ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

তিন রাজাকারের ফাঁসি

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১৯ জুলাই ২০১৬

তিন রাজাকারের ফাঁসি

বিকাশ দত্ত ॥ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামালপুরের তিন আসামিকে মৃত্যুদ- এবং পাঁচজনকে আমৃত্যু কারাদ- প্রদান করেছেন ট্রাইব্যুনাল। রায়ে বলা হয়, আসামিদের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা পাঁচ অভিযোগের মধ্যে তিনটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে আসামি মোঃ আশরাফ হোসেন, মোঃ আব্দুল মান্নান, মোঃ আব্দুল বারীকে সরকার ফাঁসিতে ঝুলিয়ে অথবা গুলি করে তাদের মৃত্যুদ- কার্যকর করতে পারবে। এ মামলার বাকি পাঁচ আসামি এ্যাডভোকেট মোঃ শামসুল হক ওরফে ‘বদর ভাই’, এসএম ইউসুফ আলী, ইসলামী ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা শরীফ আহাম্মেদ ওরফে শরীফ হোসেন, মোঃ আবুল হাশেম ও হারুনকে আমৃত্যু কারাদ- প্রদান করা হয়েছে। চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ সোমবার এ আদেশ দিয়েছেন। এটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ২৫তম রায়। এর আগে আরও ২৪টি রায় প্রদান করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ট্রাইব্যুনাল ২৫টি মামলায় ৪৪ জনকে বিভিন্ন দ- প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৬ জনের মৃত্যুদ-, একজনের যাবজ্জীবন, একজনের ৯০ বছরের কারাদ- এবং ১৮ জনকে আমৃত্যু কারাদ- প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্যে পলাতক আছে ১৫ জন। এ রায়ে প্রসিকিউশন পক্ষ খুশি। অন্যদিকে আসামিপক্ষ এ রায়ে খুশি নয়। এ্যাডভোকেট মোঃ শামসুল হক ওরফে ‘বদর ভাই’, এসএম ইউসুফ আলী আপীল করবেন। অন্য যারা পলাতক আছেন তারা আপীল করতে হলে আগে আত্মসমর্পণ করতে হবে। আসামিদের মধ্যে গ্রেফতারকৃত দুজনকে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে প্রিজন ভ্যানে করে ট্রাইব্যুনালে নিয়ে আসা হয় সোমবার সকাল ৯টার দিকে। কিছু সময় ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় রেখে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তাদের তোলা হয় কাঠগড়ায়। এর পরপরই তিন বিচারক আসন গ্রহণ করেন। ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হকের সূচনা বক্তব্যের পর ২৮৯ পৃষ্ঠার রায়ের সংক্ষিপ্তসার পড়া শুরু করেন বিচারপতি মোঃ সোহরাওয়ার্দী। এরপর বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম রায়ের আরেকটি অংশ পড়েন। সবশেষে সাজা ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান। ফাঁসির দ-প্রাপ্ত এই তিনজনই পলাতক। অন্যদিকে আমৃত্যু কারাদ-ের মধ্যে এ্যাডভোকেট শামসুল আলম, এসএম ইউসুফ আলী, অধ্যাপক শরীফ আহমেদ ওরফে শরীফ হোসেন, মোঃ হারুন ও মোঃ আবুল কাসেম মধ্যে শামসুল আলম এবং এসএম ইউসুফ আলী কারাগারে। অন্যরা পলাতক আছেন। আসামিদের মধ্যে শামসুল ও ইউসুফ রায়ের সময় কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন। আমৃত্যু সাজার রায়ের বিরুদ্ধে এক মাসের মধ্যে আপীল করার সুযোগ পাবেন তারা। বাকিদের পলাতক দেখিয়েই এ মামলার বিচার চলে। রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করতে হলে তাদের আত্মসমর্পণ করতে হবে। এই আট আসামি একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন এবং পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর সহযোগিতায় গঠিত রাজাকার ও আল-বদর বাহিনীতে যোগ দেন। সে সময় জামালপুরের বিভিন্ন এলাকায় তারা যেসব মানবতাবিরোধী কর্মকা- ঘটান, তা এ মামলার বিচারে উঠে এসেছে। এই রায়ে ‘সন্তুষ্ট নন’ জানিয়ে কারাগারে থাকা দুই আসামি শামসুল ও ইউসুফের আইনজীবী গাজী এম এইচ তামিম বলেছেন তারা আপীল করবেন। অন্যদিকে প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ এই রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, রায় দেখে পর্যালোচনা করে তারা পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন। প্রসিকিউশন পক্ষ সন্তোষ্ট ॥ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামালপুরের তিন আসামির মৃত্যুদ- ও পাঁচজনের আমৃত্যু কারাদ-ের রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন প্রসিকিউশন পক্ষ। প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেন, আজকের এ রায়ে নিঃসন্দেহে অত্যন্ত খুশি। কারণ এখন পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের কনভিকশন রেট শতভাগ। আজকের রায়েও ব্যতিক্রম ঘটেনি। তিনি বলেন, আসামিদের বিরুদ্ধে আনা পাঁচ অভিযোগের মধ্যে তিনটি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে অপহরণ, নির্যাতন, হত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের একটি অভিযোগে মোঃ আশরাফ হোসেন, মোঃ আব্দুল মান্নান ও মোঃ আব্দুল বারীকে মৃত্যুদ-ের আদেশ দেন আদালত। আমৃত্যু কারাদ- পাওয়া এ্যাডভোকেট মোঃ শামসুল হক ওরফে বদর ভাই, এসএম ইউসুফ আলী, ইসলামী ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা শরীফ আহাম্মেদ ওরফে শরীফ হোসেন, হারুন ও মোঃ আবুল হাশেমের বিরুদ্ধে ওই অভিযোগসহ একাধিক অভিযোগ প্রমাণিত। আপীল করা হবে ॥ একাত্তরে জামালপুরে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আমৃত্যু কারাদ-ের রায়ের বিরুদ্ধে কারাগারে থাকা দুই আসামি আপীল করবেন বলে জানিয়েছেন তাদের আইনজীবী। আমৃত্যু সাজা পাওয়াদের মধ্যে এ্যাডভোকেট মোঃ শামসুল হক ওরফে ‘বদর ভাই’ ও এস এম ইউসুফ আলী রায়ের সময় কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন। রায়ের বিরুদ্ধে এক মাসের মধ্যে আপীল করার সুযোগ পাবেন তারা। এই দুজনের আইনজীবী তামিম রায় ঘোষণার পর সাংবাদিকদের বলেন, ‘ট্রাইব্যুনাল যে রায় দিয়েছেন, তাতে ১ নম্বর ও ৫ নম্বর অভিযোগ থেকে আমার আসামিদেরকে খালাস প্রদান করেছেন। একটি অভিযোগে আজীবন কারাদ- প্রদান করেছেন। আমি মনে করি এবং আমার আসামিদের ইনস্ট্রাকশন হলো- এই অভিযোগের বিরুদ্ধে আপীল করা হবে। আসামিদের সাক্ষ্যপ্রমাণ পর্যালোচনা করে আপীল বিভাগ আসামিদের নির্দোষ সাব্যস্ত করে খালাস দেবেন বলে আশা প্রকাশ করেন এই আইনজীবী। যে অভিযোগে দ- প্রদান ॥ শান্তি কমিটির পরামর্শ ও নির্দেশনায় পাক হানাদার বাহিনী ও স্থানীয় আল-বদর বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামীর নেতা ও শান্তি কমিটির সদস্য এ্যাডভোকেট শামসুল হক ও এস এম ইউসুফ আলীর অংশগ্রহণ ও সহযোগিতায় ১৯৭১ এর ২২ এপ্রিল থেকে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত জামালপুরে গণহত্যা চালায়। ওই সময় তারা স্বাধীনতাকামী এক হাজার লোককে হত্যা করে। এ ঘটনায় শামসুল হক ও ইউসুফ আলীর বিরুদ্ধে অপহরণ, নির্যাতন, হত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ আনা হয়। প্রথম অভিযোগটি প্রমাণিত হয়নি। আসামি আশরাফ হোসেন, শরীফ আহমেদ, আব্দুল মান্নান, হারুন ও আব্দুল বারী মুক্তিযুদ্ধকালীন ৭ থেকে ১৪ জুলাই এবং ২২ জুলাই জামালপুরের সরিষাবাড়ী থানার মইষ ভাদুরিয়া ও ধূপদহ গ্রামের শহীদ আব্দুল হামিদ মোক্তারের বাড়ি, মোঃ সাইদুর রহমান ভূঁইয়ার বাড়ি, আমির আলী খানের বাড়ি, পিটিআই হোস্টেলের টর্চার ক্যাম্প ও জামালপুর শ্মশানঘাটে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে। এ ঘটনায় শরীফ হোসেন, মোঃ আশরাফ হোসেন, মোঃ আব্দুল মান্নান, মোঃ আব্দুল বারী ও হারুনের বিরুদ্ধে