ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সব্যসাচী দাশ

ভিন্ন গল্পের দোয়েল

প্রকাশিত: ০৩:৪০, ৩ নভেম্বর ২০১৬

ভিন্ন গল্পের দোয়েল

এ্যাকশন, সামাজিক ড্রামা কিংবা পুরোপুরি বাণিজ্যিক গল্পের মিশেলে আমাদের চলচ্চিত্র প্রায় গ-িবদ্ধ। সিনেমায় সাহিত্যনির্ভর জীবন গল্প কিংবা কোন জনপদের বাস্তব চালচিত্র খুব একটা উঠে আসেনা। নায়ক-নায়িকার প্রেম, রোমান্স হাত ধরে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা পার্কের ফুল বাগানে মিষ্টি মধুর গান গাওয়া। সঙ্গে সুন্দর সুন্দর প্রেমের বুলি। হঠাৎ! বাধাহয় বাবা নয়ত বড় ভাই কিংবা প্রতিযোগি কেন শক্ত প্রেমিক। বাকি দৃশ্যে কেবল এ্যাকশন আর এ্যাকশান। জীবনের সরল কিংবা প্রকৃত বাস্তবকে এড়িয়ে এমনি মুখরোচক গল্পেই এখন চলচ্চিত্র নির্মাতা ও দর্শকদের মৃদু বা অট্ট হাসির খোরাক। এসব ছাপিয়েও দূরে থেকে যারা নিজেদের ভেতরের তাগিদ কিংবা জীবনের দায়বদ্ধতা থেকে পাশে এসে দাঁড়ান চলচ্চিত্রের ক্যানভাসে। তাদের সত্যই ভিন্নভাবে দেখতে হয়, জানতে হয়। এটা আর এক ধরনের দায়বদ্ধতা। জীবনের সত্য দিকগুলো আমাদের বর্তমান ধারার চলচ্চিত্রে অনেকটাই গৌণ, তবে কেউ কেউ আয়নায় নিজেদের মুখ দেখার মতো বাস্তব বিষয়গুলো এরিয়ে যেতে পারে না। এমনি বাস্তব গল্পের চলচ্চিত্রের অভিনেত্রী দিলরুবা হোসেন দোয়েল। যিনি, শহুরে দ্বান্দ্বিক নাগরিক জীবন গল্পের চরিত্র ‘গলেনূর’। ষোড়শ দশকের বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবির জীবনী নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র চন্দ্রাবতী কথার- চন্দ্রাবতী। তিনি স্বাধীনতা উত্তরকালীন সমাজ জীবন বাস্তবতায় বাহারি রঙের বিহঙ্গের মতো স্বাধীন চরিত্র রেবা। এইসব চরিত্রই নির্মাতার দেয়া তার কল্পনিক রূপ। তিনি বাস্তব মনুষ্য সমাজের একজন উদেয়মান সম্ভাবনাময়ী অভিনেত্রী। মিউজিক ভিডিও, অতিথি চরিত্র, খ-কালীন নাটক কিংবা টেলিছবি এমন কোন প্লাটফর্মে না এসে সরাসরি জীবন গল্পে বাসা বাঁধেছেন প্রকৃতির মতোই সুন্দর মিষ্টি সুরের দোয়েল। সম্প্রতি তার ব্যক্তিগত জীবন, অভিনয় জীবন এবং আগামী দিনে চলচ্চিত্রের রঙিন ক্যানভাসে কিভাবে নিজেকে আঁকবেন এসব বিষয় নিয়ে দীর্ঘ প্রাঞ্জল কথোপকথনের সঙ্গী ছিলেন। ‘আলফা’ ‘চন্দ্রাবতীর কথা’ লাল মোরগের ঝুটি এবং কবি স্বামীর মৃত্যুর পর আমার জবানবন্দী চলচ্চিত্রে অভিনয় করা এই ন্যাচারাল অভিনেত্রী। শৈশব কাটিয়েছি রংপুরে। বেড়ে ওঠার সময় কখনই ভাবিনি, বড় হয়ে নিজেকে আবিষ্কার করব চলচ্চিত্রের ফ্রেমে । এমনটাই জানালেন মিষ্টি হেসে। তবে একটা সুপ্ত বাসনা মনের গভীরে ছিল যা কেবল আমার ভীতরেই ছিল। দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় রাজশাহীতে লাক্স চ্যানেল আইয়ের অডিশনে নাম লিখিয়েছিলাম। পরে অবশ্য আগ্রহ হারিয়ে যাওয়ায় অংশগ্রহণ করিনি। পরবর্তীতে লেখাপড়া ও ব্যক্তিগত জীবনের তাগিদে যখন ঢাকার বাসিন্দা তখন মাঝে মাঝে তার সুপ্ত বাসনা তাকে বিভিন্ন