ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

২১ জানুয়ারি উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী

মহাস্থানগড়ই সার্কের সাংস্কৃতিক রাজধানী ॥ তৈরি হচ্ছে লোগো

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ২৬ নভেম্বর ২০১৬

মহাস্থানগড়ই সার্কের সাংস্কৃতিক রাজধানী ॥ তৈরি হচ্ছে লোগো

সমুদ্র হক ॥ দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) কালচারাল সেন্টার আগামী এক বছরের জন্য বাংলাদেশের বগুড়ার মহাস্থানগড়কে সার্কের সাংস্কৃতিক রাজধানীর ঘোষণা দিয়েছে। আগামী বছরের (২০১৭) জানুয়ারি মাসের ২১ তারিখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে সাংস্কৃতিক রাজধানীর উদ্বোধন করবেন। এর আগে প্রধানমন্ত্রী সার্ক কালচারাল সেন্টারের প্রস্তাবনায় অনুমোদন দেন। বৃহস্পতিবার সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সকল বিভাগ ও শ্রীলঙ্কার সার্ক কালচারাল সেন্টারের উর্ধতন কর্মকর্তাদের বিশেষ বৈঠকে বগুড়ার মহাস্থানগড়কে এক বছরের জন্য সার্কের সাংস্কৃতিক রাজধানীর ঘোষণা দেয়া হয়। মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, সাংস্কৃতিক রাজধানীকে কেন্দ্র করে লোগো, সেøাগান, থিম সং, ডমুমেন্টারি ইত্যাদি নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের কোন একটি বড় শহরকে এক বছরের জন্য সার্কের সাংস্কৃতিক রাজধানী করার লক্ষ্যে শ্রীলঙ্কায় অবস্থিত সার্ক কালচারাল সেন্টারের কর্মকর্তাগণ বাংলাদেশের বগুড়ার মহাস্থানগড়, কুষ্টিয়ার শিলাইদহ ও কুমিল্লার ময়নামতি সফর করেন। ইতিহাস-ঐতিহ্য, অবকাঠামো, যোগাযোগসহ সার্বিক বিষয় বিবেচনা ও বিশ্লেষণ করে শেষ পর্যন্ত আড়াই হাজার বছরের ইতিহাসসমৃদ্ধ দেশের সবচেয়ে প্রাচীন নগরী পু-্রবর্ধনের রাজধানী পু-্রনগর মহাস্থানগড়কেই বেছে নেয়া হয়। উল্লেখ্য, ২০১৪ সালে সার্কের শীর্ষ সম্মেলনে সার্কভুক্ত প্রতিটি দেশের রাজধানী ছাড়া বড় একটি শহরকে এক বছরের জন্য সার্ক সাংস্কৃতিক রাজধানীর মর্যাদা দেয়ার প্রস্তাব করা হয়। প্রস্তাব পাস হওয়ার পর সিদ্ধান্ত হয় ইংরেজী বর্ণমালার ক্রমানুসারের (এ্যালফাবেটিকেলি) দেশকে পর্যায়ক্রমে সাংস্কৃতিক রাজধানীর ঘোষণা দেয়া হবে। সে হিসাবে ২০১৫ সালে প্রথম সাংস্কৃতিক রাজধানীর মর্যাদা পায় আফগানিস্তানের ঐতিহাসিক নগরী বামিয়ান। কথা ছিল পরের বছর ২০১৬ সালে বাংলাদেশের কোন নগরী এ মর্যাদা পাবে। আফগানিস্তান ২০১৬ সালের অনেকটা সময় সাংস্কৃতিক রাজধানী হয়ে থাকার সময় পায়। এখন বাংলাদেশ ২০১৭ সালের পুরোটা বছর এ মর্যাদা নিয়ে থাকবে। তবে সূত্র জানায়, নানা আয়োজনের ওপর ভিত্তি করে এ মর্যাদার সময় শেষ হতে ২০১৮ সালের কিছুটা সময় লাগতে পারে। ঘোষণা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর, পর্যটন কর্পোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সকল দফতর ও বিভাগ সাংস্কৃতিক রাজধানী হয়ে থাকার সময়কে সফল করার লক্ষ্যে কর্মসূচী প্রণয়ন শুরু করেছে। এক সূত্র জানায়, সাংস্কৃতিক রাজধানীর নানা আয়োজনের মধ্যে দিবসগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের দিবস, একুশ ও একুশের বইমেলা, পহেলা বৈশাখ, ফাল্গুন উৎসবগুলো যোগ হবে সাংস্কৃতিক রাজধানীর উৎসবের সঙ্গে, যা মহাস্থানগড় ও ঢাকায় একযোগে পালিত হবে। সাংস্কৃতিক রাজধানীকে ঘিরে সার্কভুক্ত দেশের শিল্পী-সাহিত্যিক, গবেষক-বুদ্ধিজীবী প্রথিতযশা ব্যক্তিবর্গ পর্যটক ছাড়াও বিশ্বের অন্যান্য দেশের পর্যটকদের আগমন ঘটবে। দেশী-বিদেশী পর্যটকদের আগমনও বেড়ে যাবে। এদিকে, গত বছর থেকে বগুড়ার মহাস্থানগড়ে হেরিটেজ হাইওয়ের অংশ হিসেবে পর্যটন অবকাশ কেন্দ্র গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের সহযোগিতায় প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের আওতায় এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সাউথ এশিয়ান ট্যুরিজম ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট। ইতোমধ্যে মহাস্থানগড়কে ঢেলে সাজানো হয়েছে। বসার স্থান, ছাতা, উন্নতমানের রেস্তরাঁ, নক্সা, পথঘাটসহ দৃষ্টিনন্দন কাজ করা হয়েছে। সাংস্কৃতিক রাজধানী ঘোষণার পর আরও দৃষ্টিনন্দন কাজ করা হবে, যাতে সারাবছর নানা অনুষ্ঠানের সফল আয়োজন করা যায়। