ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সরকারকে সতর্ক করলেন বিশেষজ্ঞরা

মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়া শিক্ষার্থীদের জঙ্গী কানেকশন

প্রকাশিত: ০৫:১৫, ৩০ জুলাই ২০১৬

মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়া শিক্ষার্থীদের জঙ্গী কানেকশন

বিভাষ বাড়ৈ ॥ জঙ্গীবাদী কর্মকা-ে ছাত্রদের জড়িয়ে পড়ার তথ্য বেরিয়ে আসার প্রেক্ষাপটে ‘উদ্বেগজনক’ আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসছে মালয়েশিয়ার মোনাস ইউনিভার্সিটির নাম। গুলশানে জঙ্গীদের ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ ও সর্বশেষ কল্যাণপুরে আস্তানায় নিহত জঙ্গীদের তালিকায়ও মোনাস ইউনিভার্সিটির বাংলাদেশী ছাত্রের নাম আসায় উদ্বেগ নতুন মাত্রা পেয়েছে। এ অবস্থায় বিশ্বের স্বনামধন্য অস্ট্রেলিয়ার এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির মালয়েশিয়া ক্যাম্পাস সম্পর্কে সরকারকে সর্তক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। মালয়েশিয়ার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশী জঙ্গীদের সংযোগের ‘নিরাপদ অঞ্চল’ অভিহিত করে সেখানে পড়ালেখা করতে যাওয়া সকল শিক্ষার্থীর নাম-ঠিকানাসহ সুনির্দিষ্ট তথ্য খতিয়ে দেখার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। বিশেষজ্ঞরা মালয়েশিয়া ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশে পড়ালেখা করতে যাওয়া শিক্ষার্থীদের জঙ্গী যোগের ভয়াবহতা সম্পর্কে বলছেন, কিছুদিন আগে সিঙ্গাপুরে ধরা পড়ে সে দেশে প্রশিক্ষণ নেয়া কয়েকজন বাংলাদেশী জঙ্গী। যারা বাংলাদেশে এসে জঙ্গী হামলা চালিয়ে সরকার উৎখাত করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। জঙ্গীদের অভয়ারণ্য এখন মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ। বিদেশে তারা ট্রেনিংয়ের পর বড় কিছু ঘটানোর জন্য দেশে ফিরে আসে। এরাই হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায়। পরে টার্গেট করে হামলা চালাচ্ছে। শিক্ষাবিদরা অভিভাবকদের বিদেশে পড়ালেখা করতে পাঠানো সন্তানদের বিষয়ে নজর রাখার পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, সেখানে গিয়ে সন্তানরা কী করছে? কাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখছে? কেনই বা সেখানে পড়তে আগ্রহী হচ্ছে কিংবা কারও প্রলোভনে সেখানে পড়তে চাচ্ছেন কিনাÑ সে বিষয়ে তথ্য যাচাইবাছাই করুন। সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, দেশ ও বিদেশের নামী প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীদের নাম জঙ্গী যোগের প্রেক্ষাপটে আইনশৃঙ্খলা প্রয়োগকারী সংস্থার চোখ এখন মালয়েশিয়ার মোনাস বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকেও। একই সঙ্গে ঢাকার নর্থসাউথ, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, স্কলাস্টিকা, সানিডেলসহ নামী দামী বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দিকে রয়েছে সন্দেহের তীর। তদন্ত করা হচ্ছে কী করে নামী দামী এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে কিছু ছাত্র জঙ্গী হয়ে বের হচ্ছে। এক্ষেত্রে কোন শিক্ষকের সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। জানা গেছে, কল্যাণপুরে জঙ্গী আস্তানায় অভিযানের সময় নিহত জঙ্গীদের একজন হলেন সেজাদ রউফ অর্ক ওরফে মরক্কো। তিনি এক সময় দেশের নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটিতে পড়লেও এরপর চলে যান মালয়েশিয়ার মোনাস ইউনিভার্সিটিতে। সেজাদ গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালানোর পর কমান্ডো অভিযানে নিহত নিবরাস ইসলামের বন্ধু। তারা দুজনই ঢাকার নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ও মালয়েশিয়ার মোনাস ইউনিভার্সিটিতে পড়েছিলেন একসঙ্গে। শাহবাগ থানার একটি মামলায় দুজনই আসামি ছিলেন। রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকার বাড়ি থেকে সেজাদ গত ৬ ফেব্রুয়ারি বেরিয়ে যাওয়ার পর আর ফেরেননি জানিয়ে তার বাবা ভাটারা থানায় জিডি করেছিলেন। এছাড়া গুলশান হামলায় নিহত পাঁচজনই একাধিকবার মালয়েশিয়ায় যান। যে ছয় মাস তারা নিখোঁজ ছিলেন, সেই সময়ে একাধিকবার তারা মালয়েশিয়া সফর করেছেন বলে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন। শোলাকিয়ায় নিহত আবীরও বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন তাকে মালয়েশিয়ায় পাঠানো হয়নি বলে। নিবরাসও ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে নিখোঁজ ছিলেন বলে তার পরিবারের ভাষ্য। এরপর ১ জুলাই গুলশানের ক্যাফেতে নিহত হওয়ার পর জানা যায়, তিনি ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ঝিনাইদহের একটি মেসে ছিলেন। ওই মেসে নিবরাসের আরেক সঙ্গী আবীর রহমানও ছিলেন, যিনি ৭ জুলাই ঈদ-উল-ফিতরের দিন শোলাকিয়ায় পুলিশের ওপর হামলা চালানোর পর গুলিতে নিহত হন। নিবরাসের মতো আবীরও নিখোঁজ ছিলেন কয়েক মাস ধরে। তাদের সঙ্গে ওই মেসে যে আটজন ছিলেন, তাদের মধ্যে সেজাদও ছিলেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এদিকে রাজধানীর পাইকপাড়া থেকে আটক হওয়া হরকাতুল জিহাদের ঢাকা মহানগর কমান্ডার মাওলানা মোঃ নাজিমুদ্দীন শামীমকে জিজ্ঞাসাবাদে বুধবার চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে বলে জানিয়েছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম। জিজ্ঞাসাবাদে শামীমের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের বরাত দিয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত এই কমিশনার বলেন, খালেদ সাইফুল্লাহ বর্তমানে মালয়েশিয়া রয়েছেন। সেখান থেকে তিনি প্রতি মাসে মোটা অংকের অর্থ দেশে পাঠান। ওই অর্থই হুজির সঙ্গে সম্পৃক্ত ৫১টি পরিবারকে ভাগ করে দিতেন শামীম। দেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও মালয়েশিয়ার বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে যেখানে বাংলাদেশী ছাত্ররা পড়ছেন। গোয়েন্দারা সন্দেহ করছেন, মালয়েশিয়ার মোনাস বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করা বাংলাদেশী ছাত্রদের অনেকে উগ্রপন্থীদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশী কতজন ছাত্র লেখাপড়া করছেন, এর খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। তবে এরই মধ্যে গুলশানের রেস্তরাঁয় সন্ত্রাসী হামলায় নিহত নিবরাস ইসলামের বিষয়ে মালয়েশিয়ার উচ্চশিক্ষা মন্ত্রণালয় তদন্ত করবে বলে জানিয়েছে। মালয়েশিয়ার উচ্চশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে তারা জেনেছে ঢাকার রেস্তরাঁয় সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় অভিযুক্ত একজন বা একাধিক অপরাধী বিভিন্ন সময়ে মালয়েশিয়ায় বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। ‘উচ্চশিক্ষা মন্ত্রণালয় এই