ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ভারতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে শাহরিয়ার আলমের বৈঠক

জঙ্গী, সন্ত্রাস দমনে ঢাকা-দিল্লী সহযোগিতা জোরদার হবে

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ২৩ জুলাই ২০১৬

জঙ্গী, সন্ত্রাস দমনে ঢাকা-দিল্লী সহযোগিতা জোরদার হবে

কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ জঙ্গী ও সন্ত্রাস প্রতিরোধে ঢাকা এবং দিল্লী সহযোগিতা জোরদার করবে। এছাড়া বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পানিবণ্টন সমস্যা দ্রুত সমাধানে অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। দিল্লীতে ভারতের নবনিযুক্ত পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এম জে আকবরের সঙ্গে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের এক বৈঠকে এসব আলোচনা হয়েছে। এছাড়া বিমসটেকের সদস্য দেশের মধ্যে জঙ্গী ও সন্ত্রাস প্রতিরোধে সহযোগিতা জোরদারের আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ। বিমসটেক বিজনেস ফোরামের সংলাপে যোগ দিতে বুধবার পররাষ্ট্র জেএমবির শীর্ষনেতা বাংলা ভাই বরিশালের একটি মসজিদে এসে তিন দিন অবস্থান করেছিল। এদিকে বরিশাল অঞ্চলে জেএমবির দুই শীর্ষনেতা মাওলানা মহিউদ্দিন ফারুকী ও হান্নান উদ্দিনের কোন হদিস নেই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে নির্ভরযোগ্য একটি গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, জেএমবির বোমা বিশেষজ্ঞ আফগান ফেরত যোদ্ধা হান্নান উদ্দিন, জেএমবির আরেক শীর্ষনেতা (বাংলা ভাই পর্যায়ের) আত্মঘাতী দলের প্রশিক্ষক মাওলানা মহিউদ্দিন ফারুকী, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান মুফতি জসীম আনসারী ও কালেমায়ে জামাত সংগঠনের আমির আব্দুল মজিদের গ্রামের বাড়ি বরিশাল অঞ্চলে হওয়ায় বিভিন্ন সময় জঙ্গী সংগঠনের সদস্যরা দক্ষিণের বিভিন্ন এলাকায় শক্ত অবস্থান নেয়ার চেষ্টা করে আসছে। ফলশ্রুতিতে খোদ বরিশাল মহানগরীর কাউনিয়া থানার ভাটিখানা এলাকার সৈকত ভিলায় অবস্থান নিয়েছিল কালেমায় জামাত নামের একটি জঙ্গী সংগঠনের সদস্যরা। ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে পুলিশ ওই বাসায় অভিযান চালিয়ে ১০ নারী ও পুরুষকে গ্রেফতার করেছিল। সূত্রটির দাবি, প্রতিটি জঙ্গী সংগঠন পরিচালনার নেপথ্যে জামায়াতের যোগসূত্রের প্রমাণ রয়েছে। সূত্রমতে, পুলিশ প্রশাসনের বিশেষ নজরদারিতে কৌশলে এসব জঙ্গী সংগঠনের সদস্যরা বিভিন্ন সময় সংঘটিত হওয়ার চেষ্টা করলেও বরাবরই তাদের পরাজিত হতে হয় দক্ষিণাঞ্চলের চৌকস আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কাছে। জীবনবাজি রেখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বিভিন্ন সংগঠনের অসংখ্য জঙ্গীকে গ্রেফতার করে জেলহাজতে প্রেরণ করলেও আইনের ফাঁকফোকর পেরিয়ে ওই সব জঙ্গীনেতা জামিনে বেরিয়ে কৌশলে আবার তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সর্বশেষ মাদারীপুরে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার