ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এএইচএম নোমান

আশাপুরের ফিরোজার ‘মুক্তি’র শক্তি

প্রকাশিত: ০৬:১৭, ৬ জানুয়ারি ২০১৭

আশাপুরের ফিরোজার  ‘মুক্তি’র শক্তি

‘‘...এই সুন্দর পৃথিবীতে মানুষের জীবন বড়ই ক্ষণস্থায়ী। ঐ ক্ষণস্থায়ী জীবনের কত স্বপ্ন, কত আশাই না মনের মধ্যে ঘুরপাক খায়। সাফল্যের পুষ্প পল্লবে মানুষ ভরে দিতে চায় তার জীবন। কারও স্বপ্ন জীবনে বাস্তবায়িত হয় আবার কারও কারও স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দেয়ার জন্য দরকার একটি স্থির লক্ষ্য। লক্ষ্যই সাফল্য স্থাপন করে।’ (আশাপুরের ফিরোজা : নারীর জ্বালা নারী জানে ১৫.০৭.২০০৭)। অনানুষ্ঠানিক কিছু লেখাপড়া জানা আশাপুরের ফিরোজা এক হতভাগী মা। দীর্ঘ ৯ বছর পর যমুনা রেলসেতু লিংক প্রকল্পের দু’পাশে সৃজিত গাছের মূল্য বণ্টন ও হস্তান্তর অনুষ্ঠানে কালিয়াকৈর উপজেলা হলে গত ০৪/০৯/২০১৬ তারিখে গেলে, সেখানে স্থানীয় সহকর্মী ‘দিশারী’র মতিউর রহমানকে দিয়ে ফিরোজাকে খবর দিলে সে উপস্থিত হয়। বলেছিলাম আমার জন্য আবার একটা লিখা আনতে। ইউএনও মোহাম্মদ সানোয়ার হোসেন’র অফিস কক্ষে দেখা হলে পাশে বসা ছোট্ট মেয়েটি বলে ‘মা, স্যারকে তোমার লিখা চিঠিটা দিবে না? এ কথা বলে মেয়েটিই চিঠিটা দিল। মা পাশ থেকে বলল, ‘ওর জন্যই মাতৃত্বকালীন ভাতা পেয়েছি, এখন ও ক্লাস ফোর এ পড়ে। তৃপ্ত বোধ করলাম। তার আনা ২নং চিঠি থেকে বিজয়ের মাসে পাঠকদের জন্য কিছু উদ্ধৃতি দিলাম...অনেক অভাবের মধ্যে দিয়েও আমি আমার দুটি মেয়েকে লেখা পড়া শিখাইতেছি। রাত শেষ হবে কবে। ঘরেতে অভাব। পৃথিবীটা তাই মনে হয় বড় অসহায় জেনেছি। সত্যি হলো এক ধরনের বিশ্বাস যা বহুদিন পর মনের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলাম আমি। সে বিশ্বাসটি হলো, মানুষের ‘মুক্তি’র পথ জনগণের মাঝেই মিশে আছে। জনগণ বলতে সাধারণ খেটে খাওয়া, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষকে বোঝানো হয়। সেই জনগণের ভেতর থেকেই ‘মুক্তি’র সোপান বেড়িয়ে আসবে।... এই সভ্যতা গড়ে উঠেছে শ্রমজীবী ও মেহনতি মানুষের পরিশ্রমের কারণে। যেখানে লক্ষ হাত আপনাদের মতো মানুষেরা বাড়িয়ে দেন, সেখানে সৃষ্টির নতুন পথ হয় রচিত। যে মানুষ দুঃস্বপ্নের মধ্যেও দিন রাত কাজ করে, যারা শত বাধাকে উপেক্ষা করে মা-মাটির টানে দেশের হিতার্থে কাজে এগিয়ে আসে, তারাই প্রকৃত মানুষ। সেই শ্রমজীবী মেহনতি সাধারণ মানুষের কাতারে মিশে গেলেই জীবনে প্রকৃত আনন্দ পাওয়া সম্ভব। আমি মনে করি এটাই ‘মুক্তি’র মৌল সত্য।”... এবারের বিজয়ের মাসের প্রথম সপ্তাহে গত ৩ ডিসেম্বর ঢাকাস্থ বিশ্ব সাহিত্য কেদ্রে ‘মা স্বপ্ন ফাউন্ডেশন’র উদ্যোগে ‘জায়াপতি’ সম্মাননা প্রাপ্ত অন্যতম ফিরোজা যা বলেন, ‘র্ডপ প্রথম যখন ২০০৫ সালে বিশ্ব মা দিবস উপলক্ষে নিজস্ব উদ্যোগে মাসে ১০০ টাকা করে মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রদান শুরু করে। আমি দ্বিতীয় গর্ভধারণের বেলায় সেই মাতৃত্বকালীন ভাতা পেয়েছি। ভাতার টাকা দিয়ে আমি ও আমার শিশু পুষ্টিকর খাবার খেয়েছি। যে কারণে আমার দুটি মেয়ে সন্তান পুষ্টিসম্পন্ন