ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধের গল্প

প্রকাশিত: ০৬:৪৭, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৬

মুক্তিযুদ্ধের গল্প

মহান মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার রতœগর্ভা টাঙ্গাইলের কালিহাতী। কালিহাতীতে জন্মেছেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, গেরিলা যুদ্ধের কিংবদন্তি কাদেরীয়া বাহিনী প্রধান আবদুল কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম, বেসামরিক প্রধান আনোয়ার উল আলম শহীদ ও নারী সংগঠক হাজেরা সুলতানাসহ অনেক দুঃসাহসিক মুক্তিযোদ্ধা। যারা দেশমাতৃকাকে হানাদারমুক্ত করতে পিছপা হননি, জীবনবাজি রেখে লড়েছেন। সেই সঙ্গে হাসিমুখে জীবন উৎসর্গ করেছেন প্রিয় জন্মভূমিকে স্বাধীন করতে। ঠিক এমনই এক মুক্তিযোদ্ধার নাম হাবিবুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধে কাদেরীয়া বাহিনীর কোম্পানি কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেছেন কালিহাতীর যে ক’জন তাদের মধ্যে একমাত্র শহীদ কোম্পানি কমান্ডার হলেন হাবিবুর রহমান। কাদেরিয়া বাহিনীর অধীনে ১৭ হাজার মুক্তিযোদ্ধা, ৫০ জনের বেশি কোম্পানি কমান্ডার এবং অর্ধ লাখের বেশি স্বেচ্ছাসেবক ১১নং সেক্টরে নিয়োজিত ছিলেন। শহীদ হাবিবুর রহমান ১৯৫২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর কালিহাতী উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের চরসিংগুলী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম কাজিম উদ্দিন। মায়ের নাম জবেদা খাতুন। শিক্ষাজীবনে হাবিবুর রহমান ১৯৬৭ সালে এসএসসি, ১৯৬৯ সালে এইচএসসি পাস করেন। বিএ অধ্যয়নরত অবস্থায় প্রিয় মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার নেশায় মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। ভারতের তেলঢালা থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন। কাদেরিয়া বাহিনীর অধীনে শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে হাবিবুর রহমানকে কমান্ডার নিযুক্ত করে গঠন করা হয় হাবিব কোম্পানি। তার কোম্পানির সেকেন্ড ইন কমান্ড (টুআইসি) ছিলেন একই এলাকার নুরুল ইসলাম মাস্টার। হাবিবুর রহমান শহীদ হবার পর তিনি কোম্পানি কমান্ডারের দায়িত্ব পান। এছাড়া প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন দুর্গাপুর ইউনিয়নের সিংগুলী গ্রামের লুৎফর রহমান, বেরিপটলের আব্দুল আজিজ সিকদার, টাঙ্গাইল সদরের মোকাদ্দেস আলী, গোপালপুর উপজেলার মজিবর রহমান ও ময়মনসিংহের সাফায়েত হোসেন। ১১নং সেক্টরের টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর ও শেরপুর জেলার বিভিন্নস্থানে কমান্ডার হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে পাকিস্তানীদের সঙ্গে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের সমেশপুর গ্রামে হাবিব কোম্পানির সঙ্গে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সম্মুখযুদ্ধ চলছিল। একপর্যায়ে হানাদার বাহিনীর গুলি হাবিবুর রহমানের কপালে লাগলে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। হাবিব কোম্পানির সহযোদ্ধা বর্তমানে