ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

শাহীন রেজা নূর

বিএনপি বিষয়ক জটিলতা

প্রকাশিত: ০৩:৪১, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৬

বিএনপি বিষয়ক জটিলতা

বিএনপি এবার নতুন চাল চেলেছে। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের দাবিতে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ইতোমধ্যে তাদের একটি প্রতিনিধি দল সাক্ষাতও করেছে। ইতোপূর্বে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন বিষয়ে কিছু দাবিও পেশ করেছেন। অতঃপর রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠক করেছেন তারা। কথায় বলে, ‘শেষ ভাল যার, সব ভাল তার’। এখন বিএনপির এই উদ্যোগের শেষটা না দেখা পর্যন্ত বলা যাবে না যে এর মধ্যে ভালত্ব কতটুকু! বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এর মধ্যে যে কা--কারখানা করেছে তাতে তাদের সদিচ্ছা, আন্তরিকতা, বাংলাদেশের প্রতি মমত্ব ইত্যাদি বিষয়ে জনমনে নানান প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে বৈকি! সুতরাং, নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে নানান কূটকৌশল প্রয়োগের চেষ্টা যে তারা করবে তাতো বলাই বাহুল্য! আমরা যদি দলটির গোড়াপত্তন থেকে শুরু করে এর চলন-বলন, লক্ষ্য-আদর্শ ইত্যাদির প্রতি দৃকপাত করি তাহলে স্পষ্ট বুঝতে ও দেখতে পাব যে, বাংলাদেশকে প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তানবাদী ধারায় ফিরিয়ে নেয়ার প্রচেষ্টাই হচ্ছে এই দলটির একমাত্র লক্ষ্য। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে পাকিস্তানবাদী ও তথাকথিত ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চলবে না, চলতে পারে না। এই সত্যোপলব্ধি দলটির কোন নেতা-কর্মীর মাঝেই নেই। আর তার কারণ এই যে, এই দলটিতে প্রধানত তারাই শামিল রয়েছে যারা কিনা মুক্তিযুদ্ধকে ভারতের হয়ে তাদের সাধের পাকিস্তানকে দ্বিখ-িত করার ষড়যন্ত্র বলে মনে করে। পাকিস্তানের শাসক ও শোষকরা তেইশ বছর ধরে ইসলামী হুকুমাত কায়েমের নামে পূর্ব-বাংলার অধিবাসীদের ওপর যে স্টিমরোলার চালিয়েছিল এবং যার প্রতিক্রিয়ায় বাংলার মানুষের মনে ঐ পাকিস্তানবাদী প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতি যে ক্ষোভ এবং অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠেছিল, সেই সত্যটি ইচ্ছা করে ভুলে বসে থাকে ওরা। বাঙালীদের ভাষা-শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য ইত্যাদি যে সম্পূর্ণ একটি স্বতন্ত্র বিষয়, একথা তাদের পূর্বসূরিরা মানতে রাজি ছিল না। ফলে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে অর্জিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালীদের মুসলমান বানানোর এক জঘন্য ও হীন প্রয়াস-প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল পবিত্র ইসলামের অপব্যাখ্যা করে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ মুসলমান বটে, কিন্তু তাদের মুসলমানত্ব কখনও নাঙ্গা তলোয়ারের আগায় বা মানুষের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ কিংবা কোন প্রকার ভেদ-বুদ্ধি দ্বারা প্রভাবিত হয়নি। এ দেশের মুসলমানদের ঈমান-আকিদা ইসলামের সুফিবাদী দর্শনের আলোকধারায় প্রবাহিত হয়েছে। ফলে মানবতাই এদেশের মুসলমানদের মানস গঠনের সবচেয়ে বড় উপাদান হিসেবে ক্রিয়াশীল ছিল। লক্ষণীয় যে, ইসলামের দোহাই পেড়ে বা মুসলমানরা একটি স্বতন্ত্র জাতি এই কথা বলে গত শতকের চল্লিশের দশকে ভারত বিভক্তির যে দাবি তোলা হয়েছিল বা স্বতন্ত্র মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ প্রতিষ্ঠার যে আকাক্সক্ষা ব্যক্ত হয়েছিল, তাতে কিন্তু ধর্মকে রাষ্ট্র পরিচালনার হাতিয়ার বানাবার কোন অভিপ্রায় জিন্নাহ-সোহ্রাওয়ার্দী-আবুল হাশিমদের ছিল না। তাদের অভিপ্রায় এই ছিল যে, একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হবে পাকিস্তান যেখানে সকল ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের মানুষ শান্তিতে সহাবস্থান করবে ও যাবতীয় মৌলিক ও নাগরিক অধিকার ভোগ করবে নির্দ্বিধায়। কিন্তু রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হবার পরপরই এক শ্রেণীর অসৎ রাজনীতিক, অসাধু ব্যবসায়ী আর উচ্চাভিলাষী সেনা কর্মকর্তা নানান শাঠ্য ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ড্রাইভিং সিটটি দখল করে ফেলল। ফলে গণতন্ত্রের পরিবর্তে স্বৈরতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ, একনায়কতন্ত্র ইত্যাদি নানাবিধ উৎপাত চেপে বসল জাতির কাঁধে। সবচেয়ে বড় কথা, দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বাঙালীদের ওপর সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নানাবিধ আক্রমণ চলল পাকিস্তান আমলজুড়ে। অর্থনৈতিক বৈষম্য, কুশাসন আর নিগ্রহ-নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে বাংলার মানুষ প্রথমে রাজনৈতিকভাবে এই অপশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় এবং পরে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে নিজস্ব ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’ কায়েম করে। আর এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পটভূমিতে গণমানুষের যে সুদীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাস রচিত হয় তা বাংলার মানুষকে বিশেষভাবে গৌরবান্বিত করেছে। শেরে বাংলা ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী, মাওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ সেই সংগ্রাম সাধনাকে মঞ্জিলে মকসুদে পৌঁছে দেবার ব্যাপারে অক্লান্ত পরিশ্রম আর সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষা করে গেছেন। এই রাজনৈতিক সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্বটির ভিত রচনা আর একে সুষ্ঠু ধারায় বিকশিত করার ব্যাপারে দৈনিক ইত্তেফাক ও পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্রলীগ অনন্য ভূমিকা পালন করে। আর সেই সংগ্রামের সিঁড়ি বেয়ে ক্রমান্বয়ে জনপ্রিয় হতে থাকেন বাংলার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর অসীম সাহস, অবিচল নিষ্ঠা আর আপোসহীন ঋজুতা তাঁকে বাঙালী জাতির পিতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে এই হচ্ছে আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কাহিনী। কিন্তু একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভের পর নানান দৃশ্যমান ও অদৃশ্য চক্রান্তে আমরা বুঝিবা খানিকটা দিকভ্রষ্ট হয়ে পড়েছিলাম! আর এরই ধারাক্রমে নতুন করে পরাজিত অপশক্তি চক্র-চক্রান্তের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মওকা পেয়ে যায় আর দেশটিকে একেবারে উল্টোদিকে নিয়ে যেতে থাকে। অর্থাৎ, ধর্মের নাম ভাঙিয়ে পুনরায় সকল প্রতিক্রিয়াশীল বিষয়াদী চাপিয়ে দেবার সর্বক্ষণিক আয়োজন চলে। বাংলা ও বাঙালীত্ব থেকে ‘হিন্দুয়ানী’ মুছে দেয়া, প্রতিবেশী ভারতের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণার মাধ্যমে সস্তা ও স্থূল রাজনীতির পুনঃআমদানি করা, আমাদের জাতিসত্তায় ওদের মতো করে ইসলামী উপাদানের সন্নিবেশ ঘটানোর কৃত্রিম প্রয়াস-প্রচেষ্টা চালানো আর দেদার লুটপাটের অর্থনীতির প্রবর্তন করা হয় বঙ্গবন্ধুকে হত্যার অব্যবহিত পর থেকে। পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এবং তাদের স্থানীয় দোসরদের সহযোগিতায় আমাদের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে জেনারেল জিয়াউর রহমানের অভ্যুদয় ঘটে। তাই মুক্তিযোদ্ধা জিয়া ক্ষমতা লাভের পরপরই সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ’ শব্দ ও আরও কিছু কথা সংযোজন করে আমরা যে ‘মুসলমান’ ও বাংলাদেশ যে ‘মুসলমানদের’ দেশ এই বিষয়টি দেশবাসীকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাইলেন ঠিক সেই পাকিস্তানী প্রতিক্রিয়াশীলদের কায়দায়। অর্থাৎ, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পাকিস্তানের গণবিরোধী শাসকগোষ্ঠী সংখ্যাগুরু বাঙালীদের প্রতি যে আচরণ করত, তিনি ঠিক সেই আচরণই শুরু করলেন। ভাবটা এই যে, সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ’ শব্দটি না থাকলে বা ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে ‘আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস’ বাক্যটি না থাকলে বাংলার মানুষ সব ‘অমুসলমান’ হয়ে যায়। অথচ বাংলায় ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসার ঘটার শুরু থেকেই মুসলমান জনগোষ্ঠী মুসলমান হিসেবেই পরিচিত ছিল। (বাকি অংশ আগামীকাল)
×