অবস্থায় আছে। আমি গর্ভকালীন অবস্থায় কোন পুষ্টিকর খাবার খেতে পেতাম না যদি আমাকে মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রদান না করত। আমার পরিবার অতি দরিদ্র। নিজের কোন ঘর বাড়ি নেই, কোন সম্পদ ও পুঁজি নেই। আমি ‘স্বপ্ন প্যাকেজ’ প্রকল্পের সহযোগিতা পাইনি, পেলে নিশ্চয়ই পারিবারিক অবস্থার উন্নতি করতে পারতাম। সরকারের কাছে আকুল আবেদন আমাকে ও আমাদের মতো গরিব মা’দের জন্য ‘স্বপ্ন প্যাকেজ’ সারাদেশে চালু করুন। আমি জন্ম নিয়ন্ত্রণের স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণ করেছি। প্রথম সন্তান ৯ম শ্রেণীতে এবং দ্বিতীয় সন্তান প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৪র্থ শ্রেণীতে পড়ছে। আমার দুটি গাভী রয়েছে যা অন্যের কাছ থেকে বর্গা নিয়ে লালন পালন করছি। আমার স্বামী একজন কৃষক, নিজের জমি নেই, অন্যের জমিতে কাজ করে। দু’জন মিলে মাসে গড়ে প্রায় ৮০০০ টাকা আয় করি। তা থেকে সংসার পরিচালনা করি এবং মেয়ে দুটির লেখাপড়ার পিছনে খরচ করি।’ সর্বশেষ গত ১০ ডিসেম্বর ২০১৬ আমার সহকর্মী আবদুল মালেকের সঙ্গে তার জীবন রচনা নিয়ে কালিয়াকৈর নার্সারী ঘরে এবার ফিরোজা তার নিজ থেকেই আমার কাছে তৃতীয় পত্রটি লিখে। এ চিঠিকে ভীত ধরেই আমার লিখার শিরোনাম ‘ফিরোজার মুক্তি’র শক্তি কথা। আমার উপলদ্ধির তৃষ্ণার ভাগীদার ফিরোজা এ চিঠিতে যা লিখেছে ‘মনের দুঃখ মনে লইয়া, ঘুরি বনে বনে। বৃক্ষের কাছে কইলে দুঃখ, বৃক্ষ যায় ঝড়ে। নদীর কাছে কইলে দুঃখ, জলে যায় ভেসে। দুঃখ বলব কার কাছে। বাড়ির শোভা বাগ বাগিচা, নারীর শোভা স্বামী। গাছের শোভা উঁচু ডালা, মাছের শোভা পানি। সরকারের শোভা জনগণ। আমরা জনগণ যদি এক থাকি তা হলে এই সুন্দর বাংলাদেশকে অভাব ‘মুক্ত’ করতে পারি। যদি সরকার থাকে পাশে। এস সবাই শপথ করি। বাংলাদেশকে অভাব ‘মুক্ত’ করি। আমাদের যার যতটুকু জমি আছে সেই জায়গায় বৃক্ষ রোপণ করি। আজকে শিশু যেমন আগামী দিনের ভবিষ্যত, তেমনি গাছও আমাদের জীবনের ভবিষ্যত। গাছ থেকে আমরা অক্সিজেন পাই। একটি গাছ মানুষের অনেক উপকার করে। একটি ভাল ফলের গাছ কিন্তু একটি সংসারে চাহিদা মিটাইতে পারে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু দেশের জন্য লড়াই করে দেশকে স্বাধীন করেছেন এবং বাংলা ভাষার জন্য যুদ্ধ করেছেন। তাহলে আমরা সন্তান হয়ে, আমরা কেন বাংলাদেশকে অভাব ‘মুক্ত’ করতে পারি না? কষ্ট মানুষকে পরিবর্তন করে, কষ্ট মানুষকে শক্তিশালী করে। জয় বঙ্গবন্ধ,ু জয় শেখ হাসিনা। ইতি, ফিরোজা, স্বামী : মজনু মিয়া, গ্রাম: আশাপুর, ইউনিয়ন : তালজোড়া, পোঃ নৈহাটি বাজার, থানা: কালিয়াকৈর, জেলা: গাজীপুর। ০১৮৮১৪৯৬৯২৮। প্রিয় পাঠক বিজয়ের এ মাসে ফিরোজার ‘মুক্তি’র এই প্রশ্নবোধক আহ্বানের উত্তর এসডিজি’র ১৭ এজেন্ডাকে, উন্নয়নের তলরেখা ‘মা’ কেন্দ্রীক ‘একের ভেতর সতের’তে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আবাসন, কর্মসংস্থান, পরিবেশ ইত্যাদি চাহিদা সংবলিত স্বপ্ন প্যাকেজ বাস্তবায়ন করে দুনিয়াকে দারিদ্র্য বিমোচনের মুক্তির শক্তির কথা শুনাতে পারলেই বিজয়ের মুক্তির সাক্ষাত মিলবে।
×