ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

যুগ যুগ ধরে তৈরি করে মেলবন্ধন

মেলার দেশ বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৭:২৭, ১৬ এপ্রিল ২০১৬

মেলার দেশ বাংলাদেশ

বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী। কিন্তু উৎসবের দিন মানুষ বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ।’ কবিগুরু যথার্থই বলেছেন। উপলক্ষ যাই থাকুক না কেন, বাঙালীর সব উৎসবের মধ্যে সার্বজনীন রূপ আছে। এতে ধর্ম, সম্প্রদায়, জাত-পাত বা ধনী-গরিবের সামাজিক বিভক্তি কোন বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। বরং সব শ্রেণীর মধ্যে সেতুবন্ধন রচিত হয়। আর এ কারণেই কালের বিবর্তনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকতার ধরণ পাল্টালেও আবহমান বাংলার সামাজিক উৎসব, পার্বণ বা গণমানুষের মেলবন্ধনের ঐতিহ্য-কৃষ্টি আজও হারিয়ে যায়নি। ‘মেলা’ তেমনি প্রাচীন ঐতিহ্য। মেলা মানেই মহামিলন। মানুষের উচ্ছ্বাস-উল্লাসের বহির্প্রকাশ ঘটে মেলার মধ্য দিয়ে। ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ের উর্ধে উঠে মেলা মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন গড়ে তোলে। গ্রাম-বাংলার মেলা তাই হাজার বছরের ঐতিহ্যের এক মহা সম্মিলন। কবে, কোথায়, কখন প্রথম মেলার প্রচলন শুরু হয়েছিল- তা জানা না গেলেও এটি যে আবহমান বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য- তা নিয়ে সন্দেহ নেই। ধারণা করা হয়, গ্রামীণ হাট থেকেই আসে মেলার ধারণা। আগেকার দিনে রাজা-জমিদাররাও মেলার আয়োজন বা পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। ধর্মীয় উপলক্ষকে কেন্দ্র করেই মেলার জন্ম। বারো মাসের তেরো পার্বণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মেলার ঐতিহ্য। যেমন বৈশাখের বৈজু মেলা (আদিবাসীদের), মাস পহেলার মেলা, রাজপুণ্যাহ, রথমেলা, অষ্টমী মেলা, বারুনীমেলা, গাজন মেলা, চড়ক পূজার মেলা, শিবচতুর্দশীর মেলা, চৈত্রসংক্রান্তির মেলা, পৌষসংক্রান্তির মেলা, মাঘী পূর্ণিমার মেলা, গঙ্গার আবির্ভাব মেলা, বৌদ্ধ মেলা, মহরমের মেলা, মনসার মেলা, মঙ্গলচ-ীর মেলা, চিলাইর মেলা, ঝুলনযাত্রার মেলা, কার্তিক ব্রতের সঙ মেলা, বুড়াবুড়ির মেলা। এক সময় পীর-ফকির বা সাধু-সন্ন্যাসীদের আস্তানাগুলোও মেলার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। ধর্মীয় চেতনার বাইরে অন্যান্য সামাজিক বা লৌকিক আচারগুলোও যুক্ত হতে থাকে মেলার সঙ্গে। বাংলাদেশের এমন কোন জেলা বা উপজেলা নেই- যেখানে মেলার আয়োজন হয় না। বলা যায়, বাংলাদেশ মানেই ‘মেলার দেশ’। মেলা দেখেনি এমন বাঙালী পাওয়া যাবে না একজনও। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) গ্রামীণ মেলার ওপর দেশজুড়ে এক জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করেছিল ১৯৮৩ সালে। এক হাজার পাঁচটি মেলার সন্ধান পাওয়া যায় ওই জরিপে। জরিপ কার্যক্রমটি আরও পঞ্চাশ-একশ’ বছর আগে পরিচালিত হলে মেলার সংখ্যাটি যে কয়েকগুণ বেশি হতো- তা বলা যায় নি:সন্দেহে। বিসিকের প্রাপ্ত সংখ্যার নব্বইভাগ মেলাই গ্রামীণ। সারা বছরই দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভিন্ন