ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ক্যালিব্রেশন ও ডিসপেন্সিং ইউনিটে কারচুপি

বিপিসির কয়েক কোটি টাকা লোপাট

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ১৭ জুলাই ২০১৬

বিপিসির কয়েক কোটি টাকা লোপাট

নিজস্ব সংবাদদাতা, পাবনা, ১৬ জুলাই ॥ রাজশাহী অঞ্চলের বিএসটিআইয়ের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা ট্যাংকলরির ক্যালিব্রেশন ও তেল পাম্পের ডিসপেন্সিং ইউনিটে কারচুপি করায় উত্তরাঞ্চলের পাঁচটি তেল ডিপো ও সাড়ে ৪০০টি তেল পাম্পের ওজন কাঠামো ভেঙ্গে পড়েছে। বিএসটিআই, ট্যাংকলরি চালক ও তেল পাম্প মালিকরা পরস্পর যোগসাজশে এই অনিয়ম ও কারচুপির কারণে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি), ইঞ্জিনচালিত যানবাহন, গভীর অগভীর নলকূপ মালিক ও ভোক্তাদের কোটি কোটি টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। আর এতে বিএসটিআইয়ের অসাধু কর্মকর্তা, ট্যাংকলরি চালক ও তেল পাম্প মালিকরা লাভবান হচ্ছে। এছাড়া নিয়মানুযায়ী প্রতিবছর ট্যাংকলরি ক্যালিব্রেশন না করায় সরকার প্রায় এক কোটি টাকা রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিপিসি সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের উত্তরাঞ্চলের বাঘাবাড়ী, পার্বতীপুর, রংপুর, রাজশাহী ও হরিয়ানায় অয়েল ডিপো রয়েছে। এই পাঁচটি অয়েল ডিপো থেকে উত্তরাঞ্চলে ১৬ জেলাসহ টাঙ্গাইল ও কুষ্টিয়া জেলার সাড়ে চার শ’ তেল পাম্প এবং সহস্রাধিক ডিলার ও এজেন্টেকে জ্বালানি তেল ডিজেল, কেরোসিন, পেট্রোল ও অকটেন সরবরাহ করা হয়। ডিপো থেকে জ্বালানি তেল পরিবহনের জন্য প্রায় সাড়ে ৬শ’ ট্যাংকলরি নিয়োজিত রয়েছে। পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার অয়েল ডিপো থেকে প্রতিদিন সাড়ে চার শ’ ট্যাংকলরি গড়ে ৪০ লাখ লিটার জ্বালানি তেল নিয়ে বিভিন্ন জেলার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। বিএসটিআইয়ের কর্মকর্তারা ট্যাংকলরি ক্যালিব্রেশনে কারচুপি করায় অয়েল ডিপো থেকে প্রতিলরিতে গড়ে ১৫ লিটার জ্বালানি তেল বেশি সরবরাহ দিতে হচ্ছে। এতে উত্তরাঞ্চলে বিপিসির পাঁচটি ডিপোতে গড়ে প্রতিদিন সাড়ে ছয় মেট্রিক টন জা¡লানি তেল ঘাটতি হচ্ছে। সেই হিসেবে বছরে প্রায় দুই হাজার ৩৭৩ মেট্রিক টন জ্বালানি তেলের ঘাটতি হচ্ছে বলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে। সূত্র জানায়, রাজশাহী বিএসটিআই পাঁচ শ’ লিটারের যে জার (পট) দিয়ে ট্যাংকলরি ক্যালিব্রেশন করে, সেটি টুপার্ট, এর মাঝে রাবার ও নাট-বলটু লাগানোর ফলে নাট-বলটু ঢিল বা টাইট দিয়ে জারের ধারণক্ষমতা কম বেশি করা যায়। বিপিসির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার উপস্থিতিতে ট্যাংকলরির ক্যালিব্রেশন করার কথা থাকলেও তা করা হয় না। এমনকি ক্যালিব্রেশন চার্টে বিএসটিআইয়ের ডিডি, ক্যারিব্রেশন ইন্সপেক্টর ও বিপিসির একজন কর্মকর্তার স্বাক্ষরের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু চার্টে বিপিসির কোন কর্মকর্তার স্বাক্ষর নেই। বিএসটিআই ঢাকা ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের ক্যালিব্রেশন চার্টের সঙ্গে রাজশাহী অঞ্চলের বিএসটিআইয়ের ক্যালিব্রেশন চার্টের কোন মিল নেই। প্রতিটি ট্যাংকলরির বিস্ফোরক লাইসেন্সের বাধ্যবাধকতা থাকলেও বেশিরভাগ ট্যাংকলরির বিস্ফোরক লাইসেন্স নেই। এ ব্যাপারে বিস্ফোরক বিভাগ ও বিএসটিআই কর্মকর্তাদের কোন মাথা ব্যথা নেই। প্রতিবছর ট্যাংকলরিগুলোর ক্যালিব্রেশন করার নিয়ম থাকলেও তা করা হয় না। এমনকি কোন কোন ট্যাংকলরি ৫-৬ বছর আগের ক্যালিব্রেশন চার্ট অনুযায়ী গায়ের জোরে ডিপো থেকে জ্বালানি তেল সরবরাহ নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। টাঙ্গাইল জেলার ট্যাংকলরি ঢাকা বিএসটিআইয়ের ক্যালিব্রেশন চার্ট অনুযায়ী নরায়ণগঞ্জে ফতুল্লা ডিপো থেকে তেল সরবরাহ নেয়ার কথা। অথচ একই জেলার ট্যাংকলরি রাজশাহী বিএসটিআইয়ের ক্যালিব্রেশন চার্ট অনুয়ায়ী বাঘাবাড়ী ডিপো থেকে তেল সরবরাহ নিচ্ছে। যা আইনগত দ-নীয় অপরাধ বলে জানা গেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ট্যাংকলরি চালক জানান, রাজশাহী বিএসটিআইয়ের ক্যালিব্রেশন চার্ট অনুযায়ী লরি প্রতি ১৫ লিটার তেল বেশি পাওয়া যায়। কিন্তু ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিএসটিআইয়ের ক্যালিব্রেশনে বেশি তেল পাওয়া যায় না। এ জন্য তারা রাজশাহী বিএসটিআইতে ট্যাংকলরি ক্যালিব্রেশন করে সেই অনুযায়ী বাঘাবাড়ী ডিপো থেকে তেল সরবরাহ নিচ্ছে। বিএসটিআই কর্মকর্তারা নিয়মিত মনিটরিং না করায় উত্তরাঞ্চলের তেল পাম্পগুলো চলছে ফ্রিস্টাইলে। তেল পাম্পগুলো থেকে জ্বালানি তেল ওজনে কম দেয়া হয়। বেশিরভাগ তেল পাম্পের ডিসপেন্সিং ইউনিটে সিল নেই বলে অভিযোগ রয়েছে। পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলার ১০টি তেল পাম্প পরিদর্শন করে দেখা যায় এর একটিতেও সিল নেই। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পাঁচ বছর পর পর প্রতিটি তেল পাম্প ক্যালিব্রেশন ও ডিসপেন্সিং ইউনিট পরীক্ষা করে ডিসপেন্সিং ইউনিট সিল করে দেয়ার নিয়ম রয়েছে। বিএসটিআই কর্মকর্তারা নিজেরাই এ নিয়ম মানছে না। ফলে ইচ্ছামতো চলছে তেল পাম্পগুলো। জুয়েল পরিবহনের মালিক মহসীন মল্লিক জানান, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের অধিকাংশ তেল পাম্প জ্বালানি তেল ওজনে কম দেয়। প্রতি ১০০ লিটারে ওজনে চার থেকে ছয় লিটার তেল কম পাওয়া যায়। বিএসটিআইয়ের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে অথবা তদারকির অভাবে তেল পাম্প মালিকরা ডিসপেন্সিং ইউনিটে কারচুপি করে জ্বালানি তেল ওজনে কম দিচ্ছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম ডিলার ডিস্ট্রিবিউটর এজেন্ট এ্যান্ড পেট্রোল পাম্প ওনার এ্যাসোসিয়েশনের এক কর্মকর্তা বলেন, পেট্রোল পাম্প ব্যবসা প্রতিযোগিতামূলক হওয়ায় ওজনে জ্বালানি তেল কম দেয়ার কোন সুযোগ নেই। কোন কোন পেট্রোল পাম্প জ্বালানি তেল ওজনে কম দেয় তবে তাদেরই ব্যবসায়িক ক্ষতি হবে বলে তিনি জানান। বিপিসির পার্বতীপুর যমুনা ডিপোর ইনচার্জ মজিবর রহমান জ্বালানি তেল ঘাটতির কথা স্বীকার করে বলেন, বিএসটিআইয়ের ক্যালিব্রেশন চার্ট ও ডিপোর মিটারের ওজনে তারতম্য হয়। এ জন্য দুটির ওজন সমন্বয় করে ডিপো থেকে তেল সরবরাহ করা হয়। উত্তরবঙ্গ ট্যাংকলরি চালক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ জানান, ট্যাংকলরি ক্যালিব্রেশনে বিএসটিআই কর্মকর্তাদের সঙ্গে চালকদের কোন যোগসাজশ নেই। তবে ট্যাংকলরি মালিকদের থাকলেও থাকতে পারে। রাজশাহী অঞ্চলের বিএসটিআই ডিডি এবিএম মর্তুজা হোসেন শাহের সঙ্গে বুধবার দুপুরে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ট্যাংকলরি ক্যালিব্রেশন বেশ কিছুদিন বন্ধ ছিল। ফের চালু করা হয়েছে। তবে ট্যাংকলরির মালিকরা নিয়মিত ক্যালিব্রেশন করার জন্য আসেন না। এ জন্য মাঝে মধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে ট্যাংকলরি আটক করে ক্যালিব্রেশন করা হয়। ক্যালিব্রেশন কাজে ১০০, ২০০ ও ৫০০ লিটারের তিন ধরনের জার (পট) ব্যবহার করা হয়। টুপার্ট জার ব্যবহারের কথা তিনি অস্বীকার করেন।
×