ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

বিশ শতকের নারী

প্রকাশিত: ০৭:৩০, ২২ এপ্রিল ২০১৬

বিশ শতকের নারী

১৮৮০ সালে জন্ম নেয়া বেগম রোকেয়া অতি বাল্যকাল থেকেই লেখাপড়ার প্রতি অদম্য ইচ্ছাশক্তি নিয়ে বড় হতে থাকেন। বাবা তেমনটি না চাইলেও বড় ভাইয়ের অনুপ্রেরণায় রোকেয়া তাঁর জ্ঞানচর্চা অব্যাহত রাখেন। নিরলস বিদ্যার্জন ছাড়াও তিনি জন্মেছিলেন। এক অসাধারণ সৃজনশীল ক্ষমতা নিয়ে ভেতরের কঠিন প্রত্যয় থেকেই অবরুদ্ধ নারী জাতির প্রতি সচেতনতা জাগতে থাকে। ভাবতে থাকেন কিভাবে নারীরা পুরুষের সহযোগী শক্তি হিসেবে সমাজের তাদের যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারে। ফলে সৃষ্টি হতে থাকে একের পর এক নারী জাতির পথনির্দেশিকার মতো তাঁর রচিত গ্রন্থসমূহ, মাতৃভাষার প্রতি তাঁর দরদ ছিল অপরিসীম। বিয়ের পর বিহারে স্বামীর কর্মস্থলে চলে গেলেও তাঁর সৃজনশীলতা থেমে থাকেনি। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলই অবিভক্ত বাংলায় মুসলিম নারীদের জন্য কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত দ্বিতীয় বালিকা বিদ্যালয়। নিজে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারেননি। তাই বাল্যকাল থেকে মেয়েরা যাতে স্কুলে যেতে পারে সেই সদিচ্ছা থেকেই বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। বিংশ শতাব্দীতেও নারী শিক্ষা সেভাবে সবার জন্য মুক্ত ছিল না। শুধু শিক্ষা নয়, মেয়েরা তাদের সব ধরনের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। এ বঞ্চনার দায়ভাগ বর্তায় প্রচলিত সমাজ, যুগ যুগ ধরে স্থান করে নেয়া প্রাচীন অপসংস্কার, ধর্মীয় কঠোর অনুশাসন, ঐতিহ্যিক ধ্যান-ধারণায় পুষ্ট সামাজিক বিধি-নিষেধসমূহ। সুতরাং নারী জাতিকে নতুন পথ দেখাতে গিয়ে বেগম রোকেয়াকে সব ধরনের শৃঙ্খলকে কটাক্ষ করতে হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় ধর্মীয় নিয়মবিধি থেকেও তিনি নারী জাতিকে মুক্ত করার অভিপ্রায় তার ক্ষুরধার লেখনীকে প্রতিনিয়তই সচল রেখেছেন। অবরোধবাসিনীর পর্দাপ্রথাকে পাশ কাটানোর চেষ্টা থাকলেও মাঙ্গলিক কোন ধর্মীয় বিধির ওপর কখনও আঘাত করেননি। নারীকে তার ন্যায্য অধিকার পাওয়ার লক্ষ্যে সব ধরনের অমানবিক বন্ধন থেকে এগিয়ে চলার পথ দেখিয়েছেন। তাঁর জীবদ্দশায় নারী অধিকারের অবারিত পথও তিনি সেভাবে দেখে যেতে পারেননি। তিরিশের দশকের প্রথম দিকেই তাঁর মৃত্যু হয়। ঔপনিবেশিক শাসন, পরাধীনতার শৃঙ্খল, বিদ্যমান ব্যবস্থাকে মেনে নেয়ার প্রবৃত্তি, সচেতনতার ঘাটতি সর্বোপরি প্রতিকূল সমাজ ব্যবস্থা নারী জাতির অগ্রগতিকে বার বার ব্যাহত করেছে। এর থেকে কিছুসংখ্যক নারী বের হয়ে আসলেও সিংহভাগ নারী সমাজের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে থাকে। ‘চ-ালিকা’ লেখেন রবীন্দ্রনাথ তিরিশের দশকের শেষ দিকে, যা ঘুণে ধরা সমাজের অস্পৃশ্যতার এক নির্মম দলিল। ঢাকায় অবস্থিত ‘ইডেন গার্লস হাই স্কুল’-এর প্রতিষ্ঠা হয় ১৮৮০-এর দশকেই। তার পরেও নারী শিক্ষার হার সেভাবে বাড়েনি। ১৯৩০-এর দশকে এ স্কুলকে কলেজে রূপান্তরিত করা হলে উচ্চশিক্ষায় মেয়েদের অনুপ্রবেশের পথ খুলে যায়। ইতোমধ্যে ১৯২২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনালগ্নেই নারী শিক্ষার দ্বার খুলে গেলেও সে পথও মেয়েদের জন্য অত সহজ হয়নি। উচ্চশিক্ষায় নিজেদের স্থান করে নিতেও মেয়েদের অনেক সময় অপেক্ষা করতে হয়। ১৯৪৭-এর দেশবিভাগ গোটা রাষ্ট্র যেখানে তার অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কায় বিব্রত সেখানে নারীর অধিকার আদায়ও অকল্পনীয় ব্যাপার ছিল। আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক, ভাষা ও ঐতিহ্যের ওপর আক্রমণে সামগ্রিকভাবে দেশ যেখানে সঙ্কটাপন্ন, সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার যেখানে হুমকির মুখোমুখি, সেখানে দুর্বল অংশ হিসেবে নারীর সামাজিক অবস্থান যে কী পর্যায়ে তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না। এর পর শুরু হয় ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের মতো ঐতিহাসিক ঘটনা। ততদিনে মেয়েরাও নিজেদের সময়ের অংশীদার হিসেবে ভাবতে শুরু করেছে। ১৯৫৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা সারাদেশে শিক্ষার