আগে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহরিরের সদস্য ফাইজুল্লাহ ফাহিমের দেয়া স্বীকারোক্তি মতে, বরিশালের এক আইনজীবীর চেম্বারে বৈঠক করেছে ফাহিমসহ ছয়জন জঙ্গী সদস্য। ওই বৈঠকে আইনজীবীর দেয়া নির্দেশনা অনুযায়ী মাদারীপুরের শিক্ষক রতন চক্রবর্তীকে হত্যার টার্গেট নেয়া হয়। ফলশ্রুতিতে চলতি বছরের ১৮ জুন মাদারীপুরে ফাহিমসহ জঙ্গীদের হামলার শিকার কলেজ শিক্ষক রতন চক্রবর্তী গুরুতর আহত হয়েও ভাগ্যক্রমে জীবনে রক্ষা পান। ওই হামলার ঘটনায় জনতার হাতে আটক জঙ্গী ফাহিম পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়। বন্দুকযুদ্ধের পর আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে মাদারীপুর জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন বলেছিলেন, পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ফাহিম জানিয়েছে, শিক্ষক রিপন চক্রবর্তীকে হত্যার উদ্দেশ্যে বরিশালের এক আইনজীবী নেপথ্যে থেকে কাজ করেছেন। তাদের পরবর্তী টার্গেট হচ্ছে বরিশাল জেলা। দীর্ঘদিনেও সেই আইনজীবীকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া নিহত ফাহিমের সহযোগী অধিকাংশ জঙ্গী সদস্যরা রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এর মধ্যে বরিশাল নগরী, ভোলা ও বরগুনার একাধিক মন্দিরের পুরোহিতদের চিঠি দিয়ে হত্যার হুমকি দেয়া হয়। সচেতন নাগরিকদের মতে, জামায়াতের রাজনীতিতে সক্রিয় আইনজীবীদের দেয়া পরিকল্পনায় টার্গেটকিলিং মিশন বাস্তবায়নে প্রাথমিকভাবে হুমকির চিঠি দিয়ে প্রশাসনকে মন্দিরমুখী করে অন্যকোন স্থানে হামলার পরিকল্পনা করছে জঙ্গী সদস্যরা। সূত্রমতে, বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোট সরকারের প্রথমার্ধে কয়েকটি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে হতাহত ও মসজিদে অগ্নিসংযোগের ঘটনার মধ্য দিয়ে বরিশালে আত্মপ্রকাশ করে উগ্রপন্থী জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাওহীদ। সারাদেশে ওই সংগঠনের প্রশিক্ষিত সদস্য সংখ্যা রয়েছে প্রায় ২০ হাজার। হিযবুতের বরিশাল, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ ও ঝালকাঠি জেলার দলত্যাগী সাবেক আমিরের (জেলার গৌরনদী উপজেলার বাসিন্দা) দেয়া তথ্য অনুযায়ী, হিযবুত তাওহীদ জঙ্গী সংগঠন। আগে বুঝতে পারিনি এরা ধর্মীয় অনুভূতির সরলতার সুযোগ নিয়ে জঙ্গী তৎপরতায় উদ্বুদ্ধ করে। যখন বুঝতে পেরেছি তখন আনুষ্ঠানিকভাবে তওবা করে দলত্যাগ করেছি। এ দলে প্রশিক্ষিত আত্মঘাতী দলের অসংখ্য নারী সদস্য রয়েছে। এছাড়া হিযবুত তাওহীদের সঙ্গে সরাসরি জামায়াতের যোগসূত্র রয়েছে। সূত্রে আরও জানা গেছে, বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার চেঙ্গুটিয়া গ্রামের বাসিন্দা (দীর্ঘদিন খুলনার ফুলতলা এলাকায় বসবাসরত) দুর্ধর্ষ শিবির নেতা পরবর্তীতে আফগান যোদ্ধা সর্বশেষ জেএমবির আত্মঘাতী দলের প্রশিক্ষক মাওলানা মহিউদ্দিন ফারুকীকে ২০০৫ সালের ডিসেম্বর মাসে বরিশাল কোতোয়ালি থানা পুলিশ খুলনা থেকে গ্রেফতার করে বরিশালে নিয়ে আসে। রহস্যজনক