ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব

দর্শকের অপেক্ষায় শুরু, অপূর্ণতা নিয়েই শেষ হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ১৯ জানুয়ারি ২০১৭

দর্শকের অপেক্ষায় শুরু, অপূর্ণতা নিয়েই শেষ হচ্ছে

মোরসালিন মিজান ॥ সিনেমার পোকা ছিল বাঙালী। এই তো সেদিনের কথা, লুকিয়ে হলেও ‘বই’ দেখেছেন দর্শক। প্রেক্ষাগৃহের সামনে জটলা লেগেই থাকত। কাউন্টারের সামনে লম্বা সময় দাঁড়িয়ে থেকেও অনেকে টিকেট সংগ্রহ করতে পারতেন না। নতুন দেখা সিনেমার গল্প, নায়ক নায়িকার অভিনয় ইত্যাদি নিয়ে কথা যে শুরু হতো, শেষ হতে চাইত না। আর চলচ্চিত্র উৎসব মানে তো দারুণ এক হৈ চৈ। আগে ভাগেই শুরু হয়ে যেত আলোচনা। দেশ-বিদেশের উল্লেখযোগ্য ছবির খোঁজ করতেন সবাই। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-পরিজন মিলে পছন্দের চলচ্চিত্র দেখতেন। হায়, আজ অনেক কিছুই আগের মতো নেই! সর্বশেষ উদাহরণ হতে পারে ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের পঞ্চদশ আসরটি। ১৯৯২ সাল থেকে উৎসবের আয়োজন করে আসছে রেইনবো ফিল্ম সোসাইটি। সেই ধারাবাহিকতায় এবারের আয়োজন। যথেষ্ট বড় এবং সমৃদ্ধ। কিন্তু দর্শক নেই। শুরুটা হয়েছিল এই আশায় যে, একটু দেরি করে হলেও দর্শক পাওয়া যাবে। অপেক্ষায় ছিলেন আয়োজকরা। কিন্তু বুধবার পর্যন্ত পরিস্থিতির কোন পরিবর্তন হয়নি। অপেক্ষায় শুরু হয়েছিল। শেষও হচ্ছে অপেক্ষায় থেকে। ‘নান্দনিক চলচ্চিত্র, মননশীল দর্শক, আলোকিত সমাজ’ স্লোগানে গত ১২ জানুয়ারি শুরু হয় উৎসব। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে একাধিক মন্ত্রীসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। জাদুঘরের ভেতরের অংশ তো বটেই, বহিরাঙ্গন পর্যন্ত চমৎকার করে সাজানো হয়েছিল। দেশ-বিদেশের বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতাদের প্রতিকৃতি পতাকা ইত্যাদি জানান দিচ্ছিল বর্ণাঢ্য আয়োজনের শুরু হয়েছে। একইরকম বার্তা দেয় সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগারের সাজানো আঙিনা। চত্বরের বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করা হয় উৎসব অফিস, ইনফরমেশন সেন্টার ইত্যাদি। এখানে আছে দেশী-বিদেশী নির্মাতাদের প্রতিকৃতি। সমকালীন ও মেধাবী পরিচালকরা এসেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে। কিন্তু নেই দর্শক। জানা যায়, গণগ্রন্থাগার ও জাদুঘর মিলনায়তন ছাড়াও প্রতিদিন প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হচ্ছে আমেরিকান কালচার সেন্টার, আলিয়ঁস ফ্রঁসেস, স্টার সিনেপ্লেক্সসহ ঢাকার মোট ৬টি ভেন্যুতে। জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তন ও গণগ্রন্থাগারের শওকত ওসমান মিলনায়তনে প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে শুরু হচ্ছে প্রদর্শনী। চলছে সন্ধ্যায় ৭টা পর্যন্ত। এ সময়ের মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আলিয়ঁস ফ্রঁসেসে সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হচ্ছে একাধিক প্রদর্শনী। আমেরিকান