ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে চালকরা হরহামেশা দুই থেকে পাঁচ গুণ বেশি ভাড়া আদায় করছে

নগরজীবনের যন্ত্রণা সিএনজিচালিত অটোরিকশা

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ২০ আগস্ট ২০১৬

নগরজীবনের যন্ত্রণা সিএনজিচালিত অটোরিকশা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ নগরজীবনের এক যন্ত্রণার নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা। হওয়ার কথা ছিল রাজধানীর উচ্চমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের অন্যতম ভরসার বাহন। জনসাধারণের সেবার জন্য এগুলো রাস্তায় নামানো হয়েছিল। কিন্তু চালকদের বেপরোয়া আচরণের কারণে এই অটোরিকশা এখন এক ভোগান্তির নাম। কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে চালকরা হরহামেশা দুই থেকে পাঁচ গুণ বেশি ভাড়া আদায় করছেন যাত্রীদের কাছ থেকে। মিটার থাকলেও বেশির ভাগ চালক মিটারে যেতে চান না। আবার মিটারে গেলেও ভাড়া উঠছে অস্বাভাবিক। কোন যানজট ছাড়া মোহাম্মদপুর থেকে উত্তরা যেতে ভাড়া উঠে ২৬২ টাকা। অথচ দিল্লী শহরে এ প্রন্ত থেকে ওপ্রান্ত গেলেও একশ টাকার বেশি ভাড়া উঠে না। আবার স্বল্প দূরত্ব হলে তো কোনোভাবেই চালকদের রাজি করানো যায় না। এতে প্রতিদিন হয়রানির শিকার হচ্ছেন অসংখ্য মানুষ। চালকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা যাত্রীদের একধরনের জিম্মি করে দ্বিগুণেরও বেশি ভাড়া আদায় করেন এবং মিটারে না গিয়ে যাত্রীদের চুক্তিতে যেতে বাধ্য করেন। আবার কোনো চালক মিটারে যেতে রাজি হন অদ্ভুত এক শর্তে- ‘মিটারে যা উঠবে তার থেকে ৫০ টাকা বেশি দিতে হবে’। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) নিয়ম অনুযায়ী, একজন যাত্রীকে তার পছন্দমতো জায়গায় নির্দিষ্ট মিটারে নিয়ে যেতে একজন চালক বাধ্য। তিনি কোনোভাবেই তাকে ‘না’ বলতে পারবেন না। মিটার ছাড়া কোনো অবস্থায় চুক্তিতে যাত্রী বহন করতে পারবেন না। কিন্তু এখন অটোরিকশা চালকরা সেই নিয়মের ধারেকাছেও নেই। ভুক্তভোগীরা বলেন, সেবার নামে সিএনজিচালিত অটোরিকশা জনসাধারণের ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন সময় অভিযোগ ও অভিযান চালিয়েও বন্ধ করা যাচ্ছে না চালকদের দৌরাত্ম্য। বিশেষজ্ঞরা বলেন, অটোরিকশা যাত্রীরা প্রতিদিন প্রতারণার শিকার হয়ে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। তারা চালকদের খামখেয়ালির কাছে অসহায়ের মতো আত্মসমর্পণ করছেন। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সাম্প্রতিক এক জরিপ দেখা যাচ্ছে, গত বছর নবেম্বরে বাড়তি ভাড়া কার্যকরের পর ৬২ শতাংশ সিএনজি অটোরিকশা চালকই তা মানেন না। বকশিশ দাবি করেন ৮১ শতাংশ। আর যাত্রীদের পছন্দের গন্তব্যে যেতে চান না ৭৩ শতাংশ চালক। আর মিটার নেই ৩৮ শতাংশ অটোরিকশায়। গত রবিবার সকাল ১০টায় জিগাতলা থেকে গুলিস্তান যাবেন মোহাম্মদ বেলাল হোসেন। পেশায় তিনি চাকরিজীবী। সকাল সোয়া ৯টা থেকে দাঁড়িয়ে আছেন বাসের জন্য। কিন্তু কোনো বাসে উঠতে পারছেন না ভিড়ের কারণে। তাই বাধ্য হয়ে অটোরিকশায় যাওয়ার উদ্যোগ নেন। কিন্তু অটোরিকশা ভাড়া করতে গিয়ে তিনি পড়েন বিপাকে। কোনো চালকই মিটারে যেতে রাজি হচ্ছেন না। তারা জিগাতলা থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত ভাড়া চাইছেন ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। একপর্যায়ে তিনি বাধ্য হয়ে চালকের চাহিদা মতো টাকায় অটোরিকশায় ওঠেন। কিন্তু অটোরিকশা ছাড়াও হয় চালকের মর্জিতে। বেলাল হোসেন অটোরিকশায় ওঠার পর চালক নেমে যান পান কেনার জন্য, হেলেদুলে হাটেন, যাত্রীর ব্যাপারে কোন গুরুত্ব নেই। এ সময় কথা বলতে চাইলে বেলাল হোসেন কিছুটা হতাশ কণ্ঠে চাপা ক্ষোভ নিয়ে বলেন, ‘সরকারের উচিত যারা মিটারে যাচ্ছে না তাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স বাতিল করে দেওয়া। তাহলেই হয়তো এই চালকদের শিক্ষা হবে।’ একজন সিএনজি অটোরিকশাচালকের দৈনিক আয় সম্পর্কে জানতে কথা হয় চালক বসির মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘অটোরিকশামালিক প্রতিদিন এখন একটি গাড়িকে দুবার ভাড়া দেন। ভোর ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত এক শিফট, আবার রাত ১০টা পর্যন্ত আরেক শিফট। গাড়িভাড়া প্রতি শিফটে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা নেওয়া হয়। চালক এককভাবে দুই শিফটের জন্য নিলে সাড়ে ৯০০ টাকা থেকে হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়। কিন্তু কিছু মালিক আবার তিন শিফটে গাড়ি ভাড়া দেন। রাতেও তারা বাড়তি একটি শিফট করেছেন।’ বসির মিয়া বলেন, ‘কোনো ড্রাইভার প্রতিবাদ করলেই পরে আর সেই ড্রাইভারকে মালিক গাড়ি দেন না। গাড়ির চেয়ে ড্রাইভার বেশি হওয়ায় মালিকরা এ সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছেন। ফলে ড্রাইভাররাও কোনো ঝামেলায় জড়াতে চান না মালিকের সঙ্গে। মালিকের কথাই আইন মেনে নিয়ে বাধ্য হয়েই চুপচাপ থাকেন। আর মালিকের বাড়তি চাপে তারা বাধ্য হয়েই যাত্রীসাধারণের পকেট কাটেন।’ এ বিষয়ে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামছুল হক বলেন, ‘মূলত সরকারি কর্তৃপক্ষই গণপরিবহনে বিশৃঙ্খলার জন্য দায়ী। পরিবহন ব্যবসায়ীদের কাছে নতজানু নীতির কারণ, পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই।’ তিনি বলেন, ‘চালকরা নিয়ম না মানলে রেজিস্ট্রেশন বাতিল করা উচিত। কারণ, মালিকরা এমন শর্তেই গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নেন। কিন্তু গাড়ি রাস্তায় নামার পর তারা মুহূর্তেই শর্তের কথা ভুলে যান। এ জন্য নিয়ম ও আইন করার পাশাপাশি তদারকি জোরদার করা খুব জরুরি।’
×