ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মিলারদের কারসাজিতেই চালের বাজার এখনও অস্থিতিশীল

প্রকাশিত: ০৪:০৯, ২০ অক্টোবর ২০১৬

মিলারদের কারসাজিতেই চালের বাজার এখনও অস্থিতিশীল

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ মিলারদের কারসাজিতে এখনও স্থিতিশীল হয়নি দেশের চালের বাজার। বর্তমানে গরিবের চাল নামে পরিচিত মোটা চালের কেজি ৪০ টাকা। রাজধানীর ব্যবসায়ীরা বলছেন, মোকামে চালের সঙ্কট। সরবরাহ কম। তাই বেড়েছে মোটা চালসহ সব ধরনের চালের দাম। জানা যায়, শেরপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোরের মোকামগুলোয় চাল ছাড়ছেন না মিলাররা। মিলগুলোয় প্রচুর ধান মজুদ রয়েছে। কিন্তু সেগুলো ভাঙছেন না তারা। এ ধরনের সঙ্কট তৈরির চেষ্টা করছেন তারা। সুযোগমতো অধিক মুনাফার আশায় তারা এটি করছেন বলে অভিযোগ করছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। সরকারকে সঙ্গে দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মিল মালিকরা এখনও ৬ লাখ ২০ হাজার টন চাল সরবরাহ করেননি। নানা অজুহাতে বেশ কয়েকবার সময় বাড়িয়েও তারা পুরোপুরি চাল সরবরাহ করেননি। সরকারকে মিল মালিকদের ৬ লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন চাল দেয়ার কথা থাকলেও তারা দিয়েছেন মাত্র ৪ লাখ ৮০ হাজার মেট্রিক টন। তাদের কাছে পাওনা ১ লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন। বাকি চাল সরবরাহের জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে আগামী ৩১ অক্টোবরের মধ্যে মিলারদের প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যে সব মিলার এ সময়ের মধ্যে চাল দিতে ব্যর্থ হবেন, তাদের আগামী ৫ বছরের জন্য কালো তালিকাভুক্ত করা হবে বলেও সতর্ক করা হয়েছে। এরপরও মিলাররা এখন পর্যন্ত কোন চালই সরবরাহ করছেন না। তারা আবার অজুহাত দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন বলে জানা গেছে। যদি সময় বাড়ানো যায়, তাহলে এখনই তারা চাল সরবরাহ করবেন না। যদি সময় বাড়ানো না যায় তাহলে হয়তো মাসের শেষ দিকে ২/৩ দিনের মধ্যে বাকি চাল তারা সরবরাহ করবেন। বিষয়টি আঁচ করতে পেরেই সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। আর সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই চালের দাম কমবে। সরকার এবার ৭ লাখ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহের যে লক্ষ্যমাত্র নির্ধারণ করেছিল, সেসব ধান সংগ্রহের পর পুরোপুরি চাল বানানো হয়েছে। এরপরও বাজারে চালের মূল্যবৃদ্ধি রোধে ব্যর্থতার জন্য সরকারের মনিটরিংয়ের অভাবকেই দায়ি করেছেন ভোক্তারা। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, দেশে এ বছর ২৪ হাজার মেট্রিক টন চাল বাড়তি উৎপাদিত হয়েছে। আর খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, এই মুহূর্তে সরকারের গুদামে মজুদ আছে সাড়ে ৭ লাখ মেট্রিক টন চাল। পাইপ লাইনে আছে আরও দেড় লাখ মেট্রিক টন চাল। সব মিলিয়ে ৯ লাখ মেট্রিক টন চাল। ডিসেম্বরে উঠবে আমন ধান। এ বছর আমনেরও বাম্পার ফলন হয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। জানা গেছে, মিলাররা ধান সরবরাহে সংকট দেখিয়ে চালের উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছেন। এ ছাড়া তারা সকাল-বিকাল দাম পরিবর্তন করছেন। তারা সকালে এক রকম রেট দিয়েছেন, বিকালেই তা পরিবর্তন করেছেন। এভাবে তারা পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রায় দু’মাস ধরে চালের বাজারে অস্থিরতা চালিয়েছেন। মিলাররা প্রতি বস্তা চালে মিলগেটেই আগের চেয়ে ৩০০-৪০০ টাকা বেশি দরে বিক্রি করছেন। কারসাজি করে এভাবে বেশি দাম নেয়ায় ঢাকার পাইকারি বাজারগুলোয় চাল আসা একেবারেই কমে গেছে। এখন যে চাল বাজারে রয়েছে, তার বেশিরভাগই ঈদের আগের মজুদ করা। নতুন করে তারা চাল তুলতে চাইছেন না। সামনে আমন মৌসুম। এবার বাম্পার ফলন হবে। আগেভাগেই এ সংবাদ দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। তাই সামনে চালের দাম অবশ্যই কমবে- এমন ধারণা থেকেই অনেকে দাম কমার অপেক্ষায় চাল মজুদ রাখা বন্ধ করে দিয়েছেন। ফলে বাজারে স্বাভাবিক সরবরাহে বিঘœ ঘটেছে। আর এই সুযোগটিও কাজে লাগিয়েছেন মিলাররা। ধান সঙ্কটের কারণে চালের দাম বাড়ছে। মোটা ও স্বর্ণা চালের ধান পাওয়া যাচ্ছে না। অগ্রহায়ণ মাসের ধান ওঠার আগে চালের দাম উর্ধমুখী থাকবে। কমার সুযোগ নেই। এখন যে ধান রয়েছে তার সবই মিলারদের হাতে। এ সুযোগে তারা তাদের ইচ্ছামতো চালের দাম নির্ধারণ করছেন। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, মিলারদের কারসাজি প্রমাণিত হওয়ার পর কঠোর হয়েছে সরকার। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা বলেন, ‘কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে এ্যাকশনে যাওয়ার কথা ভাবছে সরকার। এ ক্ষেত্রে মিলারদের অপরাধ তিনটি। প্রথমত, মিলাররা একদিকে সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী চাল সরবরাহ করেননি। দ্বিতীয়ত, তারা যে দেড় লাখ টন চাল সরবরাহ করেননি, সেই দেড় লাখ টন চালের ঘাটতি দেখিয়ে বাজারে চালের কৃত্রিম সংকটের গুজব ছড়িয়েছেন, জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়েছেন। আর তৃতীয় অপরাধ হচ্ছে- এই গুজবকে কাজে লাগিয়ে অনৈতিক মুনাফা লুটে নিচ্ছেন। নাটোরের মিলার আবদুর রউফ বলেন, এ বছর অতিবৃষ্টির কারণে ধান শুকানো যায়নি। ফলে সরকারের গুদামে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী চাল সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি। এখন আবহাওয়া ভাল হয়েছে। রোদ আছে কাজেই ধান শুকিয়ে চাল বানিয়ে গুদামে সরবরাহ করতে বেশি সময় লাগবে না। সরকার ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত যে সময় দিয়েছে তার আগেই আমরা চাল সরবরাহ করতে পারব। তিনি আরও বলেন, আমাদের বিরুদ্ধে ধান মজুদ করে রাখার যে অভিযোগ উঠেছে, তা সত্য নয়। আমাদের কারসাজিতে চালের দাম বাড়ার যে অভিযোগ উঠেছেও, সেটিও সত্য নয়। আবহাওয়ার কারণেই চালের সরবরাহে বিঘœ ঘটেছে। আশা করছি, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে বাজারে চালের সরবরাহ স্বাভাবিক হবে এবং চালের দামও কমে যাবে। মজুদের অভিযোগ অস্বীকার করে নাটোরের পাইকারি ব্যবসায়ী এ সবুর খান বলেন, এখন কোন পাইকারই চালের মজুদ করেন না। এর কারণ হচ্ছে, ১ মাসের বেশি সময় চাল গোডাউনে রাখলে পোকায় ধরে। তখন বস্তার দাম আগের মতো পাওয়া যায় না। তাই বাধ্য হয়েই সবাই চাল বিক্রি করে দেন। চালের দাম বাড়ার পেছনে আমদানি না হওয়া এবং মিলারদের যোগসাজশকে তিনি দায়ী করেন। খাদ্যমন্ত্রী এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছেন, কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান সংগ্রহের যে প্রক্রিয়া সরকার শুরু করেছে। তা নিয়মিত চলবে। এছাড়া ভারত থেকে চাল আমদানির ক্ষেত্রে যে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা আছে, তাও বহাল থাকবে। কোন অবস্থাতেই ভারত থেকে চাল আমদানির শুল্ক হার কমানো হবে না। কারণ আমাদের চালের আর কোন সঙ্কট নেই। তিনি বলেন, যারা বাজারে চাল সঙ্কট থাকার গুজব ছড়িয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
×