ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্ব অর্থনীতি

মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৬

মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে বাংলাদেশ

এস এম মুকুল ॥ অর্থনৈতিক সবগুলো নির্র্দেশকে ইতিবাচক সম্ভাবনায় এগিয়ে নেয়ায় আকর্ষণীয় প্রবৃদ্ধির পথেই জোড় কদমে হাঁটছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩২তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন গবেষকদের বিবেচনায় পরবর্তী ১১টি উদীয়মান অর্থনীতির অন্যতম গন্তব্যে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধির হারের বিচারে বাংলাদেশ চলতি বছরের দ্রুততম প্রবৃদ্ধিসম্পন্ন দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয়। তথ্যে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৭.১ শতাংশ। আইএমএফের প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশ ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৭ শতাংশ হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের ধারা অব্যাহত রাখতে সক্ষম হবে যা ২০২১ সালের মধ্যে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার রাষ্ট্রীয় কর্মতৎপরতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। তার মানে বাংলাদেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা এবং উৎপানশীলতা বেড়েছে। এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বিশ্ব অর্থনীতিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে বাংলাদেশ। আশাবাদের দেশ বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান উইন ও গ্যালাপ ইন্টারন্যাশনালের সূচকে বিশ্বের শীর্ষ ১০ আশাবাদী দেশের তালিকায় প্রথম স্থানটি নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার পরও ৭৪ শতাংশ বাংলাদেশী চলতি বছর উন্নত ভবিষ্যতের ব্যাপারে আশাবাদী। তারই প্রতিফলন লক্ষণীয় হচ্ছে আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে। আশাবাদ, অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও সুখ- এ তিন সূচকের ভিত্তিতে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি আশাবাদী ও শীর্ষ ১০টি নৈরাশ্যবাদী দেশের তালিকা করা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী ৬৬ হাজার ৪০ জন মানুষের ওপর জরিপটি চালিয়েছে গ্যালাপ। অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয়ে আশাবাদী দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। এ দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ অর্থনৈতিকভাবে উন্নত ভবিষ্যতের ব্যাপারে আশাবাদী তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। এই বাংলাদেশ, সেই বাংলাদেশ নয় ’৭২ সালে তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে আখ্যায়িত করা হলেও সারা বিশ্ব এখন বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বিস্ময়কর বলে মনে করা হয়। কারণ অবিশ্বাস্যভাবে দেশের অর্থনীতি ইতিবাচক সূচকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের রফতানি আয় বেড়েছে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে। পোশাক রফতানি খাতে বিশ্বে বাংলাদেশ এখন দ্বিতীয়। গোল্ডম্যান স্যাঙ্কস সম্ভাবনাময় ‘নেক্সট ইলেভেন’ নামে উদীয়মান ১১টি দেশের একটি নতুন তালিকায় অন্যতম বাংলাদেশ। গোল্ডম্যান স্যাঙ্কস সংস্থাটির জরিপ অনুযায়ী, দেশটির জনসংখ্যার বেশিরভাগই তরুণ। তরুণ সমাজকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের ভবিষ্যত বদলে দেয়া সম্ভব। লন্ডনের জাতীয় দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান প্রকাশ করে, ২০৫০ সালে বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধির বিচারে পশ্চিমা দেশগুলোও ছাড়িয়ে যাবে। জেপি মরগান ৫টি অগ্রসরমাণ অর্থনীতির দেশের নাম উল্লেখ করেছে যার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশের অথর্নীতির ধরন। কৃষি থেকে শিল্পের পথে হাঁটছে অর্থনীতির চাকা। উন্নয়নের রোল মডেল বাংলাদেশ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিভিন্ন সূচকের ইতিবাচক ধারা আগামী দিনে সারা বিশ্বের জন্য রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে বলে মন্তব্য করেছেন আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ীরা। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কৃষিজমি কমতে থাকাসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী প্রকৃতিতেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ। বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও দুর্যোগসহিষুষ্ণ শস্যের জাত উদ্ভাবনেও শীর্ষে বাংলাদেশের নাম। বাংলাদেশই দেখিয়েছে কিভাবে চরম দারিদ্র্যকে দূর করতে হয়, কিভাবে প্রাথমিক শিক্ষাকে নাগালের মধ্যে আনা যায়, নারী ও পুরুষের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য কমানো এবং শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নয়ন থেকে শুরু করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় দক্ষিণ এশিয়াতে তো বটেই সমগ্র পৃথিবীতেই বাংলাদেশ এখন অনুসরণীয়। ‘গ্লোবাল ইকোনমিক রিকভারি : এশিয়ান পারসপেক্টিভ’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রসপারিটি