ভিন্ন নামে এসব মেলা বসে। কখনও বট-পাকুড়ের ছায়ায়, নদীর পাড়ে, আবার কখনও মন্দির-মঠ-তীর্থস্থানে বা সাধু-সন্ন্যাসী-পীর-ফকিরদের আস্তানায় এবং গ্রামের খোলা মাঠে বসে এসব গ্রামীণ মেলা। এখনও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যেসব মেলার আয়োজন হয়Ñ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ঢাকার জিঞ্জিরার মেলা, ধামরাইয়ের রথমেলা, মজমপুর মেলা, কায়েতপাড়ার বাউল মেলা, নবাবগঞ্জের ধাইনগর মেলা, চরখাই কাটলা মেলা, চট্টগ্রামের চন্দ্রনাথ মন্দিরের মেলা, মাইজভা-ারীর মেলা, কাট্টালি মেলা, ফতেহাবাদের সূর্যমেলা, পটিয়ার ঠেগড়মুনির মেলা, জব্বারের বলি খেলার মেলা, বগুড়ার মহাস্থানের মেলা, ষোলগড়িয়ার মেলা, ধুনটের বকচরের মেলা, পোড়াদহের সন্ন্যাস মেলা, ওমরপুরের মেলা, জগদীশ গোসাইর মেলা, গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দির মেলা (মতুয়া মেলা নামেও পরিচিত), উনশিয়ার সিদ্ধান্তবাড়ির মেলা, পাবনার বোঁথরের চড়ক মেলা, হবিগঞ্জের মুড়াবন্দ দরবার শরীফের মেলা, বেলেশ্বরী মেলা, টাঙ্গাইলের ধনবাড়ির মেলা, ফাইলা পাগলার মাজারের মেলা, রাঙ্গামাটির পানছড়ি বৌদ্ধ মেলা, ভাইবোন ছড়ার জুরমরং শিবমেলা, দিনাজপুরের নেকমর্দন মেলা, গোরখাই মেলা, ভোলাকালীর মেলা, কুমিল্লার মুরাদনগরের শীতলার মেলা, বাজিতপুর মেলা, জল মহাভারতীর মেলা, সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জের বারুনী মেলা, সুবর্ণাসারা মেলা, নরসিংদীর মনোহরদীর শাহরানীর মেলা, কালীগঞ্জের বুকশূন্যার বারুনী মেলা, শরীয়তপুরের নড়িয়ার সুরেশ্বর মেলা, বজেশ্বর মেলা, বরগুনার কীর্তনমেলা, রাজশাহীর বারুনী মেলা, মানন্দার মেলা, কারবালার মেলা, ললিতনগরের মেলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাতমোড়ার মেলা, যশোরের সাগরদাড়ির মধুমেলা, পঞ্চগড়ের নিরাশির মেলা, ঠাকুরগাঁয়ের রানীশংকৈলের কাতিহার মেলা, বরিশালের বিপিনচাঁদ ঠাকুরের মেলা, কালীতলার মেলা, সূর্যমণির মেলা, চাঁদশী মেলা, ফরিদপুরের বুড়া শিব ঠাকুরের মেলা, তাড়াইলের মাঘী পূর্ণিমার মেলা, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের বাতিসার মেলা, মুরাদনগরের শ্রীকাইল মেলা, মুন্সীগঞ্জের ভাগ্যকুল মেলা, বিক্রমপুরের রামপালের মেলা, সিরাজগঞ্জের রাধাই মেলা, পটুয়াখালীর দশমিনার মেলা, শেরপুরের বারটিয়ার মেলা, সিলেটের শ্রী চৈতন্য মেলা, হারাইটেক মেলা, রংপুরের সিন্দুরমতি মেলা, নেত্রকোনার চ-ীগড় মেলা, বড়ান্তরের অষ্টমী মেলা, কলমাকান্দার চেংনী মেলা, মদনপুরের শাহসুলতান কমরুদিন রুমীর (র) মাজারের ওরস মেলা, পিরোজপুরের খারবাক মেলা, কুড়িগ্রামের কমলদীঘির মেলা, চাঁদপুরের কালীবাড়ির মেলা, খুলনার মোল্লারহাট মেলা, বাগেরহাটের খানজাহান আলীর মেলা, কুষ্টিয়ার মহরম মেলা, ছেঁউড়িয়ার লালন মেলা, লক্ষ্মীপুরের কালীরহাট মেলা, নড়াইলের নিশিনাথ তলার মেলা ও সুলতানের মেলা। এ ছাড়া সারাদেশে অষ্টমী, বারুনী উপলক্ষে চৈত্র-বৈশাখ মাসে আরও বেশ কিছু মেলা বসে। মেলাকে সামনে রেখে চারু, কারু, দারু ও অন্যান্য কুটির শিল্পীরা দীর্ঘ সময়ব্যাপী প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। কামার, কুমার, