ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকার বাইরে ভাষা আন্দোলন

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ঢাকার বাইরে ভাষা আন্দোলন

উর্দু, একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা’, ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে জিন্নাহর মুখ থেকে এই বাক্য বের হওয়া মাত্র তাতক্ষণিকভাবেই উপস্থিত ছাত্র জনতার প্রতিবাদের মধ্য দিয়েই শুরু হয় ভাষার জন্য সংগ্রাম। এই সংগ্রাম ধীরে ধীরে বিস্তৃত হয় পুরো পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে। রংপুরেও একই সময় থেকে দানা বাঁধতে থাকে রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন, যা অব্যাহত থাকে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না হওয়া পর্যন্ত। ১৯৪৮ থেকে ’৫২ সাল পর্যন্ত রংপুরের ছাত্র সমাজ ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব ধারাবাহিকভাবে মাতৃভাষার দাবিতে আন্দোলন করেছে। এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৫১ সালে রংপুরে ঘটে এক অভূতপূর্ব ঘটনা, আন্দোলনে যা নতুন মাত্রা যোগ করে। সেদিন ছাত্র ছাত্রীদের একটি বিশাল মিছিল বাংলা ভাষার দাবিতে সেøাগান দিতে দিতে পৌঁছে যায় রংপুর জজকোর্ট এলাকায়। মিছিলটি ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ সেøাগান দিতে দিতে মুহূর্তেই ঢুকে যায় আদালত চত্বরে। মুহুর্মুহু সেøøাগান প্রকম্পিত হয়ে উঠে পুরো আদালত ক্যাম্পাস। হঠাৎ করেই মিছিল থেকে এক দুঃসাহসী ছাত্রী সোজা এজলাসে গিয়ে জজ সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে সরাসরি জজ সাহেবকে প্রশ্ন করেন, ‘কেন আপনি ইংরেজীতে লিখছেন’? এই কথা বলে কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই জজ সাহেবের হাত থেকে কলমটি ছিনিয়ে নিয়ে ভেঙ্গে ফেলেন সেই দুঃসাহসী ছাত্রী। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এদিকে এজলাস ত্যাগ করে সেই ছাত্রী ফিরে যান মিছিলে এবং মিছিল আবারও শহরের দিকে যাত্রা করে। দুঃসাহসী সেই ছাত্রী ছিলেন একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে রংপুরের অন্যতম শহীদ, রংপুর শহরের মুন্সীপাড়ার বিখ্যাত কাজী পরিবারের অন্যতম সদস্য শহীদ মিলি চৌধুরী। একজন ছাত্রীর এই সাহস সেদিন রংপুরে ভাষা আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। বায়ান্নর মহান ভাষা আন্দোলনে রংপুরের যে সমস্ত ভাষা সৈনিক সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন তাদের মধ্যে ৫/৬ জন বেঁচে আছেন। যতদূর জানা গেছে, জীবিতদের মধ্যে কেউ কেউ রংপুরের বাইরে বাস করেন। রংপুরের বর্তমান প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও শিক্ষক শাহ আবদুর রাজ্জাক ও শাহ তবিবর রহমান তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ১৯৪৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রংপুর কারমাইকেল কলেজে বিক্ষোভ মিছিল করে ছাত্ররা। তখন থেকেই রংপুরে ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন শাহ আবদুর রাজ্জাক। বর্তমানে তাঁর বয়স ৮৭। বছর খানিক আগে ব্যক্তি এবং রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গী তার স্ত্রী (সাবেক মহিলা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও জেলাপরিষদ প্রশাসক) রেজিনা রাজ্জাকের মৃত্যুর পর পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়েছেন। ছেলেমেয়েরা কেউই কাছে নেই। এখন তিনি বড়ই নিঃসঙ্গ। নগরীর মাহিগঞ্জে নিজ বাসভবনে বয়সের ভারে নুয়ে পড়া শাহ আবদুর রাজ্জাক ভাঙা ভাঙা গলায় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিচারণ করেন। তিনি বলেন, ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট যখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি তখন থেকেই ছাত্র আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ি। ’৫২ সালে কারমাইকেল কলেজের ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র ছিলাম। ১৯৪৮ সালে ইস্ট পাকিস্তান ছাত্রলীগ গঠন করা হয়। কারমাইকেল কলেজের তৎকালীন ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি এবং জেলা কমিটির সদস্য ছিলাম। ১৯৫৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ইস্ট পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কাউন্সিল হয়। সেই কাউন্সিলে সদস্য নির্বাচিত হই। তিনি বলেন, একুশে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় ছাত্র মিছিলের ওপর গুলিবর্ষণের খবর রংপুরে সন্ধ্যার দিকে ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষুব্ধ ছাত্রসমাজ প্রতিবাদে এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রাতেই মিছিল নিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করে। পুলিশের অবিরাম লাঠিচার্জে মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। রংপুরের অনেক তরুণ ছাত্রই সেদিন মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ভাষাসৈনিক শাহ তোফাজ্জল তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তিনি ছিলেন ভাষা আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। ৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ‘কমিটি অব এ্যাকশন’ থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে তাকেসহ অনেককেই পাঠিয়ে দেয়া হয় রংপুর। তিনিসহ সাবেক মন্ত্রী রংপুরের মরহুম মতিউর রহমান, এ্যাডভোকেট আজিজুর রহমান, ইয়াকুব আলী, মাহফুজ আলী, কাজী মুহাম্মদ এহিয়া, মণি কৃষ্ণ সেন, শংকর বসু, শাহ আবদুল বারী, ধীরেন ভট্টাচার্য, জীতেন্দ্রনাথ দত্ত, ইদ্রিস লোহানী, সুফী মোতাহার হোসেন, কছিম উদ্দিন, আমজাদ হোসেন, আজমল হোসেন, আবুল হোসেন, ডা. মোজাহার উদ্দিন, ডা. আবতাব উদ্দীন তালুকদার, ভিখু চৌধুরী, শাহ আবদুল বারী, এ্যাডভোকেট নুরুল হক, দবির উদ্দিন আহম্মদ, খয়রাত হোসেন, নাজিম খন্দকার, আফজাল, আজিজার রহমান, নাজমুল আলম চৌধুরী হেবিন, মতিয়ার রহমান, আজিজুল হক সেলিম, আবদুস সোবহান, কৃষক নেতা দরাজ আলী ও শাহ তবিবর রহমান প্রধান তখন রংপুরের আন্দোলনে পুরোধা হিসেবে কাজ করেছেন। রংপুরে ভাষা আন্দোলনে আরও যারা সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন, তারা হলেন, লে. কর্নেল জাহিদুল হক চৌধুরী, শামসুল হুদা (আবু), নজরুল ইসলাম এ্যাডভোকেট, সিদ্দিক হোসেন, ডা. রোকেয়া আলমগীর রুবি, কমরেড বিনয় সেন, মজিবর রহমান মতি মিয়া, ডা. শোভান খান, ডা. দীনেশ চন্দ্র ভৌমিক (মন্টু ডাক্তার), মকবুল হোসেন, কানু ঘোষ, আফান উল্লাহ, মোসলেম আলী খান, ইব্রাহিম খান সুরুজ, ডা. কবির খান বখতিয়ারি, এ্যাডভোকেট গাজী রহমান, কামরান শাহ আবদুল আউয়াল, অধ্যাপক রেজা শাহ তৌফিকুর রহমান, এ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম, তোজাম্মেল আলী, এ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরী আশরাফ হোসেন বড়দা, তনসিম উদ্দিন আহমেদ মনু ও পানার উদ্দিনসহ নাম না জানা আরও অনেকে। ভাষা আন্দোলনের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে রংপুরের রাজপথে মিছিল করেছিলেন এ আন্দোলনের প্রধান সৈনিক শাহ তবিবর রহমান। পোস্টার লিখে বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় লাগিয়েছিলেন। অধ্যাপক নুরুল ইসলামের সঙ্গে গ্রামে-গঞ্জে গান গেয়ে বেড়িয়েছিলেন। ভাষার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে সাতবার জেলে গেছেন ছাত্র ইউনিয়ন করা এই ছাত্র নেতা। তবিবর রহমানের বাড়ি শহরের গুপ্তপাড়ার নিউক্রস রোডে। এখনও সে বাসাতেই অবসর জীবন যাপন করছেন। তাঁর নেতৃত্বে জিলা স্কুল থেকে মিছিল বের হতো। ৫২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারির কথা। ওইদিন এক বিশাল জনসভা হয় জেলার বদরগঞ্জ থানায়। এর উদ্যোক্তা ছিলেন প্রয়াত কমিউনিস্ট নেতা জিতেন দত্ত। সেই জনসভা চলা অবস্থায় রংপুরের ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক শাহ বারীকে গ্রেফতার করা হয়। শাহ আবদুর রাজ্জাক বলেন, রংপুরে তখন মাইক পাওয়া কষ্টকর ছিল। মাইকের দোকান ছিল মাত্র দুটো। যে কারণে মিছিলে চোঙ্গা ফুঁকতেন তবিবর। এক পর্যায়ে তার নাম হয়ে যায় ‘চোঙ্গা তবি’। তখন দলবদ্ধ হয়ে আড্ডা ও পোস্টার লেখা হতো বর্তমান জিএলরায় রোডের খ্রীস্টানদের কবরস্থানে। এ তথ্যও জেনে যায় পুলিশ। এজন্য প্রায়ই সেখানে হানা দিত তারা। এছাড়া রংপুরের ভাষাসৈনিকরা নিয়মিত ওঠাবসা করতেন নগরীর বর্তমান পায়রা চত্বরের পাশে বর্তমান লুক টেইলার্স ও সাবেক পাকিস্তান বুক হাউসে। সেটি ছিল আওয়ামী লীগ নেতা আবুল হোসেনের অফিস। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সভাপতি ভাষাসৈনিক ডা. মোজাহার উদ্দিনের সিটি ফার্মেসিতেও বসা হতো। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ভাষার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে তিনি সাতবার জেলে গেছেন। ভাষা আন্দোলনের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে রংপুরের রাজপথে মিছিল করেছেন। পোস্টার লিখে তা বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় লাগিয়েছেন। অধ্যাপক নুরুল ইসলামের সঙ্গে গাঁয়ে-গঞ্জে গান গেয়ে বেড়িয়েছেন। তবিবর রহমানের বাড়ি নগরীর গুপ্তপাড়ার নিউ ক্রস রোডে। জন্ম তার ১৯৩৮ সালের পয়লা জানুয়ারি। বাবা শাহ এছহাক প্রধান, মা ফাতেমা খাতুন। ১৯৫৩ সালে রংপুর জেলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা পাস করে রংপুর কারমাইকেল কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন তিনি। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি পড়তেন রংপুর জিলা স্কুলের দশম শ্রেণীতে। অষ্টম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় তিনি এই ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। এত কম বয়সে তার এই আন্দোলনে যুক্ত হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ওই সময় সকলের দাবি ছিল মায়ের ভাষা বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠা করা। কারমাইকেল কলেজ থেকে মিছিল বের হতো। সেই মিছিলটি শহরে আসার পর সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেই বের হওয়া মিছিলগুলো ওই মিছিলে যোগ দিত। ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশসহ তিন দেশের সরকারি ব্যাজ দেখা ক’জনের ভাগ্যে হয়। শেষ বয়সে তার কিছুই চাওয়া পাওয়ার নেই। তবে সরকার যদি ভাষাসৈনিকদের কিছু ভাতা দিত তা দিয়ে নাতি-নাতনিদের চকলেট কিনে দিতাম আর গর্ব করে বলতাম এ টাকা সরকারী টাকা। আমাদের মূল্যায়ন করে সরকার দিয়েছে। কথাগুলো বায়ান্ন সালের রাজপথ কাঁপানো ভাষাসৈনিক শাহ তবিবর রহমানের। নগরীর মুন্সীপাড়ার নিজ বাসভবনে কথা হয় ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আফজাল (সাবেক পৌর চেয়ারম্যন, গণতন্ত্রী পার্টির উপদেষ্টা ম-লীর সভাপতি)’র সঙ্গে। জাতীয় আন্দোলনসহ রংপুরের সকল আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। চির সংগ্রামী, নির্লোভ এ কিংবদন্তী রাজনীতির কারণে সংসারী হননি। নিজ বাড়িতে সম্পূর্ণ একা। বার্ধক্যের কারণে শরীর ভেঙ্গে পড়েছে। ঠিকমতো কথা বলতে পারেন না। চোখে কম দেখেন। কানেও ভাল শুনতে পান না। বাড়ির একটি অংশ ছাত্রদের মেস ভাড়া দিয়েছেন। স্ত্রী-সন্তান না থাকায় ২/১ জন নিকটাত্মীয় আর ওই ছাত্ররাই তার দেখাশোনা করে। রংপুর জেলা স্কুলের ছাত্রাবস্থায় ভাষা আন্দোলনে যোগ দেন তিনি। বয়সে ছোট হলেও প্রতিটি মিটিং মিছিলে তাঁর ছিল উচ্চকণ্ঠ। ছাত্র ইউনিয়নের সুফী মোতাহার হোসেন ও মোহাম্মদ আফজালের নেতৃত্বে ২২ ফেব্রুয়ারি জিলা স্কুলে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে জমায়েত হন। এ সময় রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ওই পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে এলে মিছিলটি জনসমুদ্রে পরিণত হয়। Ñআব্দুর রউফ সরকার, রংপুর থেকে
×