ক্ষেত্রে এক বিশিষ্ট মাইলফলক। এখানেও প্রথম থেকেই মেয়েরা পড়তে শুরু করে যদিও সংখ্যা ছিল হাতেগোনার মতো। ’৬০ এবং ’৭০-এর দশকে নারী শিক্ষা প্রসার লাভ করলেও আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ব্যবস্থাপনায় মেয়েদের সামনে চলার পথ অত নিষ্কণ্টক ছিল না। মেয়েরা এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে নানা বাধা-বিপত্তির মধ্য দিয়ে। ’৭০-এর নির্বাচন এবং ’৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রাম ও অর্জন বাংলার আপামর জনগোষ্ঠীর জীবনে এক নতুন সূর্যোদয়। স্বাধীনতা-উত্তর নতুন কিরণ বাংলাদেশের সামগ্রিক সমাজ ও মানুষের জীবনে যে নবজাগরণের ধারা সূচিত হয় তখন থেকে মেয়েরাও সামনে চলার পথের গতি খুঁজে পায়। ’৭৫-এর পটপরিবর্তন গোটা দেশের জন্য তো বটেই নারীরাও তাদের এগিয়ে চলার পথে হোঁচট খেলেও ধীরগতিতে নিজেদের সামাজিক অবস্থান মজবুত করতে থাকে। ইতোমধ্যে শুধু শিক্ষা কিংবা উচ্চশিক্ষাই নয়, নানাভাবে সমাজে তাদের আসন তৈরি করতে থাকে। কর্মক্ষেত্রে নিজেদের জায়গা দৃঢ় করে, রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়তে থাকে, ধর্মীয় গোড়ামি থেকে পাশ কাটাতে সচেষ্ট হয় সর্বোপরি অধিকার সচেতন এবং স্বাধীনচেতা মনোবৃত্তি নিয়ে বৃহত্তর সমাজের ঘরে-বাইরে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে প্রত্যয়ী হয়। এভাবে ১৯৮০-এর দশকে মেয়েদের অগ্রগতির ইতিহাস উল্লেখ করার মতো। ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের নারীদের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূত্রপাত হয়। ১৯৯১ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেগম খালেদা জিয়ার নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া বাংলাদেশের নারী সমাজের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব ঘটনা। পাশাপাশি বিরোধীদলীয় নেত্রীও তখন বঙ্গবন্ধুকন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নারীদের রাজনৈতিক সচেতনতার ক্ষেত্রে এক উজ্জ্বলতম অধ্যায়। ভাল-মন্দের বিচারে না গিয়েও বলা যায়, সর্বক্ষেত্রে মেয়েদের অবাধ পদচারণা গতি পায়। এ সংখ্যা নগণ্য হলেও মেয়েরা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে নিজেদের অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষায়। দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নারী তার জায়গা শক্ত করেছে সময়ের দাবি মেটাতে। তারপরেও প্রশ্ন থেকে যায়, বৃহত্তর নারী সমাজ কি আজও অন্ধকার থেকে আলোর পথে আসতে পেরেছে? নারী নির্যাতনের সংখ্যা কি সেভাবে কমেছে? আজও যৌতুকের দাবিতে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় নারীর বলিদানের কাহিনীও কম শোনা যায় না। নারী নির্যাতনের সংখ্যাও যে খুব কমে গেছে তাও সঠিক অর্থে বলা যাবে না। বিংশ শতাব্দীর ক্রান্তিলগ্নে এবং একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দেড় দশকে দাঁড়িয়ে নারীর সামাজিক অবস্থান পর্যালোচনায় বলা যায়, নারীরা শিক্ষিত হচ্ছে, বৃহত্তর কর্মযজ্ঞে নিজেদের সম্পৃক্ত করছে, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে তাদের আসন শক্ত করেছে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিজেদের অধিষ্ঠিত করেছে, ব্যবসা-বাণিজ্যে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে, রাজনৈতিক সচেতনতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে, সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানসমূহে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে, আইনী ব্যবস্থায় বিচারকের আসনে নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছে। প্রতিরক্ষা বাহিনীতেও সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছে আধুনিক নারী সমাজ। সম্পত্তিতে তাদের আইনগত অধিকার নিশ্চিত করেছে। এরপরেও অধিকারবঞ্চিত নারীদের সংখ্যাও অনেক। এখনও তারা প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে যাচ্ছে প্রচলিত সমাজব্যবস্থার সঙ্গে অপসংস্কারের বিরুদ্ধে, ধর্মীয় গোড়ামি থেকে বের হওয়ার দৃঢ় সংকল্পে, আইনী লড়াইয়ে নিজেদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে এবং মানুষের অধিকার নিয়ে বাঁচার তাগিদে।
×