ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

আট মুক্তিযোদ্ধা ও ২১ মিত্রবাহিনীর সদস্যসহ ওই যুদ্ধে শহীদ ২৯ জন ॥ বললেন গেরিলা কমান্ডার আবদুর রব

সীমান্তের তেলিখালি ক্যাম্প আক্রমণে খতম হয় ১২৪ পাকসেনাসহ ২৩৩

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৬

সীমান্তের তেলিখালি ক্যাম্প আক্রমণে খতম হয় ১২৪ পাকসেনাসহ ২৩৩

বাবুল হোসেন, ময়মনসিংহ ॥ ৩ নবেম্বর, ১৯৭১। ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে ভারত সীমান্তে পাকসেনাদের শক্তিশালী ক্যাম্প তেলিখালির দখল নিতে গুলিবর্ষণ ও গ্রেনেড চার্জ করে ১২৪ পাকসেনাসহ রাজাকার ও রেঞ্জার ২৩৩ জনকে খতম করি। মাত্র ৫ ঘণ্টার সফল অপারেশনে ৮ বীর মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর ২১ সহ ২৯ বীর এই যুদ্ধে শহীদ হন। এতে আহত হন মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর অর্ধশত। মিত্রবাহিনীর কর্নেল রঘুবন সিংহ ও মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার প্রয়াত আবুল হাশেম এই অপারেশনের নেতৃত্ব দেন। গেরিলারা পাঁচটি গ্রুপে ভাগ হয়ে আটটি কাটঅফ পার্টির সহায়তায় পরিকল্পিতভাবে তেলিখালি ক্যাম্পের পাকসেনাদের ওপর তিনদিক থেকে একযোগে আক্রমণ চালাই। বিজয়ের মাসে জনকণ্ঠের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় ময়মনসিংহের গেরিলা কমান্ডার আব্দুর রব এভাবেই তুলে ধরছিলেন সম্মুখযুদ্ধের বীরত্বগাথা। তিনি ছিলেন তেলিখালির এই অপারেশনের গ্রুপ কমান্ডার। জানান আরও কয়েকটি সম্মুখযুদ্ধের খুঁটিনাটি। গেরিলা কমান্ডার আব্দুর রবের ভাষ্যমতে, একাত্তরের ২৩ এপ্রিল ময়মনসিংহের পতন হলে স্থানীয় রাজাকার ও আলবদরদের সহায়তায় পাকসেনারা ময়মনসিংহে ভারত সীমান্তজুড়ে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তোলে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সেনাক্যাম্প ছিল হালুয়াঘাটের তেলিখালি বিওপি। তেলিখালি ক্যাম্প ধ্বংস করা গেলে হালুয়াঘাট থেকে ময়মনসিংহ হয়ে ঢাকা বিজয় সহজ হবে। মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর সমন্বিত পরিকল্পনা অনুযায়ী অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে রেকি চলে তেলিখালির চারপাশে। রেকি শেষে পরিকল্পনা হয় উত্তরপাশের ভারতের দিক বাদ রেখে বাকি তিনদিক থেকে তেলিখালির পাকসেনার ক্যাম্পে আক্রমণ করা হবে। গঠন করা হয় আটটি কাটঅফ পার্টি। মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে আলফা, ব্রেভো, চার্লি, ডেলটা ও এডফ এই সাংকেতিক নামে পাঁচটি গ্রুপ গঠন করা হয়। আলফা গ্রুপের প্রধান ছিলেন হালুয়াঘাটের নুরুল ইসলাম, ব্রেভোর ময়মনসিংহের কচিঝুলির আতাউদ্দিন শাহ, চার্লির ফুলপুরের ইপিআর হাবিলদার মেসবাহ উদ্দিন, ডেলটার গৌরীপুরের নাওভাঙ্গার হাফিজ উদ্দিন ও এডফ প্রধান ছিলেন কমান্ডার আব্দুর রব। এজন্য ভারতের ১৩ রাজপুত বাহিনীকে এর সঙ্গে একীভূত করা হয়। সাত দিন যৌথ মহড়া চলে। ২ নবেম্বর রাত দশ/এগারোটার দিকে