গুরুতর ব্যাপারটি বিবেচনায় নিয়েছে। সেই সঙ্গে এ ঘটনায় তারা তদন্ত করবে। অন্যদিকে জঙ্গীদের তালিকায়ও মোনাস ইউনিভার্সিটির বাংলাদেশী ছাত্রের নাম আসায় মালয়েশিয়া ক্যাম্পাস সম্পর্কে সরকারকে সর্তক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। শিক্ষাবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মোঃ আখতারুজ্জামান বলছিলেন, আসলে এ সময় দেশে বা এলাকায় জঙ্গী তৎপরতার জন্য অনুকূল পরিবেশ পাওয়া যায়। একই ধর্মের মানুষ হওয়ায় সেই সুযোগটা বেশি। সাধারণ মানুষ বা অন্যদের চোখ এড়ানো যায় সহজে। আমার পরামর্শ হচ্ছে, বিদেশের যে প্রতিষ্ঠানকে উদ্বেগজনক বলে মনে হবে সরকার সেখানকার বাংলাদেশী ছাত্রদের তথ্য নিয়ে একটি শিট তৈরি করতে পারে। এটা করা দরকার। কে পড়ছে, তার নাম-ঠিকানা রাখা দরকার। এরপর যে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গেছে তাদের মাধ্যমে নজর রাখা দরকার যাদের সন্দেহ হবে তাদের বিষয়ে। তবে সবকিছু করতে হবে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে। মালয়েশিয়ার এ প্রতিষ্ঠানসহ বিদেশের অনেক প্রতিষ্ঠানে জঙ্গীবাদের জন্য অনুকূল অবস্থান বিরাজ করছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল মান্নান চৌধুরী। তিনি অবিলম্বে মোনাসসহ বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ে সরকারকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিলেন। তিনি বলেন, যেসব তথ্য বেরিয়ে আসছে তাতে ভয়ের কারণ আছে। আসলে যেখানেই জঙ্গীবাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ আছে সেখানে কারা যাচ্ছে? কারা পড়ছে তা গুরুত্ব দিয়ে দেখা দরকার। সেখানে কারা পড়তে যাচ্ছে? কেন পড়তে চায়? কাদের সেখানে যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট দেয়া হচ্ছেÑ তার সুনর্দিষ্ট তথ্য নিয়ে দ্রুত কাজ করা উচিত। জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক শেখ একরামুল কবীর দ্রুত সরকারকে মালয়েশিয়া বিশেষত মোনাস ইউনিভার্সিটির বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের বিষয়ে তথ্য যাচাইবাছাই করার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, সেখানকার বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের বিষয়ে সতর্ক হওয়ার সময় এসেছে। যেসব তথ্য আসছে তাতে অভিভাবকদেরও শতর্ক হওয়ার সময় এসেছে। ব্লগার অমি রহমান পিয়াল তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেনÑ একটা প্যাটার্ন কিন্তু চোখে পড়ছে। নাস্তিক হত্যার নামে ব্লগার খুন কিংবা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলা আসলে নৃশংসতার প্রথম পাঠ; হাতেখড়ি। যোগ্যতা যাচাইয়ের পরীক্ষায় উত্তরণ। এরপর বিদেশে তাদের নিবন্ধন, ট্রেনিং এবং বড় কিছু ঘটানোর জন্য দেশে ফিরে আসা। গুলশান হামলায় জড়িত প্রত্যেকেই চার পাঁচ মাস ধরে নিখোঁজ ছিল। কিছুদিন আগে মাদারীপুরে ধরা পড়া জঙ্গী ফাহিম বাড়িতে মেসেজ পাঠিয়েছিলÑ সে বিদেশ যাচ্ছে। তারও কিছুদিন আগে সিঙ্গাপুরে ধরা পড়ে সেদেশে প্রশিক্ষণ নেয়া কয়েকজন জঙ্গী। পাকিস্তান বা আফগানিস্তান নয়। জঙ্গীদের অভয়ারণ্য এখন সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়া। তাদের কাগজপত্র রেডি থাকে। ঘটনা ঘটিয়েই চট্টগ্রাম থেকে জাহাজে চড়ে বসে তারা। আমার মনে হয় এদের শেকড় উপড়াতে এ জায়গাগুলোতেই নজরদারি এবং গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো জরুরী...।
×