ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রূপ-অরূপের আলো

প্রকাশিত: ০৬:৫১, ১৩ আগস্ট ২০১৬

রূপ-অরূপের আলো

ইশকুলে যেতে কার ভাল লাগে? সবাই বলে ইশকুল মানে বন্দীশালা। জেলখানা। কবি ঠিকই তাঁর কবিতায় লিখেছেন- দুপুর যখন রোদের নূপুর বাজাবে একটানা ঘণ্টা গুণেই ভাবি আমি পাঠশালা জেলখানা। হ্যাঁ, পাঠশালা মানেই তো জেলখানা। ছুটি হলেই যেন আনন্দ, ছুটি হলেই স্বাধীনতা পাই যেন। ইশকুল বিষয়ে সকলের যখন এমন মন্দ ধারণা, ঠিক তখন আয়মানের কথায় নতুন ভাবনা ভাবতে হয়। আয়মানদের ইশকুল নাকি আনন্দভুবন। কেবল আনন্দ, হাসি আর গান। এর মধ্যে লেখাপড়া। তাই আয়মান বলে, ইশকুল বন্ধ থাকলে তার ভাল লাগে না। বলে কী মেয়েটা? এরকম আনন্দ ইশকুল কি বাংলাদেশে আছে? সবাই ইশকুলকে ভয় পায়, আর ইশকুল বন্ধ থাকলে তার মন খারাপ হয়! আশ্চর্য! আয়মান আজ সকাল থেকেই অন্যরকম মেজাজ নিয়ে আছে। বলা যেতে পারে আনন্দ-বেদনা। বেদনাটা এজন্য যে আজ ১৫ আগস্ট। জাতীয় শোক দিবস। ১৯৭৫ সালের এদিনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল। তার জন্য পুরো জাতি আজ শোক প্রকাশ করবে, স্মরণ করবে বঙ্গবন্ধুর অবদান। আর আনন্দটা এ কারণে যে আজও আয়মান ইশকুলে যেতে পারবে। আজ সরকারী ছুটির দিন হলেও আয়মানদের ইশকুল খোলা। শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি আবশ্যিক না হলেও আগ্রহীদের ইশকুলে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে এবং বঙ্গবন্ধু স্মরণে আয়োজিত অনুষ্ঠানমালায় অংশ নিতে পারবে। আয়মান খুশি, কারণ সে বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানাতে পারবে এবং ইশকুলে গিয়ে তার সময়টা কাটাতে পারবে। ইশকুল বন্ধ থাকলে তার ভাল লাগে না। ঘরে সময় কাটাতে হয় খুব কষ্টে। বাবা অফিসে চলে যান। মা থাকেন ঘরের কাজ নিয়ে। ভাইয়াটাও বাইরে ঘুরতে যায়। কেবল আয়মান নিজের সঙ্গে নিজে খেলা করে। সে কোথায় যেন পড়েছে- যে যার কাজে বেজার মানুষ ফুলপাখি গাছপালা আমি তবে কার কাছে যাই সাজাই কথার মালা? আয়মান বুঝতে পারে, ঘরের সমস্ত জিনিসপত্র যে যার মতো ব্যস্ত। কেউ নেই তার সঙ্গে গল্প করার। তাই ছুটি মানে তার কাছে কষ্ট। ইশকুল মানে আনন্দ। আজ ভোরে ইশকুলে চলে যায় আয়মান। রাস্তার মোড়ে মোড়ে মাইক থেকে ভেসে আসে বজ্র কণ্ঠস্বর: ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ’। পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী হলেও সে বুঝতে পারে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু যে ঐতিহাসিক ভাষণটি দিয়েছেন, তার কোনো তুলনা নেই। এই বক্তৃতা প্রতিদিন বাজানো হয় না। আজ বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করে তাঁর দরাজ কণ্ঠ শোনানোর উদ্যোগ নিয়েছেন ভক্তরা। এই ভাষণ আয়মান শুধু আজ শোনেনি, আগে আরও অনেকবার শুনেছে। শুনে সে তার বাবার কাছে জানতে চেয়েছিল, এ রকম ভাষণ পৃথিবীতে আর কেউ দিয়েছেন কিনা! আজ শুনল আবার : রক্ত আরও দেব...। হ্যাঁ, বঙ্গবন্ধু নিজেকে শেষ পর্যন্ত রক্তই দিতে হয়েছে। সপরিবারে রক্ত দিয়ে তিনি বাংলাদেশকে ধুয়ে দিয়েছেন। ইশকুলে গিয়ে আয়মান দেখতে পায় তার বান্ধবীরাও উপস্থিত। সবাই জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছে। শুরু“হলো আলোচনা সভা। মঞ্চে ইশকুলের প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডাম আছেন, সঙ্গে আরও