ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

ফ্রান্সে ডি-র‌্যাডিকেলাইজেশন

প্রকাশিত: ০৭:০৫, ২০ এপ্রিল ২০১৬

ফ্রান্সে ডি-র‌্যাডিকেলাইজেশন

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর থেকে গত ১৫ বছরে জিহাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লোকজনকে সরিয়ে নেয়ার জন্য অনেক চেষ্টা চালানো হয়েছে। এতে সমাজ, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সার্ভিসগুলো যেমন যুক্ত হয়েছে, তেমনি হয়েছে জাতীয় ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। ধর্মীয় ও সেক্যুলার নেতারাও এতে জড়িত হয়েছে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয় জগতে এই কার্যক্রমগুলোই বিভিন্ন নামে নেয়া হয়েছে। কোথাও এর নাম দেয়া হয়েছে ‘ডি-র‌্যাডিকেলাইজেশন’, কোথাও কাউন্টার র‌্যাডিকেলাইজেশন, আবার কোথাও বা ‘কাউন্টারিং ভায়োলেন্ট এক্সট্রিমিজম’। উদ্দেশ্য সবারই একÑ মানুষকে সন্ত্রাসী কর্মকা- থেকে দূরে সরিয়ে রাখা। কিন্তু সব দেশে এ সংক্রান্ত সব কর্মসূচীই ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ২০১৫ সালের শেষনাগাদ সিরিয়ার লড়াইয়ে অংশ নেয়া পশ্চিম ইউরোপীয় জিহাদীদের সংখ্যা মাত্র দেড় বছরের মধ্যে দ্বিগুণ বেড়েছে। এই সংখ্যা বৃদ্ধি ঠেকাতে সেখানকার সরকারগুলো হিমশিম খাচ্ছে। জনসংখ্যার অনুপাতে বেলজিয়ামই সর্বাধিকসংখ্যক যোদ্ধা আইএসকে যুগিয়েছে। আবার চূড়ান্ত সংখ্যার বিচারে ফ্রান্স থেকেই সর্বাধিক যোদ্ধা যোগ দিয়েছে জিহাদী লড়াইয়ে। দু’বার সন্ত্রাসী হামলা হয়ে যাওয়ার পর জরুরী অবস্থার মধ্যে থাকা ফ্রান্স ইদানীং ডি র‌্যাডিকেলাইজেশনের দিকে ঝুঁকেছে। এ বছরের গোড়ার দিকে সে দেশের ৪টি কারাগারে বাধ্যতামূলক পুনঃশিক্ষা কর্মসূচী চালু হয়েছে। সেখানে সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিদের বিশেষ ইউনিটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। র‌্যাডিকেল তরুণদের জন্য ফ্রান্স শীঘ্রই প্রথম আবাসিক কেন্দ্র চালু করতে যাচ্ছে। স্থানীয় পর্যায়েও বেশ কিছু পরীক্ষামূলক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ফ্রান্সে আল্পেস-মেরিটাইমেস নামে একটি বিভাগ আছে, যার কাজ হলো প্যারিস অঞ্চলের বাইরে উগ্রবাদ সমস্যাটিকে দেখা। এ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী পুরনো নগরী নীস ও তার আশপাশের শহরের কমপক্ষে ৫৫ জন বাসিন্দা বর্তমানে সিরিয়ায় লড়ছে। তার মধ্যে একটি পরিবারেরই সদস্য হচ্ছে ১১ জন। ২০১৪ সাল থেকে এই বিভাগ র‌্যাডিকেল পথে সদ্য আগত ব্যক্তিদের সম্পর্কে ৫২২টি সতর্ক বার্তা রেকর্ড করেছে। ইসলামের হিংস্রাশ্রমী মত ও পথ প্রচার করছেÑ এমন সন্দেহের বশবর্তী হয়ে বিভাগটি সম্প্রতি পাঁচটি গুপ্ত মসজিদ বন্ধ করে দিয়েছে। বছরখানেক আগে আল্পেস-ম্যারিটাইমেস একটি কর্মসূচী চালু করেছিল, যা আজ একটা মডেলে পরিণত হয়েছে। এন্তার অটারসের মতো একটা স্থানীয় পারিবারিক সাহায্য সংগঠনের