ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অচলাবস্থায় মূল্যবান যন্ত্রাংশ বিনষ্ট হচ্ছে

সিলেট টেক্সটাইল মিল ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে

প্রকাশিত: ০৪:১৭, ৫ আগস্ট ২০১৬

সিলেট টেক্সটাইল মিল ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে

সালাম মশরুর, সিলেট অফিস ॥ ফ্রান্স থেকে আমদানিকৃত বাংলাদেশের অন্যতম টেক্সটাইল মিল সিলেট টেক্সটাইল মিলটি এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। টানা প্রায় ৯ বছর যাবত অচল অবস্থায় পড়ে থেকে মিলটির মূল্যবান যন্ত্রপাতি বিনষ্ট হচ্ছে। সর্বশেষ ২০০৭ সালে সার্ভিস চার্জের ভিত্তিতে মিলটি চালু করা হলেও মাত্র ৮ মাসের মাথায় আবার বন্ধ হয়ে যায়। শহরতলীর মেজরটিলা এলাকায় ১৯৭৭ সালে সিলেট টেক্সটাইল মিলের জন্য ২৮ দশমিক ৮১ একর জমি ক্রয় করা হয়। ১৯৭৮ সালে ফরাসী, এডিবি ঋণ এবং বিশ্বব্যাংকের অর্থ সংস্থা আইডিএ’র অর্থায়নে তৎকালীন বাণিজ্য উপদেষ্টা এম সাইফুর রহমান মিলটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯৮০-৮১ অর্থবছরে মিলটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়। ১৯৮৩ সালের জুনে মিলের পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু হয়। প্রায় ১২শ’ শ্রমিক নিয়ে মিলের উৎপাদন কাযক্রম চলতে থাকে। ২৫ হাজার টাকুবিশিষ্ট এ মিলে ৩২%, ৪০%, ৬০%, ৮০% কাউন্টের সুতা তৈরি হতো। প্রতিষ্ঠার বেশি দিন না যেতেই মিলে শ্রমিক রাজনীতি চাঙ্গা হয়ে ওঠে। এরশাদ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভারত থেকে অবাধে সুতা আমদানির সুযোগ তৈরি হওয়ায় দেশীয় মিলে তৈরি সুতার মূল্যের দিক থেকে প্রতিযোগিতায় পড়ে যায়। এ নিয়ে বাজারজাত সমস্যা শুরু হয়। বাজারে অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে আমদানিকৃত সুতা পাওয়ায় সিলেট টেক্সটাইল মিলের তৈরি সুতার বিক্রিতে সঙ্কট তৈরি হয়। কাজ না করেও শ্রমিক রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ওভারটাইমসহ বিভিন্ন ফায়দা হাসিল, শমিক অসন্তোষ, লুটপাট, অধিক মূল্যের কারণে সুতার বাজারজাত সমস্যা, মিল পরিচালনায় অব্যবস্থাপনাসহ নানামুখী সমস্যায় মিলটি কয়েক বছর না যেতেই লোকসানের মুখে পড়ে যায়। অব্যাহত লোকসানের কারণে ২০০০ সালে এসে মিলটির উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। ২০০১ সালে সার্ভিস চার্জের ভিত্তিতে একটি প্রতিষ্ঠানকে মিলটি চালু করার দায়িত্ব দেয়া হয়। এ পদ্ধতিতে দুই বছর চলার পর পুনরায় বন্ধ হয়ে যায়। ২০০৩ সালে বিটিএমসি মিলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তাৎক্ষণিক পাওনা নিয়ে অবসরে যাওয়ার সুযোগ গ্রহণের ঘোষণা দেয়। এ ঘোষণার পর পর্যায়ক্রমে অধিকাংশরাই গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে টাকা নিয়ে চাকরি ছেড়ে চলে যান। