ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ইসি নিয়োগে জনগণের দৃষ্টি এখন সার্চ কমিটির দিকে

প্রকাশিত: ০৫:২০, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ইসি নিয়োগে জনগণের দৃষ্টি এখন সার্চ কমিটির দিকে

শাহীন রহমান ॥ কারা আসছেন নির্বাচন কমিশনে- জনগণের দৃষ্টি এখন সার্চ কমিটির দিকে। বিশেষ করে সার্চ কমিটি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য কমিশনার নিয়োগের জন্য কাদের বাছাই করছেন। রাষ্ট্রপতিই বা কাদের এ পদের জন্য নিয়োগ দিতে যাচ্ছেন। তা নিয়ে এখন সারাদেশে আলোচনা-সমালোচনার ঝড়। এ নিয়ে সাধারণ নাগরিকদেরও আগ্রহের কমতি নেই। বাছাই শেষে আর কয়েক দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতি সিইসি ও চার কমিশনার নিয়োগ দেবেন। ইতোমধ্যে যোগ্য ব্যক্তি বাছাইয়ে কাজ করছে সার্চ কমিটি। নিজেদের মধ্যে তারা তিনটি বৈঠক সেরে ফেলেছেন। সেখানে বিভিন্ন সোর্স থেকে পাওয়া নামের তালিকা বিশ্লেষণ করেছে। এছাড়া এ বিষয়ে মতামত নিয়ে দুই দফায় বিশিষ্টজনদের সঙ্গে বৈঠক সম্পন্ন করেছে। সার্চ কমিটি আগামী ৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ১০ জনের তালিকা রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেয়ার জন্য বলা হয়েছে। সার্চ কমিটির সাচিবিক দায়িত্ব পালন করা মন্ত্রিপরিষদ সচিবের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে সংক্ষিপ্ত নামের তালিকা ধরে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। আগামী সোমবারের মধ্যে তালিকা চূড়ান্ত করতে তারা আরও একটি বৈঠকে বসবেন। এরপরই চূড়ান্ত তালিকা রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেবেন। তবে কাদের নাম পর্যালোচনা করা হচ্ছে বা কারা আসছে কমিশনার হিসেবে তা জানা না গেলেও বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, কয়েকটি বিষয় প্রাধান্য দিয়ে যোগ্য ব্যক্তিদের তালিকা পর্যালোচনা করা হচ্ছে। এর মধ্যে রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে পাওয়া নামের বাইরেও একাধিক নাম নিয়ে পর্যালোচনা করছে সার্চ কমিটি। তবে রাজনৈতিক দল বা অন্যভাবে পাওয়া ব্যক্তিদের নামের তালিকায় থাকা ব্যক্তির যোগ্যতার পাশাপাশি সক্ষমতার বিষয়টির দিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। বিশেষ করে যাকে যোগ্য হিসেবে বিবেচনা করা হবে তাদের প্রশাসন চালানোর মতো সক্ষমতা আছে কিনা তা বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে। এ কারণে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও যাদের বয়স একটু বেশি বিশেষ করে ৭০ ওপরে যাদের বয়স তালিকায় থাকা এমন ব্যক্তিদের নির্বাচন কমিশনের নিয়োগের জন্য বিবেচনা করবে না সার্চ কমিটি। এছাড়া যাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে কোন দলের পক্ষে হয়ে কাজ করার অভিযোগ রয়েছে তাদেরও বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে না। এছাড়া ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক বিষয়াবলী পর্যালোচনা করা হচ্ছে। প্রশাসনিক অভিজ্ঞতার বিষয়টিও আমলে নেয়া হচ্ছে। জানা গেছে, ব্যক্তিগত বা পারিবারিকভাবে ছাত্রজীবনে কোন রাজনৈতিক দলের সমর্থক হলেও চাকরি জীবনে তিনি যদি সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে থাকেন তাহলে তাকে যোগ্য ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হতে পারে। ইতোমধ্যে সার্চ কমিটি রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন মাধ্যম থেকে যোগ্য ব্যক্তিদের তালিকা সংগ্রহ করেছে। তা থেকে সংক্ষিপ্ত নামের তালিকাও তৈরি করা হয়েছে। এখন চলছে ব্যক্তিগত ও চাকরি জীবনের তথ্য উপাত্ত পর্যালোচনা। যদিও রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে ১২৫ নাম জমা দেয়া হলেও বাইরে কোন কোন মাধ্যম থেকে নামের তালিকা সংগ্রহ করা হয়েছে