ত হয়ে কারাবরণ করেন শিক্ষক ও শিক্ষাবিদ সৈয়দ বদরুদ্দীন হোসাইন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রেজিস্ট্রার থাকাকালে তিনি হয়ে ওঠেন টিচার এ্যান্ড সুডেন্ট সেন্টার (টিএসসি) কেন্দ্রিক নাট্যদলগুলোর সাংস্কৃতিক অভিভাবক। অভিভাবক হিসেবেই তিনি যেমনিভাবে স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে গ্রুপ থিয়েটারের আন্দোলনে সক্রিয ভূমিক রেখেছেন ঠিক তেমনিভাবে তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দেশের অন্যতম নাট্যদল পদাতিক নাট্য সংসদকে তিন দশক ধরে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ফলে আজ এই নাট্যদল সৈয়দ বদরুদ্দীন হোসাইনের জন্ম দিন ১১ এপ্রিলকে মাথায় রেখে ৯৪তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে যে নাট্যোৎসব ও স্মারক সম্মাননা ২০১৭ আয়োজন করবে সেটাই তো স্বাভাবিক। জীবনের থেকে শিল্প বড় বলেই পদাতিক নাট্য সংসদ গতকাল ৫ এপ্রিল থেকে আরম্ভ করে আগামী ১১ এপ্রিল পর্যন্ত মোট ৭ দিনব্যপী উদযাপন করছে সৈয়দ বদরুদ্দীন হোসাইন স্মৃতি নাট্যোৎসব ও স্মারক সম্মাননা ২০১৭। সতেরো না বরং চল্লিশ বছরে মঞ্চনাটক ও পথনাটক মিলিয়ে মোট ঊনচল্লিশটি নাটক মঞ্চায়নের গর্বিত দাবিদার যে পদাতিক নাট্য সংসদ তারা কিন্তু এই বিশেষ নামাঙ্কিত নাট্যোৎসের ও স্মারক সম্মাননা প্রদান করা শুরু করেছেন বিগত ২০১০ সাল থেকে। প্রতিবারই বাংলাদেশের নাট্যশিল্প বিকাশ এবং গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনে আবদান রেখেছেন এমন দুজন নাট্য ব্যক্তিত্বকে বেছে নেয়া হয়েছে এই স্মারক সম্মাননা প্রদানের জন্য। এমনিভাবে বিগত সময়ে পদকপ্রাপ্ত নাট্য ব্যক্তিত্বদের সমন্বিত প্রদীপ প্রজ্বলনের মধ্য দিয়ে গতকাল ৫ এপ্রিল বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় উদ্বোধিত হয়েছে এই সাত দিনব্যাপী নাট্যোৎসব। নাট্যোৎসবের এবারে স্মারক সম্মাননা প্রদান করা হচ্ছে আগামী ৭ এপ্রিল সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, মামুনুর রশীদ, লিয়াকত আলী লাকী, সৈয়দ তাসনীন হোসাইনের উপস্থিতিতে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের মাননীয় স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এমপি মহোদয়ের হাত দিয়ে। যে দুজন নাট্য ব্যক্তিত্বকে স্মারক সম্মাননা দেয়ার জন্য মনোনীত করা হয়েছে তারা হলেনÑ দেশ বরেণ্য নাট্য ব্যক্তিত্ব প্রয়াত এসএম সোলায়মান (মরণোত্তর) ও লাকী ইনাম। এসএম সোলায়মানের এক জীবনে ছিল কতই না বৈষম্য। একের পর এক নাটকের দল গঠন করেছেন কিন্তু দল দাঁড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে দল ছেড়ে যেতে হচ্ছে, প্রচার প্রচারণার আলো বরাবরই তার উপর কম পড়ছে তথাপি তিনি একের পর এক দর্শকদের সামনে হাউসফুল নাট্য প্রযোজনা নামাচ্ছেন। প্রতিষ্ঠিত তারকা অভিনেতা-অভিনেত্রী তার দলে নেই কিন্তু তার রচিত-নির্দেশিত-অভিনীত নাটক একের পর এক অভিনেতা-অভিনেত্রীদের তারকা বানিয়ে দিচ্ছেন। প্রযোজনার টানাপোড়নে দিগি¦দিক হয়ে খাদ্য-অখাদ্য খাচ্ছেন বলে দুর্নামের ভাগিদার হচ্ছেন অথচ প্রযোজনার খরচ মেটাতে গিয়ে হসপিটালে যেয়ে যে সস্তায় দেহের রক্ত বিক্রি করে আসছেন সে কথা যেন কেউই খেয়াল করছেন না। এত এত সব বৈষ্যম্যের বিপরীতে তার উপর নাগরিক ভাষায় সেঁটে দেয়া হচ্ছে অভিমানী কিংবা ক্ষ্যাপাটে। ফলত মেকাপে মুখের ক্ষত যদিও বা ঢাকা পড়ে কিন্তু বৈষম্যের ক্ষতের জ্বালা তো মেটে না। সেই জ্বালা খানিকটা মিটল ‘সকল বৈষ্যম্যের উর্ধে জাগরে নবীন প্রাণ’ স্লোগানকে হৃদয়ে ধারণ করে পদাতিক নাট্য সংসদের উৎসব আয়োজন এবং বিলম্বে হলেও (যদিও মরণোত্তর সম্মাননা এবারই প্রথম) এসএস সোলায়মানকে মূল্যায়ন করায়। মূল্যায়নের দিক দিয়ে বিবেচনা করলে ঢাকা, ঢাকার বাইরের জেলা এবং বিদেশ থেকে আগত নাটক মিলে মিশে যে বারোটি নাটক উৎসবে মঞ্চায়ন হচ্ছে ও হবে সেখানেও কিভাবে মঞ্চায়নের মূল সুর বৈষম্যের উর্ধে ওঠার তাড়না। গতকাল প্রাচ্যনাটক মঞ্চায়ন করে যে নাটক কইন্যা সেখানে উচ্চারিত হয় আঁধারের অতীত তাড়িয়ে আলোকিত ভোর দেখার আকণ্ঠ পিপাসা। বটতলা মঞ্চায়ন করে নাটক ক্রাচের কর্নেল যেখানে ইতিহাস আশ্রিত চরিত্রকে সামনে রেখে খোঁজা হয় ইতিহাসের নির্মাণ-বির্নিমাণের সীমারেখা। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আজ বিদেশ থেকে আগত উৎসবের অন্যতম সেরা মঞ্চায়ন মেঘনাদবধ এবং বড়দা খ্যাত মঞ্চের সিস্ময়কর অভিনেতা গৌতম হালদার অভিনীত নাটক পড়শি বসত করে। যান্ত্রিক এই সময়ে মানবিকতা যখন লুপ্ত প্রায়, প্রযুক্তির সর্বগ্রাসী সংযোগে প্রতিটি মানুষ যখন তার মতো করে নিঃসঙ্গ তখনও জীবন কত সুন্দর, বেঁচে থাকার আনন্দ কত বর্ণিল, উপকার করতে পারাটা কত তৃপ্তির তাই জাতীয় নাট্যশালায় অভিনয় করে দেখাবেন অভিনেতা গৌতম হালদার পড়শি বসত করে মঞ্চাযনের মধ্য দিয়ে।
×