কয়েকজন শিক্ষক। তাঁরা একে একে বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছেন, বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন। এমন সময় বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের ক্যামেরা নিয়ে পুরো একটা টিম মিলনায়তনে প্রবেশ করল। এই দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিশিষ্ট আবৃত্তিশিল্পী ও উপস্থাপক আয়েশা হক শিমু। তিনি আলোচকদের কিছু কিছু বক্তব্য ধারণ করলেন এবং পরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথোপকথনে অংশ নিলেন। একজন ছাত্রীকে তিনি প্রশ্ন করলেন- বঙ্গবন্ধুকে কেন আমরা ভালবাসি? ছাত্রীটির জবাব শুনে উপস্থাপক নিজেই অভিভূত। ছাত্রীটি বলল : বঙ্গবন্ধুকে আমরা ভালবাসি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের জাতির পিতা। তাঁর জন্যই এদেশ স্বাধীন হয়েছে। আজ মাইকে যে বজ্রকণ্ঠ বাজিয়ে শোনানো হচ্ছে, সে কণ্ঠটি বেজেছিল একাত্তর সালে। ওই কণ্ঠই সমগ্র বাঙালীর ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছিল। আজ বঙ্গবন্ধু নেই, কিন্তু তাঁর নেতৃত্বে ছিনিয়ে আনা বাংলাদেশ আছে। এই বাংলাদেশের স্রষ্টা হিসেবে তাঁকে শ্রদ্ধা করি। ছাত্রীটি এত সাবলীল ও সহজভাবে বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানালো, তাতে উপস্থাপকসহ অন্যরা বেশ স্বস্তি পেলেন। তাঁরা দেখলেন নতুন প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুকে ঠিকভাবেই চিনতে পেরেছে। তাদের মূল্যায়ন যথার্থ। এবার উপস্থাপক এলেন আয়মানের কাছে। জানতে চাইলেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কোনো কবিতা তার মুখস্থ আছে কিনা! আয়মান তখনই আবৃত্তি করে শোনালো প্রিয় একটি কবিতা : ‘পুব আকাশে সূর্য ওঠে রাত আকাশে চাঁদ রাত্রিদিনের আজব খেলায় এ বড় সংবাদ। জ্বলতে জ্বলতে নিভতে থাকে নিভতে নিভতে জ্বলে কখনো হয় তীক্ষè প্রখর কখনো টলটলে। কিন্তু দেশের এই আকাশে এমন গ্রহ আছে লক্ষ মনে নাচতে থাকে লক্ষ মনে নাচে। সেই গ্রহটি বঙ্গবন্ধু মুজিব রহমান রক্তে কেনা ইতিহাসে তাঁর কথা অম্লান।’ আবৃত্তি শুনে সকলেই অভিভূত। আসলে আমাদের এই প্রিয় বাংলাদেশে নতুন প্রজন্ম যদি এভাবেই গড়ে ওঠে, তাহলে আমাদের আর কোন ভাবনা থাকবে না। কথাটি বললেন উপস্থাপকের সঙ্গে আসা এক ভদ্রলোক। আলোচনা অনুষ্ঠান শেষে সবাই উপস্থাপককে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। ইশকুলের শিক্ষকরাও তাঁকে সহযোগিতা করার জন্য পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। উপস্থাপক আরও কয়েকজন ছাত্রীর কাছে জানতে চাইলেন বঙ্গবন্ধুর জীবনী পড়েছে কিংবা বঙ্গবন্ধুর ভূমিকার কথা শুনেছে কিনা। তাদের প্রত্যেকেই নিজেদের মতো করে বঙ্গবন্ধুকে তুলে ধরল। এবার উপস্থাপক তাঁর শেষ কথাটি ক্যামেরায় ধারণ করলেন। তিনি বললেন- আমাদের আছে রাঙা রোদ্দুর মোহন বাঁশির জাদুকরি সুর আমাদের আছে শেখ মুজিবুর তাই আমাদের এগিয়ে যাওয়ার সাহস রয়েছে বেশি। আমাদের আছে স্বপ্নের মতো রূপ-অরূপের আলো আমাদের প্রিয় বাংলাকে তাই বেসেছি অনেক ভালো। আসলে বঙ্গবন্ধু এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা, রূপ-অরূপের আলো। আয়মান নিজেকেও আজ বেশ ধন্য মনে করছে, টেলিভিশনে কবিতা আবৃত্তির মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করার সুযোগ পেল। অলঙ্করণ : আউয়ুব আল আমিন
×