ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতার অভিশাপমুক্ত হচ্ছে ২০ লাখ বাসিন্দা

প্রকাশিত: ০৬:০০, ২৬ আগস্ট ২০১৬

দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতার অভিশাপমুক্ত হচ্ছে ২০ লাখ বাসিন্দা

আনোয়ার রোজেন ॥ ডিএনডি এলাকার পূর্ব দোলাইরপাড়ের স্থায়ী বাসিন্দা সাইফুদ্দিন আলম। কাজ করেন ঢাকার একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে। তীব্র গরমের পর বৃষ্টি হলেও স্বস্তি পান না সাইফুদ্দিন। উল্টো অল্প বৃষ্টিতেই দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ে তার কপালে। কারণ অল্প বৃষ্টিতেই দোলাইরপাড়সহ ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা (ডিএনডি) বাঁধ এলাকার বিভিন্ন জায়গায় দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। কাঁচাবাজারে পানি উঠে যায়। সমস্যা হয় যাতায়াতে- রিকশা, অটোরকিশা কিছুই চলে না। বাড়িতে ওয়াসার কল খুললেই আসে ময়লা পানি। সবমিলিয়ে দুর্বিষহ অবস্থা। দীর্ঘদিন ধরে সাইফুদ্দিনের মতো ডিএনডি এলাকার প্রায় ২০ লাখ মানুষ এমন মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছেন। অবশেষে দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতার এই ‘অভিশাপ’ থেকে মুক্তি পেতে যাচ্ছেন তারা। ডিএনডি ৫৭ কিলোমিটার বাঁধ এলাকার নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়নে নেয়া হয়েছে ৫৫৮ কোটি টাকার প্রকল্প। প্রকল্পের আওতায় বাঁধের ভেতরের জলাবদ্ধতা কমানোর কাজ শুরু হবে শীঘ্রই। আগামী বছরের বর্ষা থেকেই বাঁধ এলাকায় কমে আসবে জলাবদ্ধতার প্রকোপ। ডিএনডি বাসিন্দাদের জীবনমান হবে উন্নত। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ঢাকা কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, ‘ডিএনডি এলাকার নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন (২য় পর্যায়)’ শীর্ষক একটি প্রকল্প সম্প্রতি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায়(একনেক) চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়েছে। ৫৫৮ কোটি টাকার এই প্রকল্পের কাজ শুরুর পর আগামী বর্ষায়ই ডিএনডি বাঁধ এলাকায় জলাবদ্ধতা কমে আসবে। তবে পুরো ফল পাওয়া যাবে তিন বছর পর কাজ শেষ হলে। প্রকল্প এলাকার মধ্যে রয়েছে ঢাকা জেলার ডেমরা, যাত্রাবাড়ী ও শ্যামপুর উপজেলা এবং নারায়ণগঞ্জ জেলার সদর উপজেলা। সূত্র জানায়, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে ১৯৬২-১৯৬৮ সময়কালে ‘ডিএনডি এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নিষ্কাশন ও সেচ (১ম পর্যায়)’ শীর্ষক একটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়। প্রকল্পের আওতায় শিমরাইলে কৃষি সেচের জন্য গড়ে ওঠে একটি পাম্পহাউস। জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষার জন্য পাম্পহাউসের ওপরই নির্ভরশীল হয়ে পড়ে বাঁধ এলাকা। সেখানে ১২৮ কিউসেক পানি নিষ্কাশনক্ষমতার চারটি পাম্প ও কয়েকটি ছোট পাম্প স্থাপন করা হয়। কিন্তু ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার পর বাঁধের নিষ্কাশন ব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আবার দ্রুত নগরায়ণের ফলে ডিএনডি এলাকার জমি