মুক্তি ও মিত্রবাহিনী সমবেত হয় ভারতের যাত্রাকোনা স্কুল মাঠে। ওখানে প্রসাদ বিতরণ শেষে স্ব স্ব ধর্মে শপথ নেয়ার পর নির্দেশনামতে বিভিন্ন দিকে মার্চ করে মুক্তি ও মিত্রবাহিনী। উত্তরদিক বাদ রেখে দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম দিকে আটটি কাটঅফ পার্টির সহায়তায় ওই পাঁচটি গ্রুপ আক্রমণের জন্য জীবনবাজি রেখে একযোগে অগ্রসর হয়। মিত্রবাহিনীর কর্নেল রঘুবন সিংহের সঙ্গে ৩৩ অস্ত্রধারী মুক্তিযোদ্ধা তেলিখালি ক্যাম্পের দক্ষিণদিকে অবস্থান নেয়। এই গ্রুপে ছিলেন কমান্ডার আব্দুর রব। তিনি জানান, তাদের সঙ্গে ওয়্যারলেস সেট ও গ্রেনেড ছিল। মূলত বাঙ্কারে চার্জ করার জন্যই এই গ্রেনেড দেয়া হয়। অন্যান্য গ্রুপের সঙ্গেও এসব সরঞ্জাম ছিল। পাকসেনাদের তেলিখালি ক্যাম্প ছিল ভারি ও আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত। মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর সদস্যরা ক্রলিং করে এগোতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার রব বলেন, সেদিন রমজান মাস। ১৯৭১ সালের ৩ নবেম্বর। রাত আনুমানিক প্রায় তিনটা। সেহরি খাওয়ার সময় হচ্ছে। এরই মধ্যে মুক্তি ও মিত্রবাহিনী ৩ দিক থেকে ক্রলিং করে পাকসেনাদের বাঙ্কারের কাছাকাছি চলে যায় এবং ক্যাম্প ঘিরে ফেলে। ভারতীয় সেনারা ভেরিলাইট পিস্তল দিয়ে প্রথমে ফায়ার করার সঙ্গে সঙ্গে আলোকিত হয়ে ওঠে পুরো তেলিখালি। শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। তিনদিক থেকে একযোগে কভারিং ফায়ারের সঙ্গে গ্রেনেড চার্জ আর গুলিবর্ষণ। বৃষ্টির মতো পাল্টাগুলি আসতে থাকে বাঙ্কার থেকে। এভাবে যুদ্ধ চলে সকাল আটটা পর্যন্ত। টানা ৫ ঘণ্টার এই যুদ্ধে শহীদ হন ৮ মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর ২১। আহত হন মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর অর্ধশত। বিপরীতে খতম হয় ১২৪ পাকসেনা, ৮৫ রাজাকার ও ২৪ রেঞ্জার। এক পাকসেনা ও ২ রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। এই যুদ্ধে শত্রুপক্ষের একজনও পালাতে পারেনি। জীবনবাজি রেখে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেয়া কমান্ডার আব্দুর রব জানান, ক্রলিং করে এগোনোর সময় ফুলপুরের ভাইটকান্দির সহযোদ্ধা হযরত হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়েন। এ অবস্থায় পাকবাহিনীর গুলিতে লুটিয়ে পড়ে শহীদ হন। মাথায় গুলি খেয়ে চোখের সামনে কাদাজলের নালায় পড়ে ছটফট করলেও কিছুই করার ছিল না সহযোদ্ধা হযরতের জন্য। ভারতীয় অনেক সেনা অফিসারও লাশ হন সেদিন। ভারতীয় সেনারা তেমন ক্রলিং করত না বলে সৈনিকের চেয়ে অফিসারের লাশ পড়েছিল বেশি। ফুলপুর ও হালুয়াঘাটের অনেকে শহীদ হন। সেদিন বেঁচে যাব এমন ভাবিনি। এরকম অসংখ্য লাশ ফেলে রেখেই সামনের দিকে ক্রলিং করে যাই নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও। সেদিন এভাবেই আমরা তেলিখালি ক্যাম্প দখলে নেই। দেশে এটিই ছিল প্রথম মুক্ত এলাকা। এর আগে যুদ্ধ করে কোন এলাকা শত্রুমুক্ত করা যায়নি । কমান্ডার রব জানান, ক্যাম্প দখলে নেয়ার পর মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর শহীদদের লাশ উদ্ধার করে নোম্যানসল্যান্ডে নিয়ে যাই। পরে মিত্রবাহিনীর শহীদদের লাশ নেয়া হয় ব্যাটালিয়ন হেড কোয়ার্টারে। আর মুক্তিবাহিনীর শহীদদের গণকবর দেয়া হয় সীমান্তে। আবুল হাশেম, আতাউদ্দিন শাহ ও মেজবাহ উদ্দিন শহীদদের গণকবর দেন। ময়মনসিংহ শহরের কেষ্টপুরের আলাউদ্দিন ও শাহজাহানের লাশ দাফন করা হয় ঢালুতে। তেলিখালি ক্যাম্প আক্রমণে শহীদ হন নোয়াখালীর ইপিআর সদস্য ওয়াজিউল্লাহ, সরিষাবাড়ির শওকত উসমান, বেগুনবাড়ির রনজিত গুপ্ত, তেলিখালির আক্তার সরকার, কেষ্টপুরের আলাউদ্দিন, শাহজাহান বাদশা, ভাইটকান্দির হযরত আলী ও নালিতাবাড়ির ইপিআর সদস্য ইদ্রিস আলী। তবে তেলিখালি বিজিবি ক্যাম্পের সামনে স্থাপিত স্মৃতিফলকে সাত শহীদের নাম লেখা রয়েছে বলে জানান স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা। নালিতাবাড়ির ইদ্রিস আলীর নাম নেই ওই তালিকায়। ফুলপুরের কমান্ডার ইপিআর হাবিলদার মেজবাহ উদ্দিনের সঙ্গে ছিলেন শহীদ ইদ্রিস আলী। এই যুদ্ধের পর প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে চলে আসে এবং মনোবল বেড়ে যায়। বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে ভারত সীমান্ত বরাবর পাকসেনাদের শক্তিশালী রক্ষণভাগ বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। মনোবল ভেঙ্গে পড়ে পাকসেনা ও তাদের দোসর রাজাকার আলবদরদের। ৩ নবেম্বর তেলিখালি যুদ্ধের পর ৪ নবেম্বর ব্যাটালিয়ন হেড কোয়ার্টারে মিত্রবাহিনীর শহীদদের শেষকৃত্য হয়। ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার জগজিৎ সিং অরোরা, ব্রিগেডিয়ার সানত সিং বাবাজি, কর্নেল রঘুবন সিং এই শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যোগ দেন। সেদিনের এই অনুষ্ঠানে এক হৃদয়বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। এই যুদ্ধে ভারতীয় সেনারা সিভিল পোশাকে যুদ্ধ করে। কমান্ডার রব বলেন, সেদিন যুদ্ধের পর ক্যাম্পে পাকসেনা, রাজাকার ও রেঞ্জারের সঙ্গে ২ নারীর লাশও পাওয়া যায়। নালিতাবাড়ির আলবদর কমান্ডার আব্দুর রহমান তেলিখালি ক্যাম্পে নারী সরবরাহ করত বলে জানান কমান্ডার রব। ময়মনসিংহ সদরের শম্ভুগঞ্জের ২ রাজাকারকে ধরে পিটিয়ে ও খুঁচিয়ে হত্যা করে মুক্তিযোদ্ধারা। পাকসেনা কিংবা রাজাকার কারও লাশ নিতে আসেনি কেউ। তেলিখালি পাকসেনা ক্যাম্পে আক্রমণের পর প্রায় ৩ মাস লাশের পচাগলা দুর্গন্ধে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় ঘটে। এ সময় কেউ তেলিখালি যেতে পারেনি এই দুর্গন্ধের কারণে, জানান কমান্ডার আব্দুর রব। তেলিখালিসহ তিনটি সম্মুখযুদ্ধ ছাড়াও আটটি যুদ্ধে অংশ নেন ময়মনসিংহ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক জেলা কমান্ডার গেরিলাযোদ্ধা আব্দুর রব। শেরপুরের নালিতাবাড়ির তন্তর সম্মুখযুদ্ধ হয় একাত্তরের ৩০ জুলাই। মুক্তিবাহিনীর চলাচলের এই পথে অ্যাম্বুশ (ফাঁদ) করে রাখত সীমান্তের পাকসেনারা। ফলে ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে নালিতাবাড়ি হয়ে ভারত সীমান্ত পার হতে পারছিল না মুক্তিবাহিনী। খবর আসার পর পরিকল্পনা করে পাকসেনাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালাই। মাত্র কয়েকঘণ্টা যুদ্ধের পর পাকসেনারা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল চাঙ্গা হয়ে ওঠে বলে জানান কমান্ডার রব। এটি ছিল মুক্তিবাহিনীর একক যুদ্ধ। দীর্ঘ আলাপচারিতায় এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, হালুয়াঘাটের বান্দরঘাটা যুদ্ধ করি ১৯৭১ সালের ৬ আগস্ট। এটিও ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের একক সম্মুখযুদ্ধ। কমান্ডার আবুল হাশেম ও আলী হোসেনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর দুটি কোম্পানি এই যুদ্ধে অংশ নেয়। আমি ছিলাম আবুল হাশেমের কোম্পানিতে। সীমান্তের বান্দরঘাটায় পাকসেনাদের বিওপি ছিল। ভোররাতে পাকসেনাদের ক্যাম্পে হামলা চালাই। হামলায় ২০/২২ পাকসেনাকে খতম করলেও এই যুদ্ধে আমরা জয়ী হতে পারিনি। মুক্তিবাহিনীর আব্দুস সালাম, রিয়াজ উদ্দিন ও আজিজুল হক-এই ৩ জন শহীদ হন। আহত হন ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জের রঘুরামপুরের আব্দুস সামাদ ও ধোবাউড়ার রফিক। রেকির দুর্বলতা ও ভোরের সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়াসহ পাকসেনাদের বাঙ্কার থেকে ক্রমাগত গুলি বর্ষণের কারণে পিছু হটতে বাধ্য হই আমরা। কাটঅফ পার্টি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করা এবং কভারিং ফায়ার, মর্টার শেল ও গ্রেনেড কম থাকাতে এই যুদ্ধে আমরা জয়ী হতে পারিনি। এটি ছিল মূলত মুক্তিবাহিনীর ট্রায়াল কেস। তিনি বলেন, মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং নেয়ার পর প্রথম অপারেশন করি ময়মনসিংহ হালুয়াঘাট সড়কের নাগলা ব্রিজ উড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে। ময়মনসিংহ থেকে সীমান্তে যেতে পাকসেনারা এই ব্রিজ ব্যবহার করত। এটিই ছিল সহজ পথ। একাত্তরে স্থানীয় রাজাকাররা সর্বক্ষণিক অস্ত্র হাতে এই ব্রিজ পাহার দিত। আর গাড়ি নিয়ে টহলে থাকত পাকসেনারা। পরিকল্পনা করি ব্রিজ উড়িয়ে দেয়ার। ৪০ জনের এই দলে আমিসহ তিনজন বোমা বিশেষজ্ঞ ছিলাম। ভারতের ঢালু থেকে ১৬০ পাউন্ড ওজনের এক্সপ্লোসিভসহ ভারি বর্ষণ মাথায় নিয়ে পানি পথে এক দিন এক রাত হেঁটে-নৌকায় কমান্ডার আব্দুল হক, ফারুক আহমদ ও আমিসহ ৪০ জনের দলটি হালুয়াঘাটের পাবিয়াজুড়ি গ্রামের আলী হোসেনের বাড়িতে আশ্রয় নেই। আমাদের গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন আতাউদ্দিন শাহ। এখানে এক্সপ্লোসিভ ৪ ভাগ করে চারটি ডিনামাইট তৈরি করি। রেকি করান আতাউদ্দিন শাহ। সেদিন ছিল ২৩ জুলাই, ১৯৭১। রাত অনুমান বারোটা বাজে। কথামতো এলএমজি নিয়ে আতাউদ্দিন শাহ ব্রাশ ফায়ার করলে পাহারাদার রাজাকাররা ভয়ে ব্রিজ থেকে