ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রংপুর ও দিনাজপুর জেলার কমান্ড এরিয়া বাদ রেখে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে মাত্র ৮ হাজার হেক্টর জমিতে

স্বল্প পানির ওপর ভর করে তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পে সেচ শুরু

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ১৬ জানুয়ারি ২০১৭

স্বল্প পানির ওপর ভর করে তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পে সেচ শুরু

তাহমিন হক ববি, তিস্তা ব্যারাজ থেকে ॥ তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি থমকে রয়েছে। এ অবস্থায় স্বল্প পানির প্রবাহের ওপর ভর করে রবিবার হতে চলতি খরিপ-১ মৌসুমে (বোরো) তিস্তা ব্যারাজের মাধ্যমে সেচ কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। তবে এবার রংপুর ও দিনাজপুর জেলার কমান্ড এলাকাকে সেচ সুবিধা থেকে বাদ রেখে সেচ প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বোরো আবাদের মুখ্য সময়ে কমান্ড এলাকায় কি পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে এ নিয়ে সংশ্লিষ্টরা পড়েছে বিপাকে। কয়েকদিন আগেও নদীর পানি প্রবাহ প্রায় আড়াই হাজার কিউসেক থাকলেও তা রবিবার মাত্র ৮শ’ কিউসেকে নেমে এসেছে। নির্ভরযোগ্য সূত্র মতে, সম্ভাবনা জাগিয়েও বার বার থেমে থাকছে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি। চুক্তি না থাকায় বিগত সময়ের মতো এবারও চলতি মৌসুমে নদীর পানি হ্রাস পেয়ে চলেছে। ফলে তিস্তা ধু ধু বালুচরে পরিণত হচ্ছে। সংশিষ্টরা বলছেন, ২০১৪ সালে এই মৌসুমে নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ৬৫ হাজার হেক্টরে সেচ সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। সেচ দেয়া হয় মাত্র ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে। ২০১৫-১৬ সালে সেচ প্রদান করা হয় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে। তিস্তা নদীর পানিপ্রবাহ দিন দিন কমতে থাকায় এবার মাত্র ৮ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে দিনাজপুর ও রংপুরের কমান্ড এলাকা সেচ কার্যক্রম থেকে বাদ দিয়ে শুধু নীলফামারীর ডিমলা, জলঢাকা, সদর ও কিশোরীগঞ্জ উপজেলাকে সেচের আওতায় রাখা হয়েছে। এর মধ্যে নীলফামারী সদরে আট শ’ হেক্টর, ডিমলা উপজেলার ৫ হাজার হেক্টর, জলঢাকা উপজেলায় ২ হাজার হেক্টর, কিশোরীগঞ্জ উপজেলায় ২০০ হেক্টর। তবে উজানের প্রবাহ পাওয়া গেলে সে ক্ষেত্রে সেচের জমির পরিমাণ বৃদ্ধি করা যেতে পারে বলে জানা গেছে। কৃষকরা বলছে, তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্প এলাকায় চলতি মৌসুমে বোরো আবাদ এখনও পুরোদমে শুরু হয়নি। জমি তৈরি থেকে চারা রোপণ এবং আবাদ চলমান পর্যন্ত প্রচুর সেচের প্রয়োজন হয়। এখন তিস্তায় পানি নেই। তাই সেচ প্রকল্পের সেচের আশা বাদ দিয়ে নিজেরা সেচ যন্ত্র (স্যালো) ব্যবস্থা করতে বাধ্য হয়েছে। ডিমলা উপজেলার নাউতরা ইউনিয়নের সাতজান গ্রামে তিস্তা সেচ প্রকল্পের প্রধান খালের পাশের কৃষক সাইদুর রহমান অভিযোগ করেন, উজানের প্রবাহ না থাকায় তিস্তা সেচ প্রকল্প আগের মতো পানি দিতে পারে না। ফলে নিজস্ব সেচ যন্ত্র দিয়ে এক বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করতে খরচ হবে ৫ হাজার টাকা। তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্পের সম্প্রসারণ কর্মকর্তা রাফিউল বারী জনকণ্ঠকে জানান, চলতি রবি ও খরিপ-১ মৌসুমে রবিবার থেকে সেচ প্রদান শুরু করা হয়। শুরুতে সেচ দেয়া হয়েছে জলঢাকা উপজেলার হরিশচন্দ্রপাট এলাকায়। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী সেচ প্রদানের চেষ্টা করা হবে। তিনি বলেন, উজানের প্রবাহ দিন দিন কমে আসায় তিস্তা নদীর শুকিয়ে যাচ্ছে। ফলে তিস্তা ব্যারাজের কমান্ড এলাকায় সম্পূরক সেচ কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের উত্তরাঞ্চলীয় পরিমাপ বিভাগ সূত্র জানায়, শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানি কমবে বাড়বে এটি স্বাভাবিক বিষয়। তারপরও তিস্তার পানি প্রবাহ রেকর্ড পরিমাণ কমছে। নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ধরে রাখতে তিস্তা ব্যারাজের সেচ প্রকল্পের জন্য ১০ হাজার কিউসেক পানি প্রয়োজন। উল্লেখ্য, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের মধ্যে যে কয়টি বিষয় নিয়ে খুব বেশি টানাপোড়েন চলছে, তার মধ্যে তিস্তা বড় ইস্যু। উত্তরাঞ্চলের কৃষি ও মৎস্য উৎপাদন তিস্তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিশেষ করে তিস্তা অববাহিকার ৫ হাজার ৪২৭ গ্রামের মানুষ তাদের জীবিকার জন্য এই নদীর ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। তাই তিস্তার পানির প্রবাহ কমে যাওয়া তাদের জীবন ও জীবিকায় আঘাতস্বরূপ। তিস্তা অববাহিকার ৮ হাজার ৫১ বর্গকিলোমিটার এলাকা ভারতের পাহাড়ী অঞ্চলের মধ্যে পড়েছে। আর সমতল ভূমিতে তিস্তা অববাহিকার পরিমাণ ৪ হাজার ১০৮ বর্গকিলোমিটার, যার প্রায় অর্ধেক অংশ পড়েছে বাংলাদেশের সীমানায়। দুই দেশই তিস্তা পানির সর্বোত্তম ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন সময়ে নদীর ওপর ও আশপাশে ব্যাপক অবকাঠামো তৈরি করেছে। ভারত এই মুহূর্তে জলবিদ্যুত উৎপাদন ও সেচ কার্যক্রমের জন্য তিস্তার পানি ব্যবহার করছে, অন্যদিকে বাংলাদেশ তিস্তা পানি ব্যবহার করছে শুধু পরিকল্পিত সেচ দেয়ার কাজে। গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে, বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে ভারতের একচেটিয়া পানি প্রত্যাহারের কারণে বাংলাদেশ অংশে তিস্তার পানি ক্রমাগত কমে গেছে। এতে তিস্তার ওপর নির্ভরশীল উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ১২ উপজেলা যেমনÑ ডিমলা, জলঢাকা, কিশোরীগঞ্জ, নীলফামারী সদর, সৈয়দপুর, রংপুর সদর, তারাগঞ্জ, বদরগঞ্জ, গঙ্গাচরা, পার্বতীপুর, চিরিরবন্দর ও খানসামা, যারা তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পের মাধ্যমে সরাসরি জমিতে সেচ সুবিধা পেয়ে থাকে, তাদের কৃষি উৎপাদন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। তিস্তার পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় বাংলাদেশ শুধু শুষ্ক মৌসুমে বোরো উৎপাদনের ক্ষেত্রে মারাত্মভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৯৭ সালে বাংলদেশে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় পানির প্রবাহ ছিল প্রায় ৬ হাজার ৫০০ কিউসেক, যা ২০০৬ সালে নেমে আসে ১ হাজার ৩৪৮ কিউসেকে এবং ২০১৩ সালের পর শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ এসে দাঁড়ায় মাত্র ৭০০ হতে ৫০০ কিউসেক। যেহেতু তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পের আওতাভুক্ত এলাকায় নদীর পানি ছাড়া অন্য কোন সেচের ব্যবস্থা নেই, তাই প্রতিবছরই বিস্তীর্ণ জমিতে চাষাবাদ করা যাচ্ছে না। ২০০৬-০৭ অর্থবছর থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তিস্তা নদীতে পানির সঙ্কটের কারণে সর্বমোট ৫০ লাখ ৮৪ হাজার ২৩৬ টন বোরো ধান উৎপাদন করতে পারেনি কৃষক। যার বাজারমূল্যে প্রায় ১১০০ কোটি টাকার ওপরে। যা নিঃসন্দেহে আমাদের জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারত। এছাড়া তিস্তার পানি শূন্যতায় ক্ষতি হচ্ছে তিস্তা অববাহিকার প্রকৃতি ও পরিবেশ। ২০০৫-২০১৬ সাল পর্যন্ত এই ১২ বছরের মধ্যে সাত বছরই শুকনো মৌসুমে তিস্তা নদীতে কার্যত কোন পানি ছিল না। অর্থাৎ শুকনো সময়ে ভারতের প্রত্যাহারের পর যে সামান্য পরিমাণ পানি তিস্তা নদীতে পাওয়া যায়, তার সবটুকুই সেচ চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পের মাধ্যমে কয়েক শ’ সেচ খালের মাধ্যমে কৃষিজমিতে সরবরাহ করা হচ্ছে। এর দরুণ ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা ব্যারাজের ভাটি অঞ্চল থাকছে পানি শূন্য। এ কারণে তিস্তা ব্যারাজ এলাকার পর শুকনো মৌসুমে এভাবেই নদী মারা যাচ্ছে। যেহেতু তিস্তা নদী উত্তরাঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে, তাই যমুনা নদীর পানির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তিস্তা থেকেও বাহিত হয়। তিস্তা যখন শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে, তখন যমুনায়ও পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে।
×