কারণে এক মাসের ব্যবধানে শীর্ষ এ জঙ্গীনেতা জেল থেকে জামিনে বেরিয়ে যায়। মহিউদ্দিন ফারুকীকে গ্রেফতারের পর ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশের কেন্দ্রীয় নেতা দাবি করে চারদলীয় জোট সরকারের বিশেষ মহলের আশ্বাসে একটি টিম বরিশালে এসে জেএমবির আত্মঘাতী দলের প্রশিক্ষক মাওলানা মহিউদ্দিন ফারুকীকে জামিনে মুক্ত করে নিয়ে যায়। সূত্রমতে, ভয়ঙ্কর এ জঙ্গী নেতাকে (মহিউদ্দিন ফারুকী) ১৭ আগস্টের সিরিজ বোমা হামলা মামলায় শোন এ্যারেস্ট দেখানো হলেও পরবর্তীতে তৎকালীন জোট সরকারের উচ্চমহলের চাপের মুখে পুলিশ চার্জশীট থেকে তার নাম বাদ দিতে বাধ্য হয়। অপর আফগান ফেরত যোদ্ধা ও জেএমবির বোমা বিশেষজ্ঞ হান্নান উদ্দিনের বাড়ি বরিশাল সদর উপজেলার কড়াপুর গ্রামে। চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে একাধিকবার সে নিজ গ্রামে এসেছিল। অনুসন্ধানী সূত্রে জানা গেছে, দক্ষিণাঞ্চলের সাগরপাড়ের জেলা বরগুনার নিভৃত পল্লী থেকে প্রশিক্ষণরত অবস্থায় বিভিন্ন সময় আটককৃত শতাধিক জঙ্গী বর্তমানে জামিনে রয়েছে। আবার এদের মধ্যে অনেকে এসব মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়ে এখন প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করায় এলাকাবাসীর মধ্যে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা রয়েই গেছে। সচেতন মহলের মতে, জঙ্গী সদস্যরা গ্রেফতারের পর আইনের ফাঁকফোকরে সহজে জামিন পেয়ে যাচ্ছে। ফলে জঙ্গী দমনে প্রচলিত আইন প্রয়োগ না করে নতুন আইন করা জরুরী হয়ে পড়েছে। সূত্রমতে, তৃতীয়বারের ন্যায় (২০১৩ সালের ১২ আগস্ট) বরগুনা শহরের উপকণ্ঠ খেজুরতলা থেকে বৈঠকরত অবস্থায় আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান মুফতি জসীম আনসারীসহ ৩১ জঙ্গীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ওই ৩১ জনের মধ্যে মুফতি জসীম আনসারী ছাড়া বাকি সবাই রয়েছেন জামিনে। এরপূর্বে ২০০৪ সালে সদর উপজেলার নিভৃত পল্লী নলটোনা ইউনিয়নের শিয়ালীয়া মাদ্রাসায় জঙ্গী প্রশিক্ষণের সময় ৩৩ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। এসব জঙ্গীর অনেকেই ২০০৫ সালের দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলায় জড়িত ছিল। গ্রেফতার হওয়া এসব জঙ্গীর অধিকাংশরাই মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছে। আর অল্প কয়েকজন পরবর্তীতে স্বল্প মেয়াদের শাস্তি ভোগ করে জামিনে বেরিয়েছে। এর পূর্বে ১৯৯৭ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি বরগুনা সদর উপজেলার ধুপতী গ্রামের আরাবীয়া এমদাদুল উলুম হাফিজিয়া কওমি মাদ্রাসা থেকে তিন তালেবান প্রশিক্ষককে গ্রেফতার করে পুলিশ। ওই মাদ্রাসায় প্রায় ৫০ জন ছাত্র ও অন্য জঙ্গীরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল। ঝালকাঠিতে জেএমবির বোমা হামলায় নিহত সহকারী জজ জগন্নাথ পাড়ে হত্যা মামলার অন্যতম আসামি এবং আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান মুফতি জসীম আনসারীর বাড়ি বরগুনা হওয়ায় জঙ্গীদের তৎপরতা নিয়ে উদ্বিগ্ন