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী, দেশের বিশিষ্ট মণিপুরী নাচের শিল্পী তামান্না রহমানসহ উর্ধতন কর্মকর্তাগণ মহাস্থানগড় ঘুরে দেখেছেন। সূত্র জানায়, সার্ক সাংস্কৃতিক রাজধানী ঘোষণা করার পর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানসহ প্রাথমিক এক মাসের একটি অনুষ্ঠান পরিকল্পনা করা হয়েছে। ২১ জানুয়ারি ২০১৭ সার্কের সাংস্কৃতিক রাজধানী ঘোষণার পরই অনুষ্ঠানমালা শুরু হবে। দিনভর এ অনুষ্ঠানের মধ্যে প্রতœসম্পদসহ নানা ঐতিহ্য প্রদর্শন, লোকজ গান ও মেলা, বাঙালীর গভীরের সংস্কৃতির সকল বিষয় তুলে ধরা হবে। সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান হবে শিল্পকলা একাডেমির পরিচালনায় প্রতœ নাটক, যা হবে মহাস্থানগড়ের ওপরই বিশেষ আলোকসজ্জায়। শিল্পকলা একাডেমিসহ দেশের প্রতিটি এলাকার সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো দেশের ঐতিহ্যের সংস্কৃতি প্রদর্শনের অনেক অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করছে। বগুড়ার সাংস্কৃতিক সংগঠন ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট নিজেদের অনুষ্ঠান প্রদর্শনের উদ্যোগ নিয়েছে। বিশেষ করে সত্তর ও আশির দশকের দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করা বগুড়ার আঞ্চলিক গানের দল ইয়থ ক্যয়ার তাদের প্রদর্শনের প্রস্তুতি নিয়েছে। বগুড়া থিয়েটারের অনেক পরিবশেনার মধ্যে আছে মহাস্থানকে ঘিরে কথা পুন্ড্রবর্ধন ও লছিমনের পালা। তারাও বড় প্রস্তুতি নিয়েছে। বগুড়া সাংস্কৃতিক রাজধানী ঘোষণার সঙ্গেই বৃহস্পতিবার রাতের অনেকটা সময় ধরে আনন্দ মিছিল করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় সাধারণ মানুষ। এক বছর ধরে কর্মযজ্ঞ ধরে রাখার আহ্বান জানায় তারা। সাংস্কৃতিক রাজধানীকে ঘিরে প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর মহাস্থান জাদুঘর আধুনিকায়ন করে সম্প্রসারণ ও সংস্কারের কাজ শেষ করেছে। মহাস্থানগড় ও তার আশপাশে ভাসু বিহার, বেহুলার বাসরঘর নামে অধিক পরিচিতি গোকুলের মেধ, ভীমের জাঙ্গাল, যোগীর ভবন, শেরপুরের খেরুয়া মসজিদ, নবাববাড়িসহ প্রতœসমৃদ্ধ স্থানগুলোতে যাতায়াতের ও অবস্থানের আয়োজন করা হচ্ছে। মহাস্থানগড়ের ইতিহাস খ্রিস্টপূর্ব চতুর্শ শতকের। মৌর্য, গুপ্ত, পাল, শশাঙ্ক, হর্ষবর্ধন যশোবর্ধন, মদন, সেনরাজসহ অন্তত ১৬টি কালের নিদর্শন মেলে মহাস্থানগড় ও তার আশপাশে। বাংলাদেশ ও ফ্রান্স প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের যৌথ উদ্যোগে খননকাজে ইতিহাসের নানা অধ্যায় বের হয়ে এসেছে। সার্কের সাংস্কৃতিক রাজধানী ঘোষণার কিছুদিন আগেই শ্রীলঙ্কার সার্ক কালচারাল সেন্টারের পরিচালক ওয়াসান্তে কুতুয়েল্লা, উপ-পরিচালক সুন্দুরে ডেভিড রাদ্রিগো মহাস্থানগড় ও তার আশপাশের স্পটগুলো ঘুরে দেখেন। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের জানান, সার্ক সাংস্কৃতিক রাজধানী ঘোষণায় মহাস্থানগড় প্রাধান্য পাবে। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর পল্লী উন্নয়ন একাডেমির এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছিলেন, নবেম্বরেই সার্কের সাংস্কৃতিক রাজধানীর ঘোষণা দেয়া হবে। শেষ পর্যন্ত নবেম্বর মাসেই বগুড়ার মহাস্থানগড় সার্ক সাংস্কৃতিক রাজধানীর মর্যাদা পেল।
×