ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঝুঁকিপূর্ণ ঢাকার দুই শতাধিক যাত্রীছাউনি

প্রকাশিত: ০৬:২৮, ১৫ অক্টোবর ২০১৬

ঝুঁকিপূর্ণ ঢাকার দুই শতাধিক যাত্রীছাউনি

মশিউর রহমান খান ॥ রাজধানীতে চলাচলকারী যাত্রীদের ক্ষণিকের বিশ্রামের জন্য যাত্রীছাউনি তৈরি করা হলেও অনুমতি ছাড়া অবৈধ ব্যবহার, দখল আর সংস্কার না করায় অযতœ অবহেলায় অনেকটা গুরুত্বহীন ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে আছে ঢাকার ২ শতাধিক যাত্রীছাউনি। রাজধানীর উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায় এসব যাত্রীছাউনি অবিস্থিত। তবে সকল যাত্রীছাউনিই সিটি কর্পোরেশনের নিয়ন্ত্রিত নয়। এর মধ্যে কয়েকটি সড়ক ও জনপথ অধিদফতর (সওজ), বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশন (বিআরটিসি) ও অন্যান্য সংস্থার অনুমোদিত যাত্রীছাউনি রয়েছে। এসব ছাউনির মধ্যে এমন কিছু যাত্রীছাউনি রয়েছে যেগুলোর অবৈধ দখল এখনই উচ্ছেদ করার প্রয়োজন হলেও সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ রহস্যজনক কারণে তা করছেন না। তাছাড়া সংশ্লিষ্ট অন্য সংস্থাগুলো তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে রহস্যজনক নীরবতা পালন করছে। কর্পোরেশনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর অবহেলা আর অবৈধ দখলে দখলদারদের সহযোগিতা করার কারণে এসব যাত্রীছাউনির কোন রকম উন্নয়ন করা হচ্ছে না। মূলত সিটি কর্পোরেশনের সম্পত্তি শাখা থেকে এসব ছাউনির বরাদ্দ দেয়া হয় এবং রাজস্ব শাখা থেকে এর আয়-ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা হয়ে থাকে। নাগরিকদের চাহিদার প্রেক্ষিতে প্রতিটি বাসস্টপেজেই কমপক্ষে একটি করে যাত্রীছাউনি থাকা প্রয়োজন। কিন্তু যেগুলো আছে সেগুলোও সঠিকভাবে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। ফলে রাস্তায় চলাচলকারী সাধারণ নাগরিকদের প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। নারীবান্ধব তো দূরের কথা কিছু ছাউনিতে রোদ বৃষ্টিতে কোন পুরুষও বিশ্রাম নিতে চান না। আর সন্ধ্যার পর কিছু ছাউনি ও তার আশপাশের এলাকা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। এসব ছাউনিতে কোন আলোর ব্যবস্থা না থাকায় ভয়েই এর কাছে যান না যাত্রীরা। রাজধানীর অধিকাংশ যাত্রীছাউনিই বেদখল হয়ে গেছে। এমন কিছু লোকের আনাগোনা থাকে সেখানে যার ফলে নারী ও সাধারণ যাত্রীরা বসতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। এতে অপেক্ষমাণ যাত্রীরা রাস্তায় নেমে এসে যানজট তৈরি করে পরিবহন চলাচলে বাধার সৃষ্টি করে। ফলে কখনও কখনও যাত্রীদের নানা দুর্ঘটনার শিকার হতে হচ্ছে। ভ্রাম্যমাণ যাত্রীদের সুবিধার্থে গত আশির দশকে এরশাদ সরকারের সময় এসব যাত্রীছাউনি তৈরি করা হলেও দীর্ঘ সময়েও এসব ছাউনিতে তেমন একটা সংস্কার কিংবা উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। এসব যাত্রীছাউনিতে সাময়িক বিশ্রাম অবস্থায় যাত্রীদের সুবিধার্থে একাংশে খাবারের দোকান ও কোন কোন ছাউনিতে পত্রিকার স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়। এসব স্টল থেকে পত্রিকা কিনে যাত্রীরা পড়তে পারতেন বা দোকানগুলো থেকে খাবার ক্রয় করতে পারতেন। বর্তমানে এসব যাত্রীছাউনির বেহাল দশায় সেসব স্থানে নানা পণ্যসামগ্রীর দোকান বসেছে। আবার কোন কোন ছাউনির পুরোটাই দখল করে অবৈধভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছে। সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ এদের উচ্ছেদে নীরবতা পালন করে যাচ্ছে। ভাঙ্গাচোরা লোহা, পুরনো মরচে ধরা স্টিল আর মেয়াদোত্তীর্ণ সিমেন্টের তৈরি এসব ছাউনি দেখলে কেউ আর বিশ্রামের জন্য দাঁড়াতে চান না। ছাউনিগুলোর অবস্থা এতটাই নাজুক যে, কিছু যাত্রী ভুল করে না দেখে এসব ছাউনিতে আশ্রয় নিলেও পরে ছাউনির উপরের দিকে চাওয়া মাত্রই ভয়ে আতকে উঠে সাথে সাথেই এর থেকে সরে পড়েন। আবার কিছু ছাউনি ব্যবহারের সম্পূর্ণ অযোগ্য হয়ে পড়ে রয়েছে। উচ্ছেদের যোগ্য হয়ে পড়ে আছে বেশ কিছু যাত্রীছাউনি। বর্ষায় বৃষ্টি আর গ্রীষ্মে প্রচ- রোদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে ও নির্দিষ্ট স্থানে বাসস্টপেজের সামনে বিশ্রাম নেয়ার জন্য এসব যাত্রীছাউনি তৈরি করা হলেও চলাচলকারী যাত্রীদের জন্য কোন কাজেই আসছে না। উপরন্তু কোন কোন বাসস্টপেজের স্থানে এসব যাত্রীছাউনি অনর্থক ফুটপাতের জায়গা দখল করে গড়ে তোলায় নাগরিকদের চলাচলে ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব ছাউনির কারণে সৃষ্ট সমস্যাসমূহ সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষের গোচরে থাকলেও অজ্ঞাত কারণে এসব উচ্ছেদযোগ্য ছাউনি উচ্ছেদ করা হচ্ছে না। রাজধানীতে বাড়ছে জনসংখ্যা। আর এ বাড়তি জনসংখ্যার চাপে গণপরিবহনও বাড়ছে। এর পরও প্রয়োজনের তুলনায় গণপরিবহন অপ্রতুল হওয়ায় দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বাসে উঠতে হয় যাত্রীদের। তবে অপেক্ষমাণ এসব যাত্রীর জন্য নেই পর্যাপ্ত ছাউনি। ব্যস্ত অনেক বাসস্টপেজের কাছে কোন যাত্রীছাউনিই নেই। ফলে রোদ বা বৃষ্টিতে ভোগান্তিতে পড়তে হয় যাত্রীদের। কিছু কিছু স্থানে যাত্রীছাউনি থাকলেও তার অধিকাংশ ভাঙাচোরা ও ব্যবহার অনুপযোগী। জানা গেছে, গত ফেব্রুয়ারি মাসে ডিএনসিসি কর্তৃক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, তাদের সীমানায় এলাকায় যাত্রীছাউনি রয়েছে ১২৯টি। এর মধ্যে ৯৬টি সিটি করপোরেশনের। এর মধ্যে ১৮টি ছাউনি ডিএনসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সড়ক ও জনপথ, বিআরটিসি (বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন) ও অন্যান্য সংস্থার অনুমোদিত যাত্রীছাউনি রয়েছে ১৫টি। এসব যাত্রীছাউনির মধ্যে ব্যবহারের জন্য ৭৭টিই মেয়াদোত্তীর্ণ। এর মধ্যে চুক্তি নবায়ন হয়েছে ৬১টির। আর সংস্কারযোগ্য যাত্রীছাউনি রয়েছে ১০টি। এছাড়া উচ্ছেদযোগ্য ১৩টি যাত্রী ছাউনি রয়েছে। দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) সূত্রে জানা গেছে, সিটি করপোরেশন বিভক্ত হওয়ার পর ডিএসসিসি এলাকায় ৮৬টি যাত্রী ছাউনি ছিল। এর মধ্যে একটি মোবাইল অপারেটর কোম্পানিকে ৫৭টি যাত্রীছাউনি ইজারা দেয়া হয়। তারা ৩২টি যাত্রী ছাউনি নির্মাণ করে। এছাড়া অন্যান্য বেসরকারী কোম্পানি আরও ২৯টি যাত্রীছাউনি নির্মাণ করে। মোট ৬১টি যাত্রী ছাউনি ২০০৭ সালে চুক্তির মাধ্যমে পাঁচ বছর মেয়াদে বরাদ্দ দেয়া হয়, যা ২০১২ সালে শেষ হয়েছে। জানা গেছে, এরপর ডিএসসিসি নতুন করে আর কোন যাত্রীছাউনির অনুমোদন দেয়নি বা নবায়ন করা হয়নি। বর্তমানে ডিএসসিসির সব যাত্রীছাউনিই মেয়াদোত্তীর্ণ। দুই সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন দেখা গেছে, আবদুল্লাহপুর যাওয়ার পথে বিমানবন্দর বাসস্টপেজের সামনের ছাউনিটির বসার স্থানের রড বের হয়ে বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। শেওড়া বাসস্ট্যান্ডের দুটি ছাউনিতেই বসার জায়গা নেই। ফার্মগেটের আনন্দ সিনেমা হলের উল্টো দিকের যাত্রী ছাউনিতে নিচে সিরামিকের তৈরি বসার জায়গা থাকলেও উপরে ছাদ নেই। কিছু জং ধরা স্টিল এবড়ো-থেবড়োভাবে মাথার উপর ঝুলছে। গুলিস্তানে স্টেডিয়ামের উল্টো দিকে বাসস্টপেজের সামনের যাত্রীছাউনির পুরোটাই হকারদের দখলে। প্যান্ট, শার্টসহ রয়েছে রকমারি বেল্টের দোকান। যাত্রী বসার ব্যবস্থা তো দূরের কথা, দোকানিদের জায়গা দখলের কারণে ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাওয়াই দুষ্কর হয়ে পরেছে। বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনের যাত্রী ছাউনিতে ভাজাপোড়া তৈরি করে বিক্রি করা হচ্ছে। কাকরাইল মোড়ের দিকে যাওয়ার পথে শান্তিনগরের যাত্রীছাউনিটির উপরের ছাদ খসে পড়েছে। মূলত রাজধানীর বিভিন্ন স্থানের যাত্রীছাউনির চিত্র একই রকমই। এছাড়া ফার্মগেট থেকে শাহবাগে যেতে শাহবাগ মোড়ে যাত্রীছাউনি থাকলেও বাংলামোটরের কোন স্থানেই কোন যাত্রীছাউনি নেই। অথছ নিয়মিত সব বাস থামানো হয় সেখানে। কারওয়ান বাজার ও ফার্মগেটের মাঝামাঝি একটি ছাউনি থাকলেও সেখানে বাস থামে না কখনই। ফলে যাত্রীদের কোন উপকারেই আসছে না এটি। মতিঝিলে যাওয়ার পথে মওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামের সামনে প্রচুর যাত্রী বাসের অপেক্ষায় থাকলেও সেখানে কোন যাত্রীছাউনি রাখা হয়নি। মূলত সময়ের সাথে সাথে প্রয়োজন বাড়লেও নতুন করে নতুন স্থানে চলাচলকারীদের সুবিধার্থে কোন যাত্রীছাউনি তৈরি করা হয়নি। এছাড়া পুরনো ছাউনিগুলো তেমন একটা কাজে না আসায় যাত্রী হয়রানি চরম আকার ধারণ করেছে। সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ এসব যাত্রীছাউনির একটি অংশ ভাড়া দিয়ে রাজস্ব আয় করলেও এসব ছাউনি সংস্কারে বা ব্যবহার উপযোগী করার দিকে তেমন কোন মনযোগ নেই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মোঃ আমিনুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, যাত্রীছাউনিগুলো দীর্ঘ বছর আগে তৈরি করায় বেশ কিছু যাত্রীছাউনি ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পরে আছে। এসব যাত্রীছাউনি যাত্রীদের তেমন কোন কাজে আসছে না। তবে এর মধ্যে ফার্মগেট, শ্যামলী, আসাদগেট এলাকায় রক্ষণাবেক্ষণ চুক্তির মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় ছাউনিগুলো ইতোমধ্যেই ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। এসব স্থানে নতুন করে আধুনিক ছাউনি নির্মাণ করা হবে। যাত্রীছাউনিগুলো অনেক পুরাতন ও কয়েকটি যাত্রীছাউনি সম্পূর্ণ ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। তাই ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ যাত্রীদের বিশ্রামের সুবিধার কথা চিন্তা করে এ উদ্যোগ হাতে নেয়া হয়েছে। এছাড়া ভবিষ্যত ঢাকার পরিবহন পরিকল্পনার সঙ্গে মিল রেখে জরিপ করে যেসব স্থানে নতুন জায়গায় ছাউনি নির্মাণ করা প্রয়োজন সেসব স্থানে নতুন করে যাত্রীছাউনি তৈরি করা হবে। এসব ছাউনি সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ নিজ দায়িত্বে পরিচালনা করবে। কোন বিজ্ঞাপনী সংস্থা বা ব্যক্তিকে এর রক্ষণাবেক্ষণ করতে দেয়া হবে না। এর ফলে এসব যাত্রীছাউনির বর্তমান অবস্থাই পাল্টে যাবে। এ বিষয়ে কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
×