ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পদ্মায় মূল পাইল স্থাপনের কাজ ফের শুরু হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ৪ জুন ২০১৬

পদ্মায় মূল পাইল স্থাপনের কাজ ফের শুরু  হচ্ছে

মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল, মাওয়া থেকে ফিরে ॥ পদ্মায় আবার মূল পাইল স্থাপন শুরু হচ্ছে। টেস্ট পাইলের রেজাল্টের ভিত্তিতে মূল পাইলের গভীরতা নির্ধারণ নিয়ে ‘চ্যালেঞ্জ’ চলছিল। এসব কারণে প্রায় ২৫ দিন ধরে পাইল ড্রাইভ হচ্ছিল না। তবে বিষয়টি সমাধানের পথে। তাই ২-১ দিনের মধ্যে পাইল স্থাপনের কাজ শুরু হচ্ছে। শুক্রবার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানিকে আবার পাইল ড্রাইভের প্রস্তুতি নিতে দেখা গেছে। সেতুর ৩৮ নম্বর পিলারে এই পাইল স্থাপন হচ্ছে। শুরু হয়ে তা অনবরত চলবে। বর্ষায় জাজিরা প্রান্তের পিলারগুলোতে এই পাইল স্থাপন করার নতুন উদ্যোম নিয়েই শুরু হচ্ছে। এছাড়া আজ শনিবার পদ্মা সেতুর নিয়মিত পাক্ষিক সভা। এই সভা থেকে এসব বিষয়ে আরও কিছু সিদ্ধান্ত আসবে। পদ্মা সেতুর সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানান, আগেই নক্সা হয়েছে। তবে ফিল্ডে যাওয়ার পর তা যাচাই বাছাই করে আবার পরিবর্তন করা হয়। এরপরই ডিজাইন চূড়ান্ত করা হয়। এই চূড়ান্ত ডিজাইনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এখনও হাতে পায়নি। প্যানেল অব এক্সপার্ট ইতোমধ্যেই সরেজমিন ঘুরে গেছেন এবং দীর্ঘ সভা করে অনেক বিষয়ে সমাধান দিয়েছেন। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ডিজাইন চূড়ান্ত করার কাজ করছে। চলতি মাসেই এটি সম্পন্ন হবে। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়ে, পাইলের দৈর্ঘ্যে সামান্য ২-১ মিটার বাড়তে বা কমতে পারে। এসব কারণেই পাইল ড্রাইভ হয়নি। বর্তমান ডিজাইনে প্রতিটি পাইল ১৫০ মিটার গভীরে স্থাপন করার কথা। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত নক্সা না পাওয়ার কারণেই পাইল ড্রাইভ করছিল না। তবে তাদের অনুরোধ করা হয়েছে। এরপরই পাইল ড্রাইভ প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক সফিকুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, যথাযথভাবেই এগিয়ে চলছে সেতুর কাজ। সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, সেতুর সর্বমোট ২৫টি টেস্ট পাইলের ১৮টি সম্পন্ন হয়েছে। বাকি ২টির কাজও এগিয়ে চলছে। তবে রয়েছে আরও পাঁচটি টেস্ট পাইল। এগুলো আগামী জুলাইয়ের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে। প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, লোড টেস্টের রেজাল্ড ভাল এসেছে। মাওয়া প্রান্তের একটি পয়েন্টে শুধু ইঞ্জিনিয়ারিং ট্রিটমেন্ট করতে হবে। টেস্ট পাইলগুলো সম্পন্ন হয়ে গেলে মূল সেতুর কাজে গতি আরও বাড়বে। এছাড়া এ পর্যন্ত চারটি পিলারে ১১টি পাইল স্থাপন করা হয়েছে ৭০ ফুট গভীরে। সেতুর দুই প্রান্তের ভয়াডাক্টের কাজের অগ্রগতিও ভাল। সেতুর পাঁচটি প্যাকেজেই কাজ চলছে। মূল পদ্মা প্রবাহিত হচ্ছে মাওয়ার পাশ দিয়ে। পানি এবং স্রোত বেড়ে যাওয়ায় নদী শাসনের কাজ চলছে এখন জাজিরা প্রান্তে। চরজানাত-কাওড়াকান্দি এলাকায় ড্রেজিংসহ বালুর বস্তা ফেলা চলছে ব্যাপকভাবে। তবে বর্ষা শুরুর আগেই মাওয়ায় নদী শাসনের কাজ এগিয়ে রাখা হয়েছে। তাই বর্ষায় নদী ভাঙ্গনের আশঙ্কা নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী (নদী শাসন) শরফুল ইসলাম জানান, মাওয়ার পুরনো ফেরিঘাট থেকে উজানের দিকে কান্দিপাড়া ও জসলদিয়ায় নদী ভাঙ্গন ঠেকাতে সেনাবাহিনী প্রায় এক লাখ বালুর বস্তা ফেলেছে। আশা করা যায় এখানে ভাঙ্গন ঠেকানো সম্ভব হবে। তীব্র স্রোত আর পদ্মা রুদ্রমূর্তিতে ভারি ভারি নানান রকমের যন্ত্রপাতির সমাবেশ আর নির্মাণযজ্ঞ থামেনি। বরং পদ্মার ঢেউয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে সেতু তৈরির কাজ। নদী পথে মাওয়া প্রান্ত থেকে জাজিরার দিকে যতদূর যাওয়া