ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পটুয়াখালী থেকে ধান যায়, উত্তরাঞ্চল থেকে চাল আসে

হাত বদলে দাম বাড়ে চালের

প্রকাশিত: ০৬:২৪, ১৯ জানুয়ারি ২০১৭

হাত বদলে দাম বাড়ে চালের

শংকর লাল দাশ, গলাচিপা ॥ ধান উৎপাদনে দক্ষিণের জেলা পটুয়াখালীর অবস্থান প্রায় শীর্ষে। বছরে কেবলমাত্র আমন উৎপাদন হয় ৯ থেকে ১০ লাখ টন। কিন্তু এ বিপুল পরিমাণ ধান থেকে চাল উৎপন্নে নেই ব্যবস্থা। এমনকি এ জেলা থেকে সরকারী উদ্যোগে ধান কেনাতেও নেই আগ্রহ। ফলে দক্ষিণের এ জেলা থেকে উৎপাদিত প্রায় সব ধান চলে যায় উত্তরাঞ্চলে। আবার উত্তরাঞ্চল থেকে সে ধান চালে রূপ নিয়ে চলে আসে পটুয়াখালী জেলায়। আবহমান কালের এ চিত্রের আজও কোন পরিবর্তন হয়নি। এমনকি সীমিতভাবে ধান থেকে চাল উৎপাদনের যে ব্যবস্থা আছে, তাও কাজে লাগানো হচ্ছে না। এছাড়া সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের চালও আসে উত্তরাঞ্চল থেকে। এতে দফায় দফায় ঘটে হাতবদল। ব্যবহার হয় বিভিন্ন ধরনের পরিবহন। এতে দাম বাড়ে চালের। লাভবান হয় মধ্যস্বত্ব¡ভোগীরা। ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষক ও ভোক্তারা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং ধানকল মালিকরা বলছেন, এ অবস্থার পরিবর্তন জরুরী। এতে কৃষক ও ভোক্তার পাশাপাশি সরকারেরও সাশ্রয় হবে ব্যাপক। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসেব অনুযায়ী, পটুয়াখালী জেলায় আবাদি কৃষি জমি রয়েছে ২ লাখ ১৩ হাজার ৬শ’ হেক্টর। চলতি বছর রোপা আমন ধানের চাষ হয়েছে ২ লাখ ১০ হাজার ৩৪০ হেক্টর জমিতে। এতে ৯ লাখ টনেরও বেশি ধান উৎপাদন হয়েছে। এর থেকে চাল উৎপন্ন হবে পাঁচ লাখ ৯১ হাজার ৪৮৭ টন। বিপুল পরিমাণ ধান উৎপাদন হলেও তা ছাঁটাই করে চাল বের করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেই পটুয়াখালী জেলায়। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ কার্যালয় সূত্র জানায়, জেলায় চারটি অটো রাইসমিল ও চাল ছাঁটাইয়ের ছোট ১৩টি হাস্কিং মিল রয়েছে। এ মিলগুলো প্রতিমাসে বড়জোড় সাড়ে ৬ থেকে ৭ হাজার টন ধান ছাঁটাই করতে পারে। পর্যাপ্ত অটো রাইসমিল না থাকায় পটুয়াখালী জেলা থেকে যেমন ধান চলে যাচ্ছে উত্তরাঞ্চলে, আবার ধান ছাঁটাইয়ের যে সীমিত ব্যবস্থা রয়েছে, তাও কাজে লাগানো হচ্ছে। পটুয়াখালীর মিল মালিকদের কাছ থেকে পর্যাপ্ত চাল কেনা হচ্ছে না। ফলে দক্ষিণাঞ্চলের ধানের বাজার নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে উত্তরাঞ্চলের অদৃশ্য সিন্ডিকেট দ্বারা। সিন্ডিকেটের লোকজন যেভাবে নির্ধারণ করে, কৃষকরা সে দরেই ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। পটুয়াখালীর মোকামে চলতি মৌসুমের শুরুতেও ধানের ব্যাপক দরপতন ঘটেছিল সে কারণে, এমন অভিমত কৃষক ও মিল মালিকদের। সরকার পটুয়াখালী অঞ্চল থেকে ধান-চাল কেনায় তেমন আগ্রহ না থাকাতেও মাঝে মধ্যে ঘটছে দরপতন। যেমন চলতি মৌসুমে সরকার পটুয়াখালী জেলা থেকে ধান কিনছে না। এরও বিরূপ প্রভাব পড়ে বাজারে। বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করে পটুয়াখালী সদর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মনিরুল হক জানান, এ বছর চলতি আমন মৌসুমে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনার কোন নির্দেশনা পাওয়া যায়নি। তবে প্রাথমিকভাবে ৫৭২ টন চাল কেনার নির্দেশনা পাওয়া গেছে। পরবর্তীতে কৃষকদের স্বার্থ বিবেচনা করে খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক চাল ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা উন্মুক্ত করেন। এতে করে জেলার মিলাররা অতিরিক্ত ৬ হাজার ৭৪০ টন চাল সরবরাহের চুক্তি করে। ফলে এ জেলা থেকে ৭ হাজার ৩১২ টন চাল কেনা হবে। বাকি প্রয়োজনীয় ২৫ হাজার ৬শ’ দশমিক ৬শ’ মেট্রিকটন চাল উত্তরাঞ্চলের সরকারী খাদ্য গুদাম থেকে সংগ্রহ করা হবে। প্রসঙ্গক্রমে তিনি আরও জানান, পটুয়াখালী জেলা থেকে সরকারীভাবে চাল ক্রয় উন্মুক্ত হওয়ায় মিল মালিকরা কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনতে শুরু করেছে। ফলে ধানের দাম বেড়েছে। স্থানীয় মিল মালিকদের সক্ষমতার ব্যবহার ও সরকারীভাবে ধান কেনা হলে কৃষক ব্যাপক লাভবান হবে, এ তথ্যের সত্যতা স্বীকার করেছেন মিল মালিকরাও। গলাচিপার শাহজালাল অটো রাইসমিলের মালিক সাহেব আলী বলেন, পটুয়াখালী জেলা সর্বোচ্চ ধান উৎপাদন করলেও এ অঞ্চল থেকে সরকার তা সংগ্রহ না করায় কৃষক ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সরকার পটুয়াখালী জেলার অন্তত অভ্যন্তরীণ চাহিদার চাল এ অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করলে, দক্ষিণাঞ্চলের উৎপাদিত আমন ধান দিয়েই তা পূরণ হতে পারে। এতে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ধান বিক্রি করে লাভবান হতে পারবে এবং মিল মালিকরাও ধান কিনে ছাঁটাইয়ের মাধ্যমে চাল সরবরাহ করে লাভবান হবে। কিন্তু এ অঞ্চল থেকে প্রয়োজনীয় চাল সংগ্রহ না করায় মৌসুমের শুরু থেকে উত্তরাঞ্চলের ফড়িয়ারা এখানে এসে সিন্ডিকেট করে কম দামে ধান কিনে নিয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন গড়ে কমপক্ষে এক শ’ ট্রাক ও বহু সংখ্যক কার্গো এবং ট্রলার এ অঞ্চল থেকে ধান বোঝাই করে উত্তরাঞ্চল চলে যাচ্ছে। ফলে এ অঞ্চলের শুধু কৃষকরাই নয়, মিল মালিকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জেলার কলাপাড়ার মমতা অটো রাইসমিলের মালিক মোঃ রুহুল আমিন জানান, তাদের মিলের ছাঁটাই চাল ভাল মানের। সরকারীভাবে এ এলাকা থেকে চাল সংগ্রহ করা হলে একদিকে যেমন জেলার অটো রাইসমিলগুলো পুরো মৌসুম সচল থাকবে। তেমনি নতুন নতুন অটো রাইসমিল স্থাপন হবে। এতে ব্যাপক কর্মসংস্থানের পাশাপাশি এলাকার চাল দিয়েই জেলার চাহিদা পূরণ হবে। বার বার হাতবদল ও পরিবহনে বাড়বে না ব্যয়। এতে কৃষকরাও ন্যায্য দামে ফসল বিক্রি করে লাভবান হতে পারবেন। মিল মালিকরা খোলাবাজার থেকে ধান কেনা শুরু করায় এরই মধ্যে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। বাজারে ধানের দাম মণপ্রতি এক থেকে দেড় শ’ টাকা বেড়েছে। ভেঙে পড়তে শুরু করেছে অদৃশ্য সিন্ডিকেট। এতে কৃষকরা যথেষ্ট খুশি। পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার চরমোন্তাজের কৃষক জাহাঙ্গীর হাওলাদার জানান, মৌসুমের শুরুতে বাজারে ৫৬০ টাকা থেকে ৫৮০ টাকা দরে প্রতিমণ ধান বিক্রি করতে হয়েছে তাদের। এতে তাদের লোকসান গুনতে হয়েছে। এখন স্থানীয় অটো রাইসমিলের মালিকরা ধান কেনা শুরু করায় প্রতিমণ এক থেকে দেড় শ’ টাকা বেড়েছে। একই এলাকার কৃষক আনোয়ার হোসেন জানান, তিনি হাজার মণেরও বেশি ধান পেয়েছেন। দাম কম থাকায় তিনি চোখে সরষে ফুল দেখতে শুরু করেছিলেন। তার অনেক লোকসান হতো। কিন্তু এখন সে দুর্ভাবনা কেটে গেছে। তবে মিল মালিকরা আরও ধান কিনলে কৃষকরা আরও লাভবান হবে বলেও মনে করেন তিনি। কয়েক কৃষক একইভাবে তাদের খুশির অভিমত জানিয়েছেন এবং তারা আরও অটো রাইসমিল স্থাপনে সরকারকে এগিয়ে আসার পরামর্শ দিয়েছেন। পটুয়াখালীর অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণেও জেলার ধান বা চাল ব্যবহার হচ্ছে না, এটিও এলাকার ধান-চালের বাজারের একটি বড় সমস্যা। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে জানা গেছে, সরকারী প্রতিষ্ঠান যেমন পুলিশ, আনসার, ফায়ার সার্ভিসে কর্মরতসহ ভিজিডি, ভিজিএফ, ওএমএসসহ সরকারের বিশেষ প্রকল্পে জেলায় চাহিদা রয়েছে ১৫ হাজার ২শ’ টন চাল।
×