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর ২০০৭ সালে পুনরায় সার্ভিস চার্জের ভিত্তিতে মিলটি চালু করার উদ্যোগ নেয়া হয়। ৫০ টাকা মজুরিতে পাঁচ শতাধিক শ্রমিক নিয়ে উৎপাদন শুরু হয়। প্রায় ৮ মাস পর উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। সে সময় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান শ্রমিকদের দীর্ঘ কয়েক মাসের মজুরি পরিশোধ না করেই মিল থেকে চলে যায়। বর্তমানে মিলে একজন ইনচার্জ, সিকিউরিটি ছাড়াও মাস্টাররোলের ভিত্তিতে নিয়োগকৃত ৩-৪ জন লোক রয়েছেন। তারা কর্মহীন দিনযাপন করছেন এবং সরকারের কোষাগার থেকে বেতন-ভাতা নিচ্ছেন। এ ব্যাপারে সর্বশেষ বিদায়ী এ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আফতাবুর রহমান জনকণ্ঠকে জানান, সিলেট টেক্সটাইল মিলের উৎপাদিত সুতার গুণগতমান উন্নত থাকার কারণে ক্রেতাদের আগ্রহ ছিল। কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কারণে মিলের লোকসানের বোঝা বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিভিন্ন সময়ে অযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ দেয়ার ফলে তারা মিল পরিচালনায় ব্যর্থ হয়েছেন। ২০০৩ সালে এ্যাকাউন্ট্যাট হিসেবে মোতালেব হোসেনকে মিলে নিয়োগ দেয়া হয়। ২০০৭-০৮ সালে সার্ভিস চার্জের ভিত্তিতে উৎপাদন শুরু হলে দুর্নীতির কারণে বেশিদিন এ যাত্রা অব্যাহত থাকেনি। নিজেরা আর্থিক সুবিধা নিয়ে বেশি কাউন্টের সুতার গায়ে কম কাউন্টের লেভেল লাগিয়ে বিক্রি করা হয়েছে। মিলের ছাদ মেরামত, সুতা তৈরির উপকরণ ক্রয়সহ নানাভাবে অর্থ আত্মসাতের কারণে লোকসানের পাল্লা ভারি হতে থাকে। মিল পরিচালনায় ব্যর্থ হলেও তৎকালীন বস্ত্রমন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীর আশীর্বাদপুষ্ট এ কর্মকর্তা পদোন্নতি পেয়ে এখন বিটিএমসিতে চীফ এ্যাকাউন্ট্যাট হিসেবে কর্মরত আছেন। একাধিকবার সংস্কারকাজ করা হলেও মিলের ছাদ চুয়ে এখনও পানি পড়ে। ২০০৭ সালে স্পিনিং মাস্টার হিসেবে যোগদানকারী কর্মকর্তা আলম খান সার্ভিস চার্জের ভিত্তিতে মিল পরিচালনায় ব্যর্থ হন। বছরের পর বছর ধরে বন্ধ পড়ে থাকা মিলের ইনচার্জ হিসেবে সম্প্রতি অবসরে যাওয়া এ কর্মকর্তাকে সরকারের বেনিফিট দিতে হচ্ছে প্রায় ৪০ লাখ টাকা। দীর্ঘদিন ধরে মিলটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকায় কয়েক কোটি টাকার যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি অনেক যন্ত্রপাতি খোয়া যাওয়ারও অভিযোগ উঠেছে। বর্তমানে টেক্সটাইল মিলটি র‌্যাব-৯-এর আবাসন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে মিলটি বিক্রির জন্য দু’বার টেন্ডারও আহ্বান করা হয়। কিন্তু কাগজপত্রে ত্রুটির কারণে প্রথম দফা টেন্ডার বাতিল করা হয়। দ্বিতীয় দফা ১৫ কোটি টাকা দর উঠলেও এ্যাসেট ভ্যালুর পরিমাণ প্রায় শত কোটি টাকা হওয়ায় সেটিও বাতিল করা হয়। গত মহাজোট সরকারের আমলে আরেক দফা বিক্রির উদ্যোগ নেয়া হয়। তবে সেটিও বেশিদূর এগোয়নি। জানা গেছে, সিলেট টেক্সটাইল মিল প্রকল্পের ঋণের পরিমাণ ৯৪ কোটি ৮৭ লাখ ৭১ হাজার টাকা। এর মধ্যে পুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণ ৫৮ কোটি ৮২ লাখ ১৭ হাজার এবং প্রকল্প ঋণের পরিমাণ ৩৬ কোটি ৫ লাখ ৫৪ হাজার টাকা। প্রকল্প ঋণের মধ্যে ফরাসী ঋণ ২৩ কোটি ৫৩ লাখ ৬ হাজার, এডিবি ঋণ ৫ কোটি ১১ লাখ ৩১ হাজার, আইডিএ’র ঋণ ১৫ লাখ ৭৯ হাজার এবং শেয়ার ইক্যুইটি ৭ কোটি ২৬ লাখ ৩৮ হাজার টাকা। উল্লেখ্য, মিলের বর্তমান স্থাপনা ছাড়াও শত কোটি টাকার বেশি ভূ-সম্পত্তি রয়েছে।
×