যায়, চোখে পড়ে মূল সেতুর নির্মাণ কাজ। প্রকৃতির এক নয়নাভিরাম পরিবেশে দেশী-বিদেশী হাজার হাজার মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে। পদ্মায় পানির স্রোতের সঙ্গে সেতুর সফলতার এক বিশেষ তরঙ্গ যেন কাজ করছে। যা ছড়িয়ে দিচ্ছে চারিদিকে! তাই ক্রমেই কঠিন কঠিন চ্যালেজ্ঞ মোকাবেলা করে কাজ চলছে প্রকল্প এলাকায়। ভারি ভারি পাইল তৈরি ছাড়াও খুঁটি-নাটি নানা রকমের কাজ সফলভাবে সম্পন্ন হচ্ছে প্রকল্প এলাকায়। এছাড়া চীনে সেতুর উপরের অংশ স্প্যান তৈরির কাজ এগিয়ে চলছে পুরোদমে। আগামী নবেম্বরে ৩টি স্প্যান প্রকল্প এলাকায় পৌঁছার কথা রয়েছে। পিলারের ওপর ক্যাপে এই স্প্যান স্থাপানের পরই সেতুর অবয়ব দেখা যাবে। সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রায়শই ছুটে আসছেন প্রকল্পস্থলে। স্থানীয় সংসদ সদস্য অধ্যাপিকা সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলিও প্রকল্পে সরেজমিন খোঁজখবর করছেন নিয়মিত। আর সরকারী উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদেরও এই সেতুর কাজে সর্বদা তৎপর দেখা যাচ্ছে। কি কর্মদিবস, কি ছুটির দিন সর্বদাই কর্মতৎপরতা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ দৃষ্টির কারণেই পর্বতের মতো নানা চ্যালেঞ্জ সহজেই সমাধান হচ্ছে। মূল পদ্মা সেতুর কাজ প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলেও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে দুই প্রান্তের এ্যাপ্রোচ রোডের কাজ। মাওয়া প্রান্তে আগামী মাসের মধ্যে আর জাজিরা প্রান্তে কাজ শেষ হবে চলতি বছরের ডিসেম্বরেই। মূল সেতুর প্রায় দুই বছর আগেই এ্যাপ্রোচ রোডের কাজ শেষ হয়ে আসায় জাজিরা প্রান্তটি যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হবে। তাই শিমুলিয়া-কাওড়াকান্দি ফেরি রুটসহ হয়ে যাচ্ছে। এটি আগামী ডিসেম্বর বা জানুয়ারি থেকে শিমুলিয়া কাঁঠালবাড়ি ফেরি সার্ভিস হচ্ছে। এতেও দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগ হ্রাস পাচ্ছে সেতু চালুর আগেই। এই ফেরি সহজতর করার কাজও এগিয়ে চলছে। সেতুর সঙ্গে দুই প্রান্তের সংযোগ তৈরি করবে যে সড়ক, তার কাজও প্রায় শেষের দিকে। জাজিরা প্রান্তের মূল এপ্রোচ রোডটি ১০ দশমিক ৬৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে। এর সঙ্গে আশপাশের স্থানীয় সড়কগুলোকে সংযোগ দেয়ার উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হচ্ছে আরও ১২ কিলোমিটার সার্ভিস রোড। আর মাওয়া প্রান্তে ১ দশমিক ৬৭ কিলোমিটার এ্যাপ্রোচ রোডের সঙ্গে যোগ হচ্ছে আরও ৩ কিলোমিটার সার্ভিস রোড। জাজিরা প্রান্তের এ্যাপ্রোচ রোডটিতে এর মধ্যেই ১৫০ থেকে ২৭০ মিটার লম্বা ৫টি ব্রিজ, বিশটি কালভার্ট ও আটটি আন্ডারপাসের কাজ শেষ করা হয়েছে। শেষের দিকে মাওয়া এপ্রোচ রোডের কাজও। জাজিরা প্রান্তের কাজ শেষ হতে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে কয়েক মাস বেশি সময় লাগলেও তাতে মূল কাজে কোন সমস্যা হবে না। এ পর্যন্ত মাওয়া প্রান্তে ৯০ ভাগ এবং জাজিরা প্রান্তে ৭২ ভাগ সংযোগ সড়কের কাজ শেষ হয়েছে। এদিকে মূল সেতুর কাজে গতি বাড়াতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম উচ্চক্ষমতার আরেকটি হ্যামার। ২ হাজার কিলোজুলের এই হ্যামার তৈরি হচ্ছে জার্মানিতে। এটি চার মাসের মধ্যেই প্রকল্প এলাকায় আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। জাজিরা প্রান্তে নদী শাসনের ড্রেজিং অব্যাহত রয়েছে। এই বালু স্তূপ করা হচ্ছে দু’স্থানে। জাজিরা নদীর পার ঘেঁষে সেতু বরাবর ট্রায়াল সেকশন এবং মাওয়া চরের ব্লক-১ রাখা হচ্ছে এই বালু। কাওড়াকান্দির এই ড্রেজিংয়ের বালু সরিয়ে নেয়া হচ্ছে ব্লক-১২ শিবচরের পদ্মার চরে। তবে মাওয়া প্রান্তে এখন নদী শাসনে কাজ চলতি জুন মাস থেকে নেই বললেই চলে। তবে নদী তীরে লাখ লাখ ব্লক স্তূপ করে রাখা আছে। আগামী শুষ্ক মৌসুমে এগুলো স্থাপনের কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
×