সেন্টারে সকাল ১০টা থেকে প্রদর্শনী শুরু হয়ে চলছে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। ৬৭টি দেশের ১৮৭টি চলচ্চিত্র নিয়ে উৎসব। এশিয়ান কমপিটিশন, রেট্রোস্পেকটিভ, সিনেমা অব দ্য ওয়ার্ল্ড, চিল্ড্রেন্স ফিল্মস, স্পিরিচুয়াল ফিল্মস, শর্ট ও ইন্ডিপেনডেন্ট ফিল্মস, নরডিক ফিল্ম এবং উইমেন্স ফিল্মমেকারস বিভাগে প্রদর্শিত হচ্ছে নির্বাচিত চলচ্চিত্র। আছে রেট্রোস্পেকটিভ বিভাগ। এ বিভাগের ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে খ্যাতিমান ইরানি পরিচালক প্রয়াত আব্বাস কিয়ারোস্তামি এবং স্বনামধন্য তুর্কি নারী চলচ্চিত্র নির্মাতা ইয়াসিম ইয়াস্তাওগলুর চলচ্চিত্র। আব্বাস কিয়ারোস্তমির ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘ক্লোজআপ’, ‘টেস্ট অব চেরি’, ‘দ্যা উইন্ড উইল ক্যারি আস’, ‘দ্যা সার্টিফাইড কপি’ ও ‘লাইক সামওয়ান ইন লাভ’। ইয়াসিম ইয়াস্তাওগলু নির্মিত ছবি রয়েছে ৫টি। অধিকাংশ চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী এরই মাঝে অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দর্শক সমাগম যৎসামান্য। এই ধরনের যে কোন উৎসবে দর্শকের বিশেষ পছন্দ জাতীয় গণগ্রন্থাগারের শওকত ওসমান স্মৃতি মিলনায়তন। এর পরপরই জাদুঘরের মূল মিলনায়তন। গত কয়েকদিন ভেন্যু দুটি ঘুরে দেখা যায়, এক রকম বিরান ভূমি। গণগ্রন্থাগার চত্বরটি বলা চলে ফাঁকা পড়ে আছে। উৎসবের কোন আমেজ নেই। বিভিন্ন বুথের সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও পাওয়া গেল না কোন দর্শক। তবে আয়োজনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের একজন রুহুল আমিন জানান, হলে ছবি চলছে। মোটামুটি আছে দর্শক। জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে বিকেলে গিয়ে দেখা যায়, অভিন্ন দৃশ্য। বিশাল মিলনায়তন। দর্শক সেই তুলনায় হাতেগোনা। একটি দুটি প্রদর্শনীর বেলায় নয়, অধিকাংশ প্রদর্শনীর বেলায় ঘটছে এমন ঘটনা। কেন এই অবস্থা? এত বড় একটি আয়োজন। দেশ-বিদেশের ছবি দেখার সুযোগ। কেন কাজে লাগাচ্ছেন না দর্শক? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে নানা রকমের বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়। একেকজন একেকভাবে কারণ ব্যাখ্যা করেন। তবে মূল কারণটি বোধহয়Ñ পরিবর্তিত সময়। বদলে যাওয়া সময়ের সঙ্গে পেরে ওঠছে না এমনকি চলচ্চিত্রের আন্তর্জাতিক উৎসব। অবশ্য আয়োজকদের সীমাবদ্ধতাও কম নয়। অনেকের অভিযোগ, উৎসবটিকে সকলের করতে তেমন কোন কাজ করেন না আয়োজকরা। কর্মী অনেক। কিন্তু প্রয়োজনীয় অনেক তথ্যই তারা দিতে পারেন না। প্রচারের দিক থেকেও পিছিয়ে থাকেন। অবশ্য আয়োজকরা সবকিছু ইতিবাচকভাবেই দেখছেন। উৎসব প্রসঙ্গে আয়োজনের সঙ্গে থাকা পরিচালক সামিয়া জামান বলেন, সীমাবদ্ধতা আছে। থাকবে। তবু এত বছর ধরে তো একটি উৎসব আয়োজন করা হচ্ছে। এটা কম কথা নয়। বাইরের দেশের পরিচালকরা আয়োজনটির প্রশংসা করছেন। ভবিষ্যতে উৎসবটিকে আরও সফল করতে কাজ করা হবে বলে জানান তিনি। নয়দিনব্যাপী উৎসব আগামীকাল শুক্রবার শেষ হচ্ছে।
×