তা সার্চ কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়নি। গণমাধ্যমে রাজনৈতিক দলের দেয়া কিছু নাম আলোচনা এলেও কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে তার সত্যতা স্বীকার করা হয়নি। অপরদিকে নাম পর্যালোচনা নিয়েও সার্চ কমিটি কঠোর গোপনীয়তা বজায় রেখে চলেছে। পত্রিকায় প্রকাশিত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দেয়া ভিন্ন নামের তালিকা প্রকাশ পেলেও গত ১ ফেব্রুয়ারি চার বিশিষ্ট নাগরিকের একজন সমকাল সম্পাদক গোলাম সারোয়ার সার্চ কমিটির সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন বড় দলগুলোর জমা দেয়া নামের মধ্যে দু-একটি নাম অভিন্ন রয়েছে। সার্চ কমিটি সেখান থেকেও যোগ্য ব্যক্তিদের নাম বাছাই করবেন। অপরদিকে রাজনৈতিক দলের পক্ষে কাদের নাম জমা দেয়া হয়েছে সে বিষয়টিও সার্চ কমিটি অত্যন্ত গোপন রেখেছে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব শফিউল আলম এর আগে গণমাধ্যমকে জানান রাজনৈতিক দলের নাম গোপনীয় আমানত। তারা গোপনে এটি জমা দিয়েছেন। তবে তিনি জানান রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে জমা দেয়া নামের মধ্যে অনেক ভাল নাম পাওয়া গেছে। সেখান থেকেও নামের তালিকা পর্যালোচনা করা হচ্ছে। তিনি জানান, রাজনৈতিক দলের তালিকা থেকে ২০ নামের সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এর বাইরে থেকে বিভিন্ন নাম সংযোজন হতে পারে। তবে ৩ ফেব্রুয়ারি বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদের অতিরিক্ত সচিব আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, এখন পর্যন্ত ২০ নামের তালিকা ধরেই বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। সার্চ কমিটির স্বচ্ছতা বজায় রাখতে যাদের নাম বাছাই তালিকা আসবে তা জনসম্মুখে প্রকাশের আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। সার্চ কমিটি যে দশজনের তালিকা দেবে তা যেন জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়। কিন্তু সার্চ কমিটি নাম প্রকাশ নিয়ে সন্দেহের দোলাচালে রয়েছে। এ বিষয়ে কোন আইন না থাকায় সার্চ কমিটির সুপারিশকৃত নাম প্রকাশ করা হবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। এ বিষয়ে সার্চ কমিটি বা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পক্ষ থেকে কিছু জানানো হয়নি। বিশিষ্টজনেরা বলছেন তালিকা প্রকাশ করা হলে এবং সার্চ কমিটির বাছাইকৃত নাম থেকে নিয়োগ দেয়া হলে তা নিয়ে বিতর্ক উঠবে না। যেহেতু এই বিষয়ে কোন আইন নেই এ কারণে রাষ্ট্রপতি বাছাই তালিকা থেকে নিয়োগ দেবে, না বাইরে থেকে কাউকে নিয়োগ দেবেন তাও স্পষ্ট নয়। কারণ সংবিধান অনুযায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার অন্য কমিশনারদের নিয়োগ দেয়ার এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির। এতদিনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে ইসিতে নিয়োগ দেয়া হলেও গতবার থেকে সার্চ কমিটির মাধ্যমে বাছাই করে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। এর আগে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান সার্চ কমিটির ১০ জনের তালিকা থেকে একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য কশিনারদের নিয়োগ দেন। এ বিষয়ে ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ সার্চ কমিটির সঙ্গে বৈঠক শেষে বলেন, আশা করি রাষ্ট্রপতি সার্চ কমিটির সুপারিশকৃত নাম থেকে কমিশনারদের নিয়োগ দেবেন। একই সঙ্গে তিনি বলেন, আগামী নির্বাচন যেহেতু দলীয় সরকারের অধীনে হবে তাই এমন প্রধান নির্বাচন কমিশনার বাছাই করতে হবে যিনি কোন রাজনৈতিক দলের চাপের কাছে নতি স্বীকার করবেন না। আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি বিদায় নিচ্ছে প্রধান নির্বাচন কমিশনাসহ অন্য তিন কমিশনার। এছাড়া আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি বিদায় নেবেন কমিশনার মোঃ শাহ নেওয়াজ। ফলে ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বর্তমান কমিশনের ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশন সচিব। আগামী ১৫ তারিখ থেকে দায়িত্ব নেবেন নতুন কমিশনার। এর আগেই নতুন কমিশনারদের নিয়োগ প্রদান করতে হবে। সার্চ কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ৮ তারিখেই যোগ্য ব্যক্তিদের বাছাই তালিকা রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেয়া হবে। তবে সেই তালিকা প্রকাশ করা হবে কিনা সে সম্পর্কে এখন পর্যন্ত কিছু বলা হয়নি। কমিশন সূত্রে জানা গেছে, স্বাধীনতার পর সাড়ে চার দশকে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেছেন এখন পর্যন্ত ১১ জন। এদের মধ্যে সাতজন ছিলেন সুপ্রীমকোর্টের বিচারক বা সাবেক বিচারক। চারজন ছিলেন সাবেক আমলা। আর তাদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে ছিলেন ২৩ জন। এসব নির্বাচন কমিশনারদের অধীনে দেশে যেমন অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের নজির রয়েছে। আবার ১৫ ফেব্রুয়রি ও ৫ জানুয়ারি মতো নির্বাচনের জন্য সমালোচনা কম হয়নি। সিইসির দায়িত্বে বিচারপতিদের মধ্যে মোঃ ইদ্রিস ও এটিএম মসউদ এবং সাবেক আমলাদের মধ্যে এমএ সাঈদ ও এটিএম শামসুল হুদা পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ করতে পেরেছেন। বর্তমান সিইসি কাজী রকীবউদ্দিন আহমদও এ তালিকায় যুক্ত হচ্ছেন। সামরিক শাসনামলে বিচারপতি এ কে এম নুরুল ইসলাম সিইসি হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন সাড়ে সাত বছর। এইচএম এরশাদের সময়ে বিচারপতি মসউদের অধীনে ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালের সংসদ নির্বাচন হয়। দেশের সপ্তম সিইসি বিচারপতি এমএ আজিজ ২০০৫ সালের ২৩ মে থেকে ২০০৭ সালের ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত ওই পদে ছিলেন। আন্দোলনের মধ্যে মেয়াদ শেষের আগেই তার কমিশনকে বিদায় নিতে হয়েছিল। মোহাম্মদ আবু হেনা সমালোচিত হন ১৯৯৯ সালে টাঙ্গাইল উপ-নির্বাচনের কারণে। বছর খানেকের জন্য সিইসির দায়িত্ব পালন করেন বিচারপতি এ কে এম সাদেক। তার সময়ে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। অপরদিকে বর্তমান সিইসির কাজী রকীবউদ্দিনের সময়েই গত ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন হয়। যে নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি একেবারেই কম। ১৫৪ সদস্য বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। বিচারপতি আব্দুর রউফের সময় হয় পঞ্চম সংসদ নির্বাচন। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের সময়ে সংসদীয় গণতন্ত্রে ফেরার ওই নির্বাচনে বিচারপতি রউফ যেমন প্রশংসা পেয়েছিলেন তেমনি ১৯৯৪ সালে মাগুরা-২ উপ-নির্বাচনের কারণে তাকে হতে হয়েছিল সমালোচিত। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সাড়ে সাত বছর সিইসি ছিলেন বিচারপতি এ কে এম নুরুল ইসলাম। আর বিচারপতি সুলতান হোসেন খান এ দায়িত্বে ছিলেন মাত্র ১০ মাস। ওই সময় এরশাদ সরকারের পতন ঘটে। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তিনটি নির্বাচনই বিশেষজ্ঞদের ভাষায় দেশে দৃষ্টান্তপূর্ণ নির্বাচন। তারা বলেন, আগামী এমন একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার বাছাই করা হবে যিনি চাপের কাছে মাথা নত করবেন না। এমন ব্যক্তিদের বাছাই করার জন্য তারা সার্চ কমিটির কাছে আহ্বান জানান। এখন দেখার বিষয় কে হচ্ছে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা অন্য কমিশনার হিসেবে কাকে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। জনগণের দৃষ্টি এখন সার্চ কমিটি দিকে। কারা কাদেরকে এ পদের জন্য বাছাই করছেন। তাদের ওপর নির্ভর করছেন দেশের গণতন্ত্র।
×