সহায়তায় আল্পেস-ম্যারিটাইমেস কী কী বিষয়ে দেখতে পেলে সেগুলোকে উগ্রবাদের লক্ষণ বলে ধরে নিতে হবে এবং তদনুযায়ী সংশ্লিষ্ট সবাইকে সজাগ করে দিতে হবেÑ সে ব্যাপারে শিক্ষক, পুলিশ, সমাজকর্মী, ডাক্তার, কারা অফিসার ও অন্যদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়েছে। পরিবারের জন্য জাতীয় টেলিফোনের একটি হেল্পলাইন স্থানীয় সতর্ক সঙ্গেত জানানোর কাজে ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া র‌্যাডিকেলাইজেশন বিরোধী একটি সেল সপ্তাহে দু’দিন করে বৈঠকে মিলিত হয়। এ সতর্কীকরণ ব্যবস্থার ফলে কয়েকজন তরুণের সিরিয়ায় জিহাদে অংশ নিতে রওনা হওয়া বন্ধ হয়েছে। গত বছর দু’জন কিশোরকে টেক অফ করার আগে নীস বিমানবন্দরে বিমান থেকে ধরে আনা হয়। ফরাসী সন্ত্রাস দমন আইন অনুযায়ী জিহাদীদের দেশত্যাগ আটকে দেয়া ও তাদের পাসপোর্ট বাজেয়াফত করে নেয়া যায়। গত বছর ফ্রান্সের বাজেটে সন্ত্রাস দমন তৎপরতার পেছনে বাড়তি ৪৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার বরাদ্দ করা হয়। এতে এ তৎপরতায় গতিবেগ সঞ্চারিত হয়েছে সত্য, তবে এক্ষেত্রে দুটো সমস্যাও রয়ে গেছে। একটা সমস্যা দেশের কঠোর সেক্যুলার ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত। সেই ঐতিহ্য অনুযায়ী ধর্মের অবস্থান সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বাইরে। অবশ্য আল্পেস-মেরিটাইমেস পরীক্ষামূলক ভিত্তিতে সাময়িকভাবে তার কার্যক্রম স্থানীয় মুসলমান নেতাদের অন্তর্ভুক্ত করতে শুরু করেছে। এতে সমাজকর্মী ও শিক্ষকরা অস্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে। আবার ধর্মকে বাদ দিয়ে রাখলে বিশ্বাসযোগ্যতার ক্ষেত্রে বিরাট ঘাটতিরও সৃষ্টি হবে। যেমন নীসের এক ইমাম বুরেকিউর বেকরি যিনি সন্ত্রাসী ভাবধারার বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছেন। তিনি বলেছেন যে, যেসব তরুণের সঙ্গে কথাবার্তা বলে তিনি উগ্রবাদী ভাবধারা থেকে সরিয়ে আনছেন তাদের আবার এমন সব ভাবধারার দ্বারা প্রভাবিত করার চেষ্টা চলছে, যার সঙ্গে ইসলাম ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই। দ্বিতীয় সমস্যাটা হলো গোপনীয়তা রক্ষার ব্যাপারে আশঙ্কা। যারা এ সমস্যা মোকাবিলায় এগিয়ে এসেছেন তারা স্বেচ্ছায় তা করছেন। তথাপি এর মধ্যে যেসব সমাজকর্মী রয়েছেন তারা কোনভাবেই চান না যে তাদের ইনফর্মার হিসেবে দেখা হোক। কারণ যে দেশে গোয়েন্দা বাহিনীর হাতে প্রায় সাড়ে দশ হাজার ইসলামপন্থীর ওপর ফাইল আছে এবং যে দেশে জরুরী অবস্থা বিরাজ করছে সেখানে এ জাতীয় তথ্য প্রকাশ পেলে কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। তারপরও কিশোর ও তরুণরা শরীরে বিস্ফোরকের বেল্ট বেঁধে অভিযানে নামার কথা চিন্তাভাবনা করার আগে তাদের সঙ্গে কথা বলে সে পথ থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। সেই সঙ্গে চলছে সন্ত্রাসবাদী সম্পর্কে আগাম হুশিয়ারি প্রদানের প্রয়াস। সূত্র : দ্য ইকোনমিস্ট।
×