ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জাদুঘরে জামদানি প্রদর্শনী

বাংলার অনন্য শিল্পকর্ম সুপ্রাচীন ঐতিহ্যে আভিজাত্যের ছোঁয়া

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ২৩ জুন ২০১৬

বাংলার অনন্য শিল্পকর্ম সুপ্রাচীন ঐতিহ্যে আভিজাত্যের ছোঁয়া

মোরসালিন মিজান ॥ বাংলার অনন্য শিল্পকর্ম জামদানি। এর কোন তুলনা হয় না। অতি প্রাচীন ঐতিহ্যের কাছে, আভিজাত্যের কাছে আর সব ম্লান। বাঙালীর গৌরবের যে মসলিন সারা বিশ্বের বিস্ময়, জামদানি তার উত্তরাধিকার। জাতীয় জাদুঘরের নলিনী কান্ত ভট্টশালী গ্যালারির পুরোটাজুড়ে এখন চলছে সেই ঐতিহ্যের আলোকোজ্জ্বল প্রদর্শনী। বিসিকের এই আয়োজনে যোগ দিয়েছেন রূপগঞ্জের নামকরা কারিগররা। বিপুল শ্রম ঘাম ও যতেœ তৈরি শাড়ি দেখে মন ভরে যায়। ঈদে এত যে কেনাকাটা নস্যি মনে হয়। মনে হয়, যার ঘরে জামদানি নেই তার কিছুই নেই! যতদূর তথ্য, ১৭৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে দেশের শাসনভার চলে যাওয়ার পর মসলিন শিল্পের বিলুপ্তি ঘটে। ব্রিটিশরা মসলিন কারিগরদের বৃদ্ধাঙ্গুলি কেটে দেয়। এ শিল্পের কারিগররা তখন মসলিন ছেড়ে কৃষিকাজে যুক্ত হয়। তখনই ধ্বংস হয়ে যায় হাজার বছরের পুরনো বাঙালী ঐতিহ্য মসলিন। আর মসলিনের অনুপস্থিতিতে জামদানি হয়ে ওঠে বাংলার প্রধান শিল্প। সেই শিল্প সম্পর্কে চমৎকার ধারণা দিচ্ছে চলমান প্রদর্শনী। মাত্র ২০টি স্টল। যৎসামান্য জায়গা। কিন্তু ঢাকাই জামদানির নিজস্ব রূপ গুণ এত যে, বিপুলসংখ্যক মানুষকে মুগ্ধ করে রেখেছে। বাঙালীর মেধা, শিল্পবোধ, রুচি ও আভিজাত্যকে নতুন করে তুলে ধরছে প্রদর্শনী। রূপগঞ্জে যারা বংশপরম্পরায় এই কাজটি করে আসছেন এখানে তাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে আনা হয়েছে। দক্ষ কারিগরদের সুনিপুণ হাতে গড়া তাঁতবস্ত্র খুটিয়ে দেখারও অদ্ভুত আনন্দ! আর যারা কিনছেন তাদের আনন্দের তো কোন সীমা নেই। জামদানি মূলত শাড়ি। প্রতিটি স্টল শাড়ি দিয়ে সাজানো। বিভিন্ন রঙের শাড়িতে নানা রকমের নকশা করা। নকশার সঙ্গে মিল রেখে শাড়ির নামকরণ করা হয়েছে। এই যেমনÑ তেরছা, জলপাড়, আঙুরলতা, কাউয়ার ঠ্যাঙ পাড়, বাঘনলি, জুঁইবুটি, ময়ূরকণ্ঠী, পান্না-হাজরা, করোলা, দুবলাজাল, বুটিজাল, জালার, কলারফানা, আদারফানা। আছে সাবুরগা, বলিহার, শাপলাফুল, ময়ূরপ্যাঁচ পাড়, কলমিলতা, চন্দ্রপাড়, ঝুমকা ইত্যাদি নামের জামদানি। যে শাড়িতে ঘন কাজ দাম তত বেশি। প্রতিটি শাড়ি বুনতে কাজ করেন দু’জন কারিগর। কখনও এক মাস। কখনও একটি শাড়ি শেষ করতে ছয় মাসের বেশি সময় লেগে যায়! সে অনুযায়ী দাম। দোকানিরা জানালেন, ৪ হাজার টাকা থেকে দামের শুরু। এই দাম দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত ওঠে। একটি স্টলে কথা হয় জামদানির দুই বিখ্যাত কারিগর সবুজ ও এনামুলের সঙ্গে। দুই সহোদর এই কাজের জন্য জাতীয় পুরস্কার যেমন পেয়েছেন, তেমনি সরকারী উদ্যোগে গেছেন বিদেশে। জাপানে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে তাদের জামদানি। জাতীয় জাদুঘরে স্থায়ীভাবে প্রদর্শিত হচ্ছে তাদের তৈরি জামদানি। কোথায় তাদের বিশেষত্ব? জানতে চাইলে সবুজ বলেন, আমরা দশ বছর বয়স থেকে এই কাজের সঙ্গে যুক্ত। এখনও নিজ হাতে জামদানি বুননের কাজ করি। কথার এ পর্যায়ে একটি শাড়ি মেলে ধরে বললেন, দেখুন, আমাদের প্রতিটা ফোঁড় একরকম। কোনটা ছোট, কোনটা বড় হবে না। অসঙ্গতিপূর্ণ হবে না। হাতে তো বটেই, ব্রেন দিয়েও কাজ করি আমরা। হিসাব করে কাজ করতে হয়। সতর্ক থাকতে হয় কাজের প্রতিটি ধাপে। এ কারণেই আমাদের জামদানি এত পছন্দ করেন ক্রেতা। এনামুল খুব গর্ব করেই বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হসিনাও পছন্দ করেন আমাদের তৈরি জামদানি কিনে নিয়েছেন। পরেছেন। পাশের স্টলে সবুজ নামের আরেক কারিগর। দীর্ঘদিন ধরে কাজ করার অভিজ্ঞতা। লতা পাতার নকশা করা হাল্কা ফিরোজা রঙের একটি শাড়ি দেখিয়ে তিনি বললেন, এটির নাম লতা ডিজাইন। দুবলা পাড়। শাড়িটিতে দুই মাস কাজ করতে হয়েছে। দাম ৩৫ হাজার টাকা। অন্য একটি শাড়িতে গোলাকার নকশা করা। কারিগর বললেন, এটি গ্লোব ডিজাইন। দাম ৪০ হাজার টাকা। কেউ কোন ডিজাইন দেখিয়ে দিলে সেটিও করে দিতে পারবেন বলে জানান সবুজ জামদানি উইভিং ফ্যাক্টরির এই স্বত্বাধিকারী। রেজাউল করিম জামদানি তৈরির কাজ করছেন গত ২৮ বছর ধরে। ফিরোজা রঙের একটি শাড়ি দেখিয়ে তিনি বলেন, এটি শীতল পাটি ডিজাইন। দাম ৮০ হাজার টাকা। দাম জেনে অবাক হতে হলো বটে। ততোধিক বিস্মিত হতে হলো এই কথা জেনে যে, শাড়িটিতে দুজন কারিগর ছয় মাস ধরে কাজ করেছেন! জিয়াসমিন জামদানি নামের একটি স্টলে খুঁজে পাওয়া গেল প্রদর্শনীর সবচেয়ে বেশি দামের জামদানি শাড়িটি। ভাঁজ করে রাখা ছিল। বলার পর অল্প খুলে দেখালেন দুই কর্মী। বললেন, শীতল পাটি নকশা। এখানে কাজ আর কাজ। এত কাজ করতে সময় লাগে। ছয় মাস কাজ করতে হয়েছে। দাম তাই ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এর পরও টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাচ্ছে বলে জানান স্টলের মালিক কবির। প্রদর্শনীতে জামদানি শাড়ি ছাড়াও আছে থ্রিপিস, পাঞ্জাবি। এমনকি আছে কুশন কভার। সবই অবশ্য আনস্টিচ। সেলাই করে নিলে দারুণ ব্যাপার হয়ে যেতে পারে। রিফাত জামদানি নামের একটি স্টলে পাঞ্জাবি বিক্রি হচ্ছিল ৭০০ থেকে ২৫০০ টাকায়। থ্রি পিস আছে ১৫০০ টাকা থেকে ৫০০০ টাকা পর্যন্ত। প্রদর্শনী ঘুরে দেখতে গুলশান থেকে এসেছিলেন শিরিন নামের এক গৃহিণী। একাই চারটি শাড়ি কেনেন তিনি। কেন? জানতে চাইলে বলেন, জামদানি তো আমাদের ঐতিহ্য। এর চেয়ে আভিজাত্য কোথায় পাবেন আপনি? এ কারণেই যানজট উপেক্ষা করে চলে এসেছি। সামনে ঈদ। প্রিয়জনদের উপহার দেব। ঈদে জামদানির চেয়ে বড় গিফট তো হয় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তানিয়া অবশ্য শাড়ি দেখেই মুগ্ধ। বললেন, জামদানির গায়ে একটা কেমন মায়া লেগে থাকে। এত সুন্দর কাজ দেখে মন ভরে গেছে। দশ দিনব্যাপী প্রদর্শনী ২৮ জুন পর্যন্ত চলবে।
×