ওই এলাকার সচেতন মহল। এরই মধ্যে বরগুনার একাধিক মন্দিরের পুরোহিতকে হত্যার হুমকি দিয়ে প্রেরিত চিঠি নিয়ে আবারও আতঙ্ক দেখা দিয়েছে সাগরপাড়ের বরগুনার সাধারণ মানুষের মধ্যে। সূত্রে আরও জানা গেছে, ২০১৪ সালের ১৪ আগস্ট গভীর রাতে ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার কামদেবপুর কওমি মাদ্রাসা থেকে গোপন বৈঠকের সময় নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি) নয়জন সদস্যকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ সময় তাদের কাছ থেকে একটি গ্রেনেড, চারটি রামদা, ডায়েরি, সাতটি মোবাইল ফোন ও জিহাদী বই উদ্ধার করা হয়। একই দিন বিকেলে পটুয়াখালী শহরের ছোট চৌরাস্তা এলাকা থেকে পুলিশ উগ্রপন্থী জঙ্গী সংগঠনের তিনজনসহ গত এক বছরে দক্ষিণের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা থেকে উগ্রপন্থী জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাওহীদের প্রায় শতাধিক সদস্যকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃত প্রত্যেক জঙ্গী সদস্যরাই এখন জামিনে রয়েছে। আটক জঙ্গীদের জামিনে বের হওয়া প্রসঙ্গে বরগুনার অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর আখতারুজ্জামান বাহাদুর বলেন, আটক জঙ্গীরা যাতে বিচারিক আদালত থেকে জামিনে বের হতে না পারে সেজন্য আমরা যথেষ্ট চেষ্টা করি। কিন্তু তারা যখন বিচারিক আদালত থেকে জামিনে বের হতে না পারে তখন উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়ে জামিন নিয়ে আসে। এক্ষেত্রে আমাদের করার কিছুই থাকে না। এ ব্যাপারে বরগুনার পুলিশ সুপার বিজয় বসাক পিপিএম বলেন, বাংলাদেশের একটি উপকূলীয় জেলা বরগুনা। এ জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা দুরবস্থার কারণে অতীতে বিভিন্ন সময় জঙ্গীরা এখানে আশ্রয় নিয়েছিল। তিনি আরও বলেন, সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনাগুলোর পর জঙ্গীদের নির্মূল করতে পুরো জেলায় গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানোর পাশাপাশি কমিউনিটি পুলিশ এবং সাধারণ মানুষের মাধ্যমে বিভিন্ন স্থান থেকে বিভিন্ন ধরনের তথ্য সংগ্রহ করে তা যাচাই করা হচ্ছে। জঙ্গীদের অবস্থান এবং জঙ্গী তৎপরতার কোন ধরনের তথ্য কারও কাছে থাকলে তাৎক্ষণিকভাবে তা তাকে জানানোর অনুরোধ করেন। এছাড়াও ঘরভাড়া দেয়ার ক্ষেত্রে ভাড়াটিয়াদের সম্পর্কে সকল তথ্য যাচাইবাছাই করে ঘর মালিকদের ঘরভাড়া দেয়ার জন্যও তিনি অনুরোধ করেন। পাশাপাশি ছেলেমেয়েদের প্রতি অভিভাবকদের বিশেষ খেয়াল রাখার জন্যও আহ্বান করেন। বরিশাল রেঞ্জ ডিআইজি মোঃ হুমায়ুন কবির জানান, বর্তমানের সার্বিক বিষয় মাথায় রেখে দক্ষিণাঞ্চলের প্রতিটি জেলায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, যেকোন ধরনের নাশকতা মোকাবেলার জন্য পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাব-৮ এর সদস্যরা এবং গোয়েন্দা পুলিশ সর্বদা মাঠে কাজ করছে। ফলে কোন অপরাধী এ অঞ্চলে প্রবেশ করতে পারবে না বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
×