ইনডেক্স বা বৈশ্বিক সমৃদ্ধি সূচকে এগিয়েছে বাংলাদেশ। লন্ডনভিত্তিক থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠান লেগাটাম ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদনে পরিমাপ করা আটটি সূচকের মধ্যে অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৭তম। উদ্যোক্তা তৈরি ও সুযোগের ক্ষেত্রে অবস্থান ১০৫তম, সুশাসনের ক্ষেত্রে ৯৮তম, শিক্ষায় ৯৭তম, স্বাস্থ্যে ৯৮তম, সামাজিক নিরাপত্তায় ১০৭তম, ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় ৫২তম ও সামাজিক মূলধন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৭তম। এইভাবে ধাপে ধাপে অগ্রসর হয়ে বিশ্বে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত। প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও উন্নয়নে বিশ্বময় এখন ঈর্ষার কারণ বাংলাদেশ। সূচকে সূচকে অগ্রগতির ধারা উন্নয়নের সব সূচকেই দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। প্রতিবেশী ভারতের চেয়েও কিছু কিছু ক্ষেত্রে এগিয়ে আর সব সূচকেই পাকিস্তানের চেয়ে আছে বাংলাদেশ। বিভিন্ন সূচক বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, গত চার দশকে অর্থনৈতিকসহ উন্নতির সব সূচকে পৃথিবীর পাঁচটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের নাম উঠে এসেছে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ব্যবসায়িক, সামাজিক অগ্রগতি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় বিশ্বের ১২৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৬তম এবং উপমহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪র্থ। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে ভাল অবস্থানে রয়েছে শ্রীলঙ্কা, তারপরে ভারত ও ভুটান। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বিশ্ব অর্থনৈতিক সূচকের বলা হয়েছে বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ১৪ ধাপ এগিয়ে ৪৪তম। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ২০১৫-এর প্রতিবেদন অনুসারে, মিষ্টি পানিতে মাছ উৎপাদনে বিশ্বে পঞ্চম এবং চাষের মাছ উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ। বাংলাদেশের ওষুধ এখন ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার ৮০টি দেশে রফতানি হচ্ছে। জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশকে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ দেশে পরিণত করেছে। রফতানি ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সসহ অন্য পথে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে ২৩ বিলিয়নের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাংলাদেশের। সবজি উৎপাদনে তৃতীয় স্থানে বাংলাদেশ। ফল উৎপাদন বৃদ্ধির হারের ভিত্তিতে বাংলাদেশ বিশ্বের প্রথম। আম উৎপাদনে বিশ্বে সফতম। পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম। স্যানিটেশন, মাতৃমৃত্যুহার হ্রাস, নারীর ক্ষমতায়ন, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার ও সেবা, প্রযুক্তির সঙ্গে তরুণ প্রজন্মের মেলবন্ধন, খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষিজ উৎপাদন বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবেলা, মৎস্য উৎপাদন, ইলিশ উৎপাদনে দৃষ্টান্ত, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পোশাক রফতানি প্রভৃতি খাতে বাংলাদেশের সাফল্য এখন বিশ্বের উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর কাছে অনুসরণীয়। এখন শুধু সামনে চলার দৃষ্টি বর্তমান সময়ে দেশের অর্থনীতি অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে সমৃদ্ধ, বিস্তৃত, স্থিতিশীল ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে মুক্ত। রফতানি আয়ের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাংলাদেশের পণ্য রফতানি আয় বেড়েছে ৭৭ দশমিক ৫ শতাংশ। ভারত, ভিয়েতনাম, চিন, কম্বোডিয়াসহ প্রতিযোগী দেশগুলোর চেয়ে গুণগতমান, কম দামের কারণে বাংলাদেশের পণ্য রফতানি প্রতিবছরই বাড়ছে। ২০২০ সাল নাগাদ প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশ করার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়। সত্তরের দশকে বাংলাদেশ পুরোপুরিই সাহায্যনির্ভর থাকা দেশটি নব্বইয়ের দশকে ধীরে ধীরে পাল্টে যেতে শুরু করে। সাহায্যনির্ভর বাংলাদেশ বাণিজ্যনির্ভর বাংলাদেশের দিকে যাত্রা শুরু করে। আর বর্তমানে দেশটির বৈদেশিক সাহায্য জিডিপির ২ শতাংশেরও কম। সাহায্যনির্ভর থেকে বাণিজ্যনির্ভর হওয়াটাও স্বাধীন বাংলাদেশের গত ৪৫ বছরের অন্যতম অর্জন। পাতাল রেলের যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সকল বাঁধা, হুংকার, অঙ্গুলি নির্দেশ তোয়াক্কা না করে, কোন অপশক্তির কাছে মাথা নত না করে, সহযোগিতা আর দয়া-দক্ষিণা না পেলে পদ্মা সেতু গড়ে তোলা সম্ভব হবে না বিশ্বের এমন ধারণাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করার পথে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আর কোন বাঁধা মানবেনা বাংলাদেশ। অমিত সম্ভাবনা নিয়ে কেবল সামনের দিকে এগিয়ে যাবে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ এই শুভ প্রত্যাশা।
×