ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘মোরে এটটু থাহার জাগা দেন’

প্রকাশিত: ০৪:০১, ৭ ডিসেম্বর ২০১৬

‘মোরে এটটু থাহার জাগা দেন’

শংকর লাল দাশ, গলাচিপা ॥ নাম তার বকুলজান বিবি। বয়স প্রায় ষাট। জীবনের পুরোটা সময় কেটেছে ভাসমান। কোনদিন স্থায়ী ঠিকানা হয়নি। মাঝখানে দু’জন সরকারী কর্মকর্তার আনুকূল্যে নদীর তীরে টিনের একখানা দোচালা ঘর তুলেছিলেন, সেটিও বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। তাই জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এখন তার একটি চাওয়া, আর তা হচ্ছে-মাথা গোজার একটু ঠাঁই। রাতে একটু নিশ্চিন্তে ঘুমাতে চান। যেখানে বর্ষায় পানি পড়বে না। রোদে পুড়বে না। জোয়ারে ভেসে যাওয়ার ভয় থাকবে না। কিংবা থাকবে না বখাটেদের উৎপাত। এর বেশি চাওয়ার নেই। কিন্তু এটুকু চাওয়া পূরণ হবে কিনা, তাও তিনি জানেন না। বকুলজান বিবির জন্ম মানতা পরিবারে। জন্ম থেকে দিন কেটেছে উপকূলের আর দশটি মানতা পরিবারের মতো নৌকায়। ভাসমান সে জীবনে ছিল না-স্থায়িত্বের ছোঁয়া। আজ এখানটায় তো কাল অন্য কোথাও। এক নৌকা থেকে আরেক নৌকায়। ক্ষুন্নিবৃত্তি ঘটেছে মাছ ধরে। শিশু বয়সে বাবা-মায়ের নৌকায়। এগারো বছর বয়স থেকে স্বামী জামালউদ্দিনের নৌকায়। কোল আলো করে আসা একমাত্র মেয়ে নয়নতারা আর স্বামীকে নিয়ে নৌকায় কেটেছে দীর্ঘ সময়। একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ বকুলজান বিবির জীবনটা এলোমেলো করে দেয়। ৩০ বছর আগে স্বামী মারা যান। বন্যায় ভেসে যায় নৌকা। নদীতেও মাছ কমে যায়। উঠে আসেন ডাঙ্গায়। আশ্রয় জোটে রাস্তার পাশে। জীবন যেন আর চলে না। মেয়ের হাত ধরে পাড়ি জমান ভারতের সুদূর আজমীর শরীফে। সেখানেও ঠাঁই হয় না। আবার ফিরে আসেন পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার রামনাবাদ নদীর তীরে রাস্তার পাশের ঠিকানায়। মেয়েকে বিয়ে দিয়ে স্থায়ী হতে চান। কিন্তু দুর্ভাগ্য যেন পিছু ছাড়ে না। বিয়ের কয়েক বছরের মাথায় মেয়ে মারা যায়। একা হয়ে পড়েন বকুলজান। বকুলজানের ভাষ্য, কয়েক বছর আগে কোন এক উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাত হাজার টাকা খরচ করে রামনাবাদ নদীর তীরে গলাচিপা তালেবনগর আবাসনের কাছে একটি দোচালা টিনের ঘর তুলে দিয়েছিলেন। সেখানে দিন ভালই কাটছিল। কিন্তু সে ঘরখানা এখন বসবাস অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। জোয়ার এলেই ঘর ডুবে যায় নদীর পানিতে। বর্ষায় পানি পড়ে। সন্ধ্যা হলে ঘরের চারপাশে বখাটেরা নেশার আড্ডা বসায়। তাই সে ঘর ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন তালেবনগর আবাসনের মতি মাস্টারের চায়ের দোকানের বারান্দায়। সারাদিন ফেরিঘাটের আশেপাশে ঘুরে ইটের টুকরো কিংবা পাথর কুড়ান। দিন কাটান দু’তিনটি সিঙ্গারা খেয়ে। মতি মাস্টার বলেন, রাতে যখন তিনি দোকান বন্ধ করেন তখন বকুলজান বিবি দোকানের বেঞ্চিতে শুয়ে পড়েন। আবার সকাল হলে বেরিয়ে পড়েন। সারাদিনে দেখা হয় না। নিজের পরনের শাড়ি দেখিয়ে বকুলজান বিবি বলেন, আমার একখানই শাড়ি। এইখান পইরা গোসল করি। অর্ধেক শুকাইলে শরীল ঢাহি, আবার অর্ধেক রইদে শুকাই। এই কইরা দিন কাডাই। তিনি আরও বলেন, পাথর কুড়াইয়া পেরতেক দিন ১০-১৫ টাহা পাই। ৭-৮ টাহা খরচ করি। বাহি টাহা থুইয়া দেই। যেদিন শরীল খারাপ হয়, হেইদিন কামে যাই না। তহন চালান ভাইঙ্গা খাই। বকুলজান বিবি জানান, স্থায়ী ঠিকানা না থাকায় তার কোন নাগরিকত্ব নেই। কোনদিন ভোট দিতে যাননি। ভোটার তালিকায়ও নাম নেই। পাননা সরকারী কোন সুযোগসুবিধা। তবে প্রতিবছর দুই ঈদের সময় স্থানীয় কাউন্সিলর ১০-১৫ কেজি চাল দেন। এর বেশি কিছু পান না। বকুলজান বিবি জানান, শেষ জীবনে এসে খুব বেশি কিছু চাওয়া-পাওয়ার নেই। শুধু ছোট্ট একখানা ঘর চান। মাথা গোজার ঠাঁই চান। রাতেরবেলা সে ঘরে একটু নিশ্চিন্তে ঘুমাতে চান। এমনকি ওই ঘরে শুয়ে ওপারে পাড়ি জমাতে চান। বলেন, ‘মোরে এটটু থাহার জাগা দেন, আর কিচ্চু চাই না। কিচ্ছু চামু না।’
×