পালিয়ে যায়। প্রায় ১৫ মিনিটের মধ্যে ব্রিজে চারটি ডিনামাইট স্থাপন করে আনুমানিক ২৫০ গজ দূরের বিল থেকে নিরাপদে ও বিনাবাধায় সেফটি ফিউজে আগুন ধরিয়ে পেছনে দৌড়াতে থাকি সবাই। এর ঠিক ৫ মিনিটের মধ্যেই বিকট শব্দের বিস্ফোরণে উড়ে যায় নাগলা ব্রিজ। মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং নেয়ার পর এটিই ছিল প্রথম সফল অপারেশন। কমান্ডার আব্দুর রব জানান, এই অপারেশনের পর সিদ্ধান্ত হয় গেরিলা আক্রমণের। এই তালিকায় প্রথমে নাম তোলা হয় ময়মনসিংহ শহরের কেওয়াটখালি পাওয়ার হাউস ধ্বংসসহ পাটগুদাম, বিহারী ক্যাম্প পুড়িয়ে দেয়ার। এজন্য ১০৫ মুক্তিবাহিনীর সদস্যকে নিয়ে দল গঠন করি। পরিকল্পনা মতে, ভারতের ঢালু থেকে শিববাড়ি ইয়ুথক্যাম্প ইনচার্জ হাতেম আলীর আশ্রয় নেই। সেখান থেকে নেওলাগিরি মুক্তি ক্যাম্পে আসি। গৌরীপুরের তোফাজ্জল হোসেন চুন্নু আশ্রয় নেন এই ক্যাম্পে। এখান থেকে গোয়াতলা ও কাশিগঞ্জ হয়ে গৌরীপুরের কলতাপাড়া বাজারে থাকি ১০৫। এখানে ২ রাজাকারকে পাকড়াওয়ের পর সেলিম সরকার রবার্ট ও আকবর তাদের জবাই করে খতম করি। পরে কলতাপাড়া থেকে নাওভাঙ্গা বাজারের কাছে এক হিন্দু বাড়িতে আশ্রয় নেই। দিনে ঘুমাই আর রাতে অগ্রসর হই। হিন্দু বাড়িতে অবস্থানকালে মোসলেমের রাইফেল থেকে হঠাৎ একটি মিস ফায়ার হয়ে ঘটে গেল বিপত্তি। খবর পেয়ে শম্ভুগঞ্জ ও উচাখিলা থেকে পাকসেনারা রেঞ্জের বাইরে থেকে গুলিবর্ষণ করতে করতে অগ্রসর হতে থাকল। প্রায় ২/৩ ঘণ্টা পাল্টাপাল্টি গুলি চালিয়ে আমরা পিছু হটি। ফেরার পথে ফুলপুরের খিচা রাজাকার ক্যাম্পে হামলা চালাই। কিন্তু রেকি না থাকায় আমরা সফল হতে না পেরে বওলার দিকে অগ্রসর হই। ২৬ সেপ্টেম্বর রাত দশটার দিকে বালিয়াবাজারে রাজাকার সমাবেশ হওয়ার খবর পাই। রেকি করি। হামলার প্রস্তুতি নিই। কিন্ত সময়মতো স্পটে পৌঁছতে না পারায় সমাবেশ শেষ হয়ে যায়। তারপরও সমাবেশ শেষে ফেরার পথে রাজাকার দেখে কমান্ডার হাশেম হোল্ড বলায় প্রথমে দৌড় দিলেও পরে এক বাড়িতে ঢুকে আমাদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়। বালিয়া ইউনিয়নের শান্তি কমিটির সভাপতিকে এগিয়ে দিচ্ছিল রাজাকার কমান্ডার ফুলপুরের বসির মেকার ও আলবদর কমান্ডার মাওলানা দৌলত আলী। প্রায় ৫মিনিট গোলাগুলির পর নীরব হয়ে গেলে নবী হোসেন, হাবিবুর ও আমি বাড়িতে ঢুকি। ফের গুলি চালালে আমরাও জবাব দিই। এ সময় ৩ জনকে গুলিতে খতম করলেও ১ জন পালিয়ে থাকায় খুঁজে পাইনি। অ্যাম্বুশের ভয়ে বালিয়া রাজাকার ক্যাম্পে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করে ভারতের ক্যাম্পে ফিরে আসি। ১৯ সেপ্টেম্বর যাত্রা করে ১৩ দিনের এই অভিযান শেষে ২ অক্টোবর আমরা ফিরে আসি। আব্দুর রব জানান, সেদিন মিস ফায়ার না হলে কি হতো জানি না। পাওয়ার হাউস ধ্বংস ও বিহারী ক্যাম্পে আগুন দিতে পারলে একটি বড় ধরনের স্বস্তি পেতাম। এখন কেমন আছেন এমন প্রশ্নে ময়মনসিংহ শহরে বসবাসকারী এই মুক্তিযোদ্ধা জানান, ভাল আছি। বর্তমানে বেশ ভাল আছি।
×