সময় কিসমতের দিশা দেখিয়েছে। বিভিন্ন সময় ক্রোড়পত্র প্রচ্ছদের মডেল হয়েছেন, র‌্যামে হেঁটেছেন, হয়েছেন বিভিন্ন ফ্যাশন হাউজের বিল বোর্ড ও টিভিসির মডেল। এই ছিল তার চলচ্চিত্রে আসার আগের গল্প। বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু। তাঁর লেখা গল্প ও চিত্রনাট্যে নির্মিত চলচ্চিত্র আলফার বিশেষ চরিত্রে অডিশনের মাধ্যমে নির্বাচিত করে তাকে। এই ছবিতে রাস্তার পাশে একজন ভাত বিক্রেতার চরিত্রে সাবলীল অভিনয় করেন দোয়েল। চরিত্রের নাম ছিল গলেনূর। প্রথম ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে। তারপর ২০১৫। পুরো বছর ডুবে ছিলেন বাকি চলচ্চিত্রের মূল চরিত্রে। ব্যক্তিগত জীবনে রং মেখে (মেকআপ) অপরিচিত সং সাজাতে একবারের তিনি অপারগ। হয়ত সে কারণেই ষোড়শ শতকের কস্টিউম এবং ন্যাচারাল লুক নিয়ে চন্দ্রাবতী কথার মূল চরিত্রে কাজ করেছেন। শূটিং হয়েছে কিশোরগঞ্জে। যে কারণে স্থানীয় আঞ্চলিক ভাষা রপ্ত করতে হয়েছে তাকে। ভরা কুয়াশা ও কনকনে শীতে গরম পোশাক ছাড়া সেই আমলের নারী পোশাক শ্রেফ কাপড় পরে দীর্ঘ সময় অভিনয় করতে হয়েছে ক্যামেরার সামনে। এমনই অম্লমধুর অভিজ্ঞতা অকপটে শেয়ার করলেন এই অভিনেত্রী। ফ্রান্সের ৩৪তম ত্যুস ক্যুর চলচ্চিত্র উৎসবে, বিশ্বের ২৪ দেশের আড়াই হাজার চলচ্চিত্রের মধ্যে আশিটি ছবি প্রদর্শনের জন্য নির্বাচিত হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশের তাসমিয়াহ আফরিন মৌ পরিচালিত স্বল্প দৈর্ঘ্যরে চলচ্চিত্র কবি স্বামীর মৃত্যুর পর আমার জবানবন্দীর ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হতে যাচ্ছে। এই স্বল্প দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে মূল নারী চরিত্রে কাজ করেছেন দোয়েল। ব্যক্তিগতভাবে এই চলচ্চিত্র নিয়ে তিনি খুব পুলকিত। আর হওয়াটাই স্বাভাবিক। স্বামীর মৃত্যুর পর আবেগ-উৎকণ্ঠাবিহীন এক বাকরূদ্ধ রমণীর নির্বাক দৃশ্যে দেখা যাবে তাকে। ভিন দেশে আন্তর্জাতিক প্লাটফর্মে স্বাভাবিকভাবেই তিনি উচ্ছ্বসিত। পাশাপাশি গভীর আকাক্সক্ষায় অপেক্ষিত বড় পর্দায় নিজেকে আবিষ্কারের। মানব জীবনের মনোস্তাত্ত্বিক বিবেচনার গল্পে নিজেকে পেয়ে যেমনি তিনি খুশি, তেমনি আগামীতে সব শ্রেণীর দর্শকের কাছাকাছি পৌঁছানোর জন্য ভাল গল্পের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রেও কাজ করতে আগ্রহী। এ প্রসঙ্গে মজাকরে জানতে চাইলাম ধরা যাক হঠাৎ মুম্বাই থেকে প্রস্তাব এল ঋত্বিক রোশানের সঙ্গে কোন পৌরাণিক গল্পে মূল চরিত্রে কাজ করার। কেমন লাগবে কিভাবে নেবেন? উত্তরে ‘ও আল্লা মিষ্টি হেসে তা তো হতেই পারে’ দোয়েল সাহসী-আত্মবিশ্বাসী ও মিষ্টভাষী ক্যারিয়ারে যা কিছু অর্জন তার এবং যতদূর এসেছেন তার এই ইতিবাচক গুণের কারণে। আগামীতে সুযোগ পেলে বাংলা চলচ্চিত্রের হারিয়ে যাওয়া গৌরব ফিরিয়ে আনতে দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করবেন বলে ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
×