ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাবান্ধায় বেপরোয়া চাঁদাবাজি

প্রকাশিত: ০৬:০৮, ৩ অক্টোবর ২০১৬

বাংলাবান্ধায় বেপরোয়া চাঁদাবাজি

স্টাফ রিপোর্টার, পঞ্চগড় ॥ বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে পণ্যবাহী ট্রাক থেকে চলছে বেপরোয়া চাঁদাবাজি। দীর্ঘদিন ধরে চলা এই চাঁদাবাজি নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বরাবরে একাধিকবার অভিযোগ করলেও চাঁদাবাজি বন্ধে কোন উদ্যোগ নেই। এই স্থলবন্দরটি চালুর পরেই বন্দরের সার্বিক কার্যক্রম সুযোগসন্ধানী ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রণের চলে যায়। তাদের অবৈধ কর্মকা-ে প্রতিনিয়তই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম। বর্তমান অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কারও টু শব্দটি ্উচ্চারণ করার সাহস নেই। এসব সুযোগসন্ধানী ব্যক্তি দলীয় প্রভাব খাটিয়ে প্রকাশ্যে পণ্যবাহী ট্রাক থেকে চাঁদাবাজি করলেও দেখার কেউ নেই ! অভিযোগে জানা যায়, চলতি বছর ১৮ ফেব্রুয়ারি স্থলবন্দর দিয়ে মানুষ পারাপার কার্যক্রম শুরু হয়। আর তখন থেকেই পঞ্চগড় আমদানি ও রফতানিকারক এ্যাসোসিয়েশন নামের সরকারী অনুমোদনবিহীন একটি সংগঠন উন্নয়ন তহবিলের নামে ভারতীয় পণ্যবাহী প্রত্যেক ট্রাক থেকে এক শ’ করে ভারতীয় রুপী চাঁদা নেয়া শুরু করে। এতে কয়েকমাসে প্রায় অর্ধ কোটি টাকা আদায় করা হয়। কিন্তু আদায়কৃত টাকার মধ্যে প্রায় ৩০ লাখ টাকার হিসাবে গড়মিল থাকায় সংগঠনটির মধ্যে মতবিরোধ ও অসন্তোষ দেখা দেয়। এক পর্যায়ে গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে ওই সংগঠনটির সুযোগসন্ধানী প্রভাবশালীরা ভারতীয় ট্রাক থেকে চাঁদা তোলা বন্ধ করে দেয়। এরপর ওই প্রভাবশালীরাই নাম পাল্টিয়ে ‘ইউনিয়ন পরিষদ গরিব ব্যবস্থাপনা তহবিল ও বন্দর শ্রমিক কল্যাণ তহবিলের’ নামে রশিদ ছাপিয়ে আবার প্রতি ট্রাক থেকে এক শ’ করে ভারতীয় রুপী চাঁদা তোলা শুরু করে এবং নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে নিচ্ছে। সরেজমিন দেখা যায়, বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের প্রধান ফটকের পাশে সিরিয়াল বক্সের ঘরে বসে দুই যুবক প্রত্যেক ট্রাক থেকে রশিদ দিয়ে ভারতীয় এক শ’ রুপী চাঁদা তুলছেন। এরা হলো- কুলি শ্রমিক নেতা সাদেকুল ইসলাম ও বাবুল হোসেন । গণ্যমাধ্যম কর্মীদের দেখে রশিদ বই ফেলে পালিয়ে যায় তারা। এ সময় ভারতীয় ট্রাক চালক নীলাম্বর ঝা ও সালাঙ্গা নাগাসিয়া অভিযোগ করে বলেন, ভারতীয় রুপীতে এক শ’ চাদা না দিলে ইদ্রিস আলী ও রহমান মেম্বার নামের দুই কুলি শ্রমিক নেতার নির্দেশে সেখানে দায়িত্বরত শ্রমিক ট্রাকের সিরিয়াল দেয় না। সিরিয়াল বক্সে দায়িত্বরত বন্দরের নিরাপত্তাকর্মী বাবুু আহমেদ জানান, জোর করে এই বক্সে বসে তারা চাঁদা তুলছেন। শ্রমিকদের কল্যাণের নামে চাঁদা তোলা হলেও শ্রমিকদের কল্যাণে ব্যয় করা হয় না। কোন শ্রমিক উত্তোলিত এই চাঁদার হিসাব জানেন না। কোন ব্যাংক হিসাবও নেই। তাই অবৈধ এই চাঁদা তোলা নিয়ে গণ্যমাধ্যম কর্মীদের সামনে সাধারণ শ্রমিকরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা আমদানিকারক এ্যাসোসিয়েশনের এক নেতা, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও দুই কুলি শ্রমিক নেতার নাম উল্লেখ করে বলেন তারাই এসব চাঁদা ভাগবাটোয়ারা করে নেন। শনিবারও পণ্যবাহী ট্রাক থেকে চাঁদা তোলাকে কেন্দ্র করে চাঁদাবাজদের সঙ্গে সাধারণ শ্রমিকদের মধ্যে হট্টগোল হয়। স্থলবন্দরটিতে নানা অনিয়মের কথা তুলে ধরে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েক ব্যবসায়ী জানান, ওই সুযোগসন্ধানী প্রভাবশালী সিন্ডিকেটটি রাজস্ব ফাঁকিসহ নানা অনিয়মের সাথে যুক্ত রয়েছে। তাদের অভিযোগ, প্রত্যেক পরিবহন থেকে ভারতীয় এক শ’ রুপী করে চাঁদা নেয়া হচ্ছে আমদানি-রফতানিকারক এ্যাসোসিয়েশন, বাংলাবান্ধা ইউনিয়ন পরিষদ এবং বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর কুলি শ্রমিক ইউনিয়নের নামে । এক হিসেবে দেখা গেছে প্রত্যেক কর্মদিবসে এই বন্দরে আসা দুই শতাধিক পণ্যবাহী ভারতীয় ট্রাক থেকে অবৈধ চাঁদা নেয়া হচ্ছে। অথচ এসব দেখার কেউ নেই বলে ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন। বাংলাবান্ধা কুলি শ্রমিক ইউনিয়নের সচিব বাবুল হোসেন একটি রশিদ প্রদান করে এই টাকা তোলেন। তিনি জানান, এই টাকার একটি অংশ বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর আমদানি -রফতানিকারক এ্যাসোসিয়েশন এবং বাংলাবান্ধা ইউনিয়ন পরিষদকে দেয়া হয়। আদায়কৃত টাকার ১০ ভাগ দেয়া হয় কুলি শ্রমিক ইউনিয়নকে। বন্দরের সহকারী মহাব্যবস্থাপক রজব আলী বলেন, সিরিয়াল বক্সে বসে চাঁদা তোলা না করে দিয়েছি। এটা করতে না দিলে আমাকে হুমকি দেয়। আমি অসহায়।’ পঞ্চগড় আমদানি-রফতানিকারক এ্যাসোসিয়েশনের কল্যাণ ফান্ডের নামে এই টাকা উত্তোলন করা হলেও তা আসলে কয়েক নেতাই ভাগ-বাটোয়ারা করে নিচ্ছেন। এই এ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি তফিজুল ইসলাম (টি ইসলাম) জানান, কোন ব্যবসায়ীই প্রক্রিয়াটির পক্ষে নয়। এই চাঁদার জন্য ভারতীয় ব্যবসায়ীরা পাথরের মূল্য বৃদ্ধি করেছেন। ফলে আমদানিকারকরা এই বন্দরে ব্যবসা করতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। এ্যাসোসিয়েশনের নামে চাঁদা তোলা বন্ধ করে এখন খোলস পাল্টিয়ে নতুন নামে চাঁদা তোলা হচ্ছে। এই এ্যাসোসিয়েশনের কোষাধ্যক্ষ মোজাফ্ফর হোসেন জানান, আদায়কৃত এই টাকার হিসাব আমার কাছে নেই। শুরু থেকেই বিরোধিতা করছি বলে আমাকে হিসাব জানানো হয় না। এই এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মেহেদী হাসান খান বাবলা জানান, ব্যাবসায়ীদের কল্যাণের জন্য এই টাকা তোলা হয়েছিল। ১০ লাখ টাকা আদায় হয়েছে। তা থেকে কল্যাণমূলক বিভিন্ন কাজ এবং ইফতার পার্টিতে খরচ হয়েছে ছয় লাখ। চার লাখের মতো জমা আছে । এ্যাসোসিয়েশনের নামে চাঁদা তোলা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বর্তমানে চাঁদা তোলার সঙ্গে এ্যাসোসিয়েশনের কোন সম্পর্ক নেই। অনেক ব্যবসায়ী অভিযোগ করে বলেন, বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর থেকে শুরু করে ঘাটে ঘাটে চাঁদা দিতে হচ্ছে । চাঁদা আদায়ের রশিদে আদায়কারী তিন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদের নাম উল্লেখ থাকলেও সরকারীভাবে কোন অনুমোদন নেই। এ প্রসঙ্গে বাংলাবান্ধা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান কুদরত-ই-খুদা মিলন ইউনিয়ন পরিষদের নামে চাঁদাবাজির অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, কে বা কারা চাঁদা তুলছে আমি জানি না। তবে ভারতীয় ট্রাক থেকে তিনি চাঁদা তোলার পক্ষে মত ব্যক্ত করে বলেন, তাতে ক্ষতি কি। অবৈধভাবে ভারতীয় ট্রাক থেকে চাঁদা তোলার বিষয়টি জেলা প্রশাসক অমল কৃঞ্চ ম-লের নজরে আনা হলে তিনি বিষয়টি দেখবেন বলে জানিয়েছেন।
×