ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

আকিল জামান ইনু

অস্কারে-‘নেরুদা’ এক কবি ও পুলিশের গল্প

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ১ ডিসেম্বর ২০১৬

অস্কারে-‘নেরুদা’ এক কবি ও পুলিশের গল্প

নাম রিকার্ডো এলিয়েসর নেফটালি রেইয়েস বাসোয়ালটো। মাতৃভূমি চিলি। ১০ বছর বয়সে কবিতা লিখার শুরু। তার এই কাব্য প্রেম পছন্দ ছিল না পিতার। তাই চেক কবি জেন নেরুদা অনুকরণে পিতাকে লুকিয়ে পাবলো নেরুদা নামে কবিতা লিখতে শুরু করেন। যে নামটি পরবর্তীতে বিশ্বজুড়ে মুক্তিকামী-বিপ্লবী থেকে কাব্যপ্রেমীদের হৃদয়ের স্পন্দনে পরিণত হয়। বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রভাবশালী কবিদের একজন তিনি সেই সঙ্গে রাজনীতিবিদও। সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন ১৯৭১-এ। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ তাকে অভিহিত করেন, ‘ঞযব মৎবধঃবংঃ ঢ়ড়বঃ ড়ভ ঃযব ২০ঃয পবহঃঁৎু রহ ধহু ষধহমঁধমব.’ তবে এসব কিছুই তাকে চিত্রিত করে না। তিনি প্রকাশিত তার স্বদেশ আর নিরন্ন মানুষের মুক্তির সংগ্রামে। স্বদেশের মানচিত্র বুকে নিয়ে তিনি হেঁটেছেন বাস্তব পরাবাস্তব, প্রেম-অপ্রেম, বেদনা, আর রোমাঞ্চকর রাজনীতির পথে। সেই পথের এক অধ্যায় কবির চিলি থেকে গোপনে পালানোর অংশ নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র- ‘নেরুদা’। বায়োপিক। কিন্তু কার? কেন্দ্রীয় চরিত্র কবি পাবলো নেরুদা না তার পেছনে অনবরত ধাওয়া করে চলা তার নিজেরই ছায়ার? বিষয় যখন নেরুদা তখন এটি সাধারণ চলচ্চিত্রের চেয়ে বেশি কিছু। সেলুলয়েডে এক কাব্যিক আখ্যান। এ গল্প স্রষ্টা বনাম রাষ্ট্রের, কবি বনাম পুলিশের। স্রষ্টাকে শেকলবন্দী করার এক প্রচেষ্টা এই ছবির গল্প। আর এই শেকলবন্দী করতে চাওয়া মানুষগুলোই স্রষ্টার সৃষ্টিতে বিকশিত অনবরত। প্রচলিত ঘরানার বায়োপিক এটি নয়। কেবল কবির ঘটনাবহুল জীবনের বাইরে এ ছবিতে মিশে গেছে নেরুদার অসংখ্য কবিতার স্মৃতি ও সত্তা। একের পর এক দৃশ্যকল্প সাজিয়ে পরিচালক নির্মাণ করেছেন এক সিনে-কবিতা। কবিতা ব্যবহারেও সংযমী পরিচালক। পুরো ছবি নেরুদার কবিতায় ছায়াময়। কিন্তু তা সরাসরি উচ্চারিত হয়েছে দু’চারবার মাত্র। যেমন- ‘আমাদের এই মৃতদের নামে/আমি দাবি করছি শাস্তি’ কিংবা ‘আজ রাতে আমি লিখতেই পারি বেদনার সেইসব পঙ্ক্তিমালা/আমি ভালবেসেছিলাম তাকে, হয়ত কখনো সেও ভালবেসেছিল আমায়।’ প্রেম আর মুক্তি সংগ্রামের দোলাচালের বিপজ্জনক সুতোয় দুলেছেন কবি আজীবন। আর তাই ওই দুই মেরুর ভারসাম্য রক্ষায় নেরুদার অগণিত কবিতায় ছড়িয়ে থাকা অনুসঙ্গের কাছে ঋণ করতে হয়েছে পরিচালককে। অসাধারণ প্রকৃতি কাব্যও এই ছবি। গুড়ো হয়ে ঝরেপড়া রাত, তুষারপাত, অরণ্য, কুকুরের পাল, শহরের কানাগলি উঠে এসেছে ক্যামেরায় নেরুদার কবিতা হয়ে। নিষিদ্ধ সংগ্রামীদের গোপন মেলামেশা, দেশ থেকে দেশান্তরে পালিয়ে বেড়ানো, শ্রমিক সমাবেশে কবিতা পাঠ যেন কবি আর তার সময়ের মধ্যদিয়ে ভ্রমণ, ভ্রমণ কবির ভালবাসায়। নেরুদার কবিতা আর নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট নেতা নেরুদাকে ধাওয়া করে ফেরা গোয়েন্দা প্রধানের গল্প এই ছবি। গোয়েন্দা চিফ অস্কার পেলুসোনা সারা ছবিজুড়ে ধাওয়া করে চলেছেন কবিকে। নিষিদ্ধ পল্লীতে জন্ম নেয়া এই মানুষটি অপরাধীর মনস্তত্ত্ব নিয়েও কাজ করেন। আর নেরুদাকে বুঝতে গিয়ে তার উপন্যাস আর কবিতা পাঠ শুরু পেলুসোনার। ক্রমান্বয়ে প্রেমে পড়া কবির। তবু দায়িত্ব পালনে তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এক অসাধারণ দৃশ্যের সৃষ্টি হয় যখন পেলুসোনা কবির সদ্য ছেড়ে যাওয়া আস্তানায় মুখোমুখি হন কবি স্ত্রী ডেলাইয়ার। কবি স্ত্রী তাকে বলছেন, ‘তুমি ধরবে নেরুদাকে? তুমি তো তার লেখারই অংশ। তুমি যতদূরেই যাও ও ঠিক তোমাকে ছাড়িয়ে যাবে।’ অথবা সেই অসাধারণ দৃশ্য যখন গোয়েন্দা প্রধানের মুখে ছুড়ে দেয়া সিগারেটের ধোঁয়া, যেন এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দেবে প্রাতিষ্ঠানিকতা! এই ছবির গল্প ১৯৪৮ থেকে কবির আর্জেন্টিনা পালানোর সময়কাল। পরিচালক পাবলো লাররেইন কবিকে নিয়ে লিখেছেন সিনে কবিতা আর লুইস নেক্কো কেন্দ্রীয় চরিত্রে ধারণ করেছেন কবির শরীর ও আত্মা। ২০১৭-এর সেরা বিদেশী ছবির ক্যাটাগরিতে অস্কারে মনোনীত হয়েছে ‘নেরুদা’ আগামী বড়দিনে টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ফক্স ছবিটি মুক্তি দিচ্ছে। নেরুদার ভাষাতেই বলি, ‘তুমি বাগানের সবগুলো পুষ্প ছিঁড়ে নিতে পার/তাতে বসন্তের আগমন রুখবে না।’ চলচ্চিত্রের ভুবনে বসন্তের ছোয়া নিয়ে আসছে- ‘নেরুদা’। [email protected]
×