কালিহাতী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাংগঠনিক কমান্ডার আবদুল হাই আকন্দ বলেন, সমেশপুর এলাকায় আমরা ক্যাম্প করি। সমেশপুর এমন জায়গা, যার কাছেই সিরাজগঞ্জ, দক্ষিণে সোহাগপুর এবং পশ্চিমে উল্লাপাড়া রেলস্টেশন। তিন পয়েন্টেই পাকিস্তানী হানাদার, রাজাকারদের শক্ত ঘাঁটি। আমাদের ক্যাম্পে ওরা আক্রমণ করার পরিকল্পনা করছে আমরা সেটা বুঝতে পারিনি। এই ক্যাম্প থেকেই বিভিন্ন স্থানে আমাদের যুদ্ধ পরিচালিত হচ্ছে। সিরাজগঞ্জ থেকে এসে সোহাগপুর হাটে ঢোল দিয়ে শুকুর মামুদ মাল্টিভিটামিন ট্যাবলেট বিক্রি করে। শুকুর মামুদের গতিবিধি সন্দেহ হওয়ায় আমাদের এক ডিউটিযোদ্ধা কমান্ডার হাবিবুর রহমানের কাছে ওকে ধরে নিয়ে আসে। তখন শুকুর জানায়, সে অত্যন্ত গরিব, ভিটামিন বিক্রি করেই সংসার চলে। এলাকার লোকজন ওকে ভাল মানুষ বলে সাফাই গায়। সবার অনুরোধে কমান্ডার শুকুরকে ছেড়ে দেন এবং অবাধে চলাফেরা করার অনুমতি প্রদান করেন। কিন্তু ও যে রাজাকার, হানাদার বাহিনীর দোসর এবং সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করছে আমরা কেউই বুঝতে পারিনি। এভাবে চলে কিছু দিন। ৭ ডিসেম্বর ভোর ৫টায় শুকুর মামুদ সোহাগপুর থেকে সিরাজগঞ্জ যাচ্ছে। জহের আলী আমাদের সহযোদ্ধা সমেশপুরের দক্ষিণ এলাকায় ডিউটিরত অবস্থায় ওকে দেখতে পান। এত ভোরে শুকুর কোন দিন চলাফেরা করে না। জহের আলী সন্দেহ নিয়ে ডাক দিলে ও দ্রুত চলে যেতে থাকে। জহের আলী দৌড়ে শুকুরকে ধরে ফেলে। ওর কাছে সমেশপুর এলাকার ম্যাপ ও চিঠি পাওয়া যায়। এসব বিষয়ে শুকুর মামুদ বলেন, ভাই আমাকে স্যারের কাছে নিয়ে যান। পরে কমান্ডারের কাছে নিয়ে আসা হয়। কিছু মারপিট দেয়ার পর ও কমান্ডারের দুই পা জড়িয়ে ধরে বলে স্যার আপনারা বাঁচুন। সকাল ৭টায় তিন দিক থেকে আপনাদের ওপর আক্রমণ চালাবে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। তখন কমান্ডার আমাদের তিন দিকে ডিফেন্স পজিশন নিতে বললেন। আমরা প্রস্তুত হই। ঠিক ৭টায় আক্রমণ চালালো হানাদাররা। দুই পক্ষের মধ্যে শুরু হয় ভয়াবহ সম্মুখযুদ্ধ। কিন্তু আমরা পূর্বেই সুবিধাজনক অবস্থানে থাকায় তেমন ক্ষতি হলো না। আমরা জয়ের দ্বারপ্রান্তে। এমন সময় কমান্ডার হাবিবুর রহমান রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে যুদ্ধের কৌশল সম্পর্কে নির্দেশ দিতেই হানাদারদের গুলি তাঁর কপালে লেগে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। আমাদের চোখের সামনেই কমান্ডার হাবিবুর রহমান শাহাদাত বরণ করেন। আমরা মইয়ের ওপর শুইয়ে সমেশপুর থেকে হেঁটে সিংগুলী আনার পর তাঁকে দাফন করি। এ যুদ্ধে আরও চার মুক্তিযোদ্ধা গুরুতর আহত হয়েছিলেন। সেই সঙ্গে বেশ কয়েকজন হানাদার, রাজাকার নিহত ও আহত হয়েছিল। হাবিবুর রহমানের সহধর্মিণীর নাম জাহানারা বেগম। এক ছেলে মৃত নজরুল ইসলাম। এক মেয়ে নার্গিস আক্তার আমিনা বলেন, আব্বা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়ার পর আমরা অনেক কষ্টে বড় হয়েছি। কিন্তু বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে নিজেকে গর্বিত মনে করি। বর্তমানে শহীদ পরিবারের সদস্য হিসেবে সরকারী সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছি। -ইফতেখারুল অনুপম, টাঙ্গাইল থেকে
×