অপহরণ, নির্যাতন, হত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ আনা হয়। দ্বিতীয় অভিযোগে এ আশরাফ হোসেন, মোঃ আব্দুল মান্নান, মোঃ আব্দুল বারীর মৃত্যুদ- এবং শরীফ হোসেন, হারুনকে আমৃত্যু কারাদ- দেয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন ১০ জুলাই আসামি শরীফ আহমেদ, আশরাফ হোসেন, আব্দুল মান্নান, আব্দুল বারী, আবুল হাসেম, শামসুল হক, ইউসুফ আলী ও স্থানীয় আল-বদর বাহিনী ও শান্তি কমিটির সদস্যরা জামালপুরের সিএ্যান্ডবি রোডের (পুরাতন) দয়াময়ী লেনের মল্লিক ভিলা থেকে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠন শহীদ নুরুল আমীনকে অপহরণ করে। তারপর ওইদিন সকাল ১০টায় তার মরদেহ ব্রহ্মপুত্র নদের চ্যাপতলা ঘাটে ভেসে ওঠে। তৃতীয় অভিযোগে শরীফ হোসেন, আশরাফ হোসেন, আব্দুল মান্নান, আব্দুল বারী, আবুল হাশেম, শামসুল হক, ইউসুফ আলীর বিরুদ্ধে অপহরণ ও হত্যার অভিযোগ আনা হয়। এ অভিযোগে প্রত্যেকের আমৃত্যু কারাদ- হয়েছে। জামালপুরে আশরাফ হোসেনের নেতৃত্বে বদর বাহিনী গঠিত হয়, তিনি সে সময় জামালপুর মহকুমার ছাত্র সংঘের সভাপতি ছিলেন। জামালপুরের আশেক মাহমুদ ডিগ্রী কলেজকে সে সময় নির্যাতন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হতো, যার প্রধান ছিলেন আশরাফ হোসেন। আসামি শরীফ আহমেদ, আব্দুল মান্নান, আব্দুল বারীসহ অন্যদেরও সেখানে নিয়মিত যাতায়াত ছিল। ১৯৭১ সালের ২২ এপ্রিল থেকে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আসামিরা সেখানে অনেককে আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যা করেছে। চতুর্থ অভিযোগে আশরাফ হোসেন, শরীফ হোসেন, আব্দুল মান্নান ও আব্দুল বারীর বিরুদ্ধে আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ আনা হয়। এ অভিযোগে আটজনেরই আমৃত্যু কারাদ- হয়েছে। সর্বশেষ পঞ্চম অভিযোগে মুক্তিযুদ্ধকালীন ২২ এপ্রিল থেকে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আসামি শরীফ আহমেদ, আশরাফ হোসেন, আব্দুল মান্নান, আব্দুল বারী, আবুল হাসেম, শামসুল হক ও ইউসুফ আলী এবং স্থানীয় আল বদর বাহিনীর সদস্য ও পাক হানাদাররা জামালপুরের পিটিআই হোস্টেলকে নির্যাতন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করতেন। সেখানে নিরস্ত্র মানুষকে আটকে রেখে নির্যাতন করা হতো এবং রাতে তাদের ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে শ্মশান ঘাটে নিয়ে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেয়া হতো। এ অভিযোগে আসামি শরীফ হোসেন, আশরাফ হোসেন, আব্দুল মান্নান, আব্দুল বারী, আবুল হাশেম, শামসুল হক, ইউসুফ আলীর বিরুদ্ধে আটকে রিখে নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ আনা হয়। এ অভিযোগটি প্রমাণিত হয়নি। আসামিদের পরিচয় ॥ মানবতাবিরোধী অপরাধে ৮ আসামির পরিচয় নিম্নে দেয়া হলো। আশরাফ হোসেন : অভিযোগপত্রের তথ্যানুযায়ী, ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি জামালপুরের সদরের মিয়াপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করা মোঃ আশরাফ হোসেন (৬৪) মুক্তিযুদ্ধের সময় তখনকার জামালপুর মহকুমার ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি ছিলেন। আশেক মাহমুদ কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হলেও তা শেষ করেননি। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর আশরাফের নেতৃত্বেই জামালপুরে আল-বদর বাহিনী গঠিত হয়। যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয় ঘটলে তিনি ওই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে পাটনা চলে যান এবং বিয়ে করে সেখানেই বসবাস শুরু করেন বলে প্রসিকিউশনের তথ্য। আব্দুল মান্নান : প্রসিকিউশনের তথ্যানুযায়ী, ১৯৪৮ সালের ২ নবেম্বর কাচারিপাড়ায় গ্রামে জন্মগ্রহণ করা আব্দুল মান্নান (৬৬) ১৯৭১ সালে জামালপুরের ইসলামী ছাত্র সংঘের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। তিনিও আশেক মাহমুদ কলেজের ছাত্র ছিলেন, তবে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করতে পারেননি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মান্নান আর রাজনীতিতে সক্রিয় হননি বলে মামলার অভিযোগপত্রের ভাষ্য। আব্দুল বারী : মোঃ আব্দুল বারী (৬২) ১৯৬৯ সালে জামালপুরের আশেক মাহমুদ কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। বহুদিন তিনি কাজ করেছেন ইরানি দূতাবাসে। ওই কাজ ছাড়ার পর একটি বেসরকারী কোম্পানিতে কাজ করেন তিনি। ১৯৭১ সালে বারী জামালপুরের ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্য ছিলেন। তবে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আর রাজনীতিতে সক্রিয় হননি বলে রাষ্ট্রপক্ষের ভাষ্য। শরীফ আহমেদ : জামালপুর সদরের কাচারিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করা শরীফ আহমেদ ওরফে শরিফ হোসেন (৭১) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করার পর ধনবাড়ী কলেজের প্রভাষক ছিলেন। স্বাধীনতার পর তিনি ইসলামী ব্যাংকের দিলকুশা শাখায় কাজ করেন। ১৯৭১ সালে শরীফ জামালপুরে জামায়াতে ইসলামীর নেতা ছিলেন। স্বাধীনতার পর তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে সক্রিয় না থাকলেও পেশাগতভাবে জামায়াত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে রাষ্ট্রপক্ষের ভাষ্য। হারুন : ১৯৫৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জামালপুরে জন্মগ্রহণ করা হারুন (৫৮) রাজনৈতিকভাবে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যুক্ত বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। আবুল হাশেম : প্রসিকিউশন বলছে, ইসলামী ছাত্র সংঘের রাজনীতিতে যুক্ত মোঃ আবুল হাশেম (৬০) ১৯৭১ সালের পাকিস্তান পুলিশে যোগ দেন। ১৯৭৩ সালে চাকরি থেকে অপসারিত হলে ব্যবসা শুরু করেন তিনি। শামসুল হক : মোঃ শামসুল হক (৭৫) ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেন। পরে ১৯৬৯ সালে তিনি জামালপুর বারের আইনজীবী হন ও আইন পেশায় কাজ শুরু করেন। ১৯৬১ সালে জামালপুর আশেক মাহমুদ কলেজের ভিপি ছিলেন শামসুল। ১৯৭০ সালে তিনি জামায়াতে যোগ দেন এবং গ্রেফতার হওয়ার সময়ও তিনি দলে সক্রিয় ছিলেন বলে রাষ্ট্রপক্ষের ভাষ্য। ইউসুফ আলী : সিংহজানি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করা এস এম ইউসুফ আলী (৮৩) জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে। জামায়াতের মনোনয়নে ১৯৭০ সালে এমএনএ নির্বাচন করে পরাজিত হন তিনি। ২০০২ সালে স্কুলের চাকরি থেকে অবসরে যাওয়া ইউসুফ সাম্প্রতিক সময়ে রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন না বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। মামলা বৃত্তান্ত ॥ ২০১৫ সালের ২৯ এপ্রিল এই আট আসামির বিরুদ্ধে প্রসিকউশনের দাখিল করা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল। ২ মার্চ তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পরদিন নয়াপাড়ার বাড়ি থেকে শামসুল ও ফুলবাড়িয়ার জাহেদা শফির মহিলা কলেজ প্রাঙ্গণ থেকে ইউসুফকে গ্রেফতার করে পুলিশ। নিয়মানুযায়ী বাকিদের আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয় গত বছরের ২২ জুলাই। কিন্তু তারা তা করায় এবং পুলিশ তাদের গ্রেফতার করতে না পারায় তাদের পলাতক দেখিয়েই মামলার বিচার শুরুর সিদ্ধান্ত হয়। যুদ্ধাপরাধের পাঁচ অভিযোগে ২০১৫ সালের ২৬ অক্টোবর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এই আটজনের বিচার শুরু করে ট্রাইব্যুনাল। ২০১৫ সালের ১৮ নবেম্বর প্রসিকিউশনের সূচনা বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এ মামলার সাক্ষ্য ও জেরার কার্যক্রম। চলতি বছর ১৪ জুন পর্যন্ত প্রসিকিউশনের পক্ষে মোট ২৫ জন এ মামলায় সাক্ষ্য দেন। প্রসিকিউশন ও আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে চলতি বছর ১৯ জুন আদালত মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখে। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করের প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ ও তাপস কান্তি বল। অন্যদিনে গ্রেফতার দুই আসামির পক্ষে ছিলেন আইনজীবী সৈয়দ মিজানুর রহমান, ব্যারিস্টার এহসান এ সিদ্দিকী ও গাজী এম এইচ তামিম। পলাতক আসামিদের পক্ষে ছিলেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আব্দুস সোবহান তরফদার। ২৫তম রায় ॥ ২০১০ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর এ পর্যন্ত ২৫টি মামলার রায় হয়েছে। রায়গুলোর মধ্যে রয়েছে, জামায়াতের সাবেক রুকন বাচ্চু রাজাকার হিসেবে পরিচিত আবুল কালাম আজাদ (মৃত্যুদ-), জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লা (আমৃত্যু কারাদ- (আপীলে মৃত্যুদ-, পরবর্তীতে রায় কার্যকর), জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী (মৃত্যুদ-) আপীলে আমৃত্যু কারাদ-, জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান (মৃত্যুদ-) আপীল বিভাগেও মৃত্যুদ- বহাল, পরবর্তীতে রায় কার্যকর। জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম (৯০ বছরের কারাদ-) অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ (মৃত্যুদ-), পরে তার রায় কার্যকর। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী (মৃত্যুদ-), পরে তার দ- কার্যকর। বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আব্দুল আলীম (আমৃত্যু কারাদ-) অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ, বদর বাহিনীর নেতা চৌধুরী মাঈনুদ্দিন এবং মোঃ আশরাফুজ্জামান খান (মৃত্যুদ-), জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী (মৃত্যুদ-), পরে রায় কার্যকর। জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী কমিটির সদস্য মীর কাশেম আলী (মৃত্যুদ-), আপীলে রিভিউ এ শুনানির পর্যায়ে, বিএনপি নেতা নগরকান্দা পৌর মেয়র জাহিদ হোসেন খোকন ওরফে খোকন রাজাকার (মৃত্যদ-), আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত মোঃ মোবারক হোসেন (মৃত্যুদ-), জাতীয় পাটির সাবেক মন্ত্রী কায়সার বাহিনীর প্রধান সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সার (মৃত্যুদ-), জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজাহারুল ইসলাম (মৃত্যুদ-) জামায়াতের নায়েবে আমির আব্দুস সুবহান (মৃত্যুদ-) ও জাতীয় পার্টির আব্দুল জব্বার (আমৃত্যু কারাদ-)। মাহিদুর রহমান এবং আফসার হোসেন চুটু (আমৃত্যু কারাদ-), হাসান আলী (মৃত্যুদ-), ফোরকান মল্লিক (মৃত্যুদ-), কাসাই সিরাজকে মৃত্যুদ- ও খান আকরামকে আমৃত্যু কারাদ- প্রদান করা হয়েছে। আতাউর রহমান ননি ও ওবায়দুল হক তাহেরকে মৃত্যুদ- প্রদান করা হয়েছে। কিশোরগঞ্জের আইনজীবী শামসুদ্দিন আহমেদ অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন মোঃ নাসিরউদ্দিন আহমেদ, রাজাকার কমান্ডার গাজী আব্দুল মান্নান, ও হাফিজউদ্দিন (মৃত্যুদ-), আজহারুল ইসলাম (আমৃত্যু করাদ-), মুহিবুর রহমান (মৃত্যুদ-) মুজিবুর রহমান ও আব্দুর রাজ্জাক (আমৃত্যু কারাদ-)। সর্বশেষ জামালপুরের ৮ রাজাকারের দ- ঘোষণা করা হয়।
×