ব্যবহারে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা দেয়। কৃষি জমিগুলো বাসভবন, শিল্প প্লট এবং রাস্তায় রূপান্তরিত হয়ে যায়। গুরুত্বপূর্ণ খাল, ড্রেন চলে যায় অবৈধ দখলে। ভূমির ব্যবহারের পরিবর্তনের কারণেও পানি নিষ্কাশনে সৃষ্টি হয় প্রতিবন্ধকতা। এমন পরিস্থিতিতে ‘ডিএনডি এলাকার নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন’ শীর্ষক একটি প্রকল্প ২০০৬-২০০৯ সাল মেয়াদে বাস্তবায়ন করা হয়। তবে এতেও জলাবদ্ধতা পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি। বৃষ্টি হলেই বাঁধের ভেতরের এলাকা ডুবে যায়। বর্তমান সরকারের প্রথম মেয়াদের শেষের দিকে নারায়ণগঞ্জ সফরে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ডিএনডি এলাকার এই সমস্যা দূরীকরণে প্রতিশ্রুতি দেন প্রকল্প প্রণয়নের। প্রধানমন্ত্রীর দেয়া সেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ব্যাপক আকারে প্রকল্পের কার্যক্রম গৃহীত হয়েছে। পাউবোর ঢাকা কেন্দ্রের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কাজ শুরুর পর আগামী বর্ষার আগেই কিছু সুবিধা পাওয়া যাবে। তবে প্রকল্পের পুরো ফল পাওয়া যাবে কাজ শেষ হলে। প্রকল্প এলাকায় অনেকগুলো সংস্থার কার্যক্রম বিদ্যমান। তাই প্রকল্পের কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন একযোগে কাজ করবে। বাঁধের ভেতর প্রচুর জমি রয়েছে। এর মধ্যে অনেক জায়গায় অপরিকল্পিত এবং অবৈধভাবে বাড়ি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। প্রকল্পের সুষ্ঠু বাস্তবায়নে এসব অবৈধ স্থাপনা অপসারণে সংশ্লিষ্ট সংস্থার সহযোগিতা নেয়া হবে। প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে ডিপিপিতে (ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল) বলা হয়েছে, ডিএনডি এলাকায় নতুন পাম্প স্টেশন ও পাম্পিং প্লান্ট স্থাপন, বর্তমান পাম্প স্টেশন পুনর্বাসন, সেচ খাল ও নিষ্কাশন খাল পুনঃখনন এবং ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মাণের মাধ্যমে নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন করা হবে। এছাড়া এলাকার জনগণের স্বাভাবিক জীবনমান নিশ্চিতকরণ, সর্বোপরি আর্থ-সামাজিক ও পরিবেশগত মান উন্নয়ন এবং প্রকল্প এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নও এর অন্যতম উদ্দেশ্য। প্রকল্পের কার্যক্রমের আওতায় ১০ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করা হবে। নতুন পাম্পহাউস করা হবে দুটি। একটি পাম্পহাউস আদমজী নগরে এবং আরেকটি হবে শিমরাইলে পুরনো পাম্পহাউসের পাশে। এ ছাড়া শিমরাইলে ৭টি, আদমজী নগরে ৬টি, শ্যামপুরে ২টি, পাগলায় ১০টি ও ফতুল্লায় ছোট-বড় ১২টি পাম্পস্টেশন বসানো হবে। এসব পাম্পহাউস ও স্টেশন বসানোর পর শুরু হবে বাঁধের ভেতরে প্রায় ৯৪ কিলোমিটার দীর্ঘ খাল সংস্কারের কাজ। অন্য কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে- ১২ টি আরসিসি গার্ডার ব্রিজ নির্মাণ, বিদ্যমান ৫২টি ব্রিজ ও কালভার্ট মেরামত, ৩২ হাজার ৫০০ ঘনমিটার অতিরিক্ত সংযোগ খাল পুনঃখনন, সাড়ে ১৩ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে নির্মাণ ইত্যাদি। ২০২০ সালের জুন মাসে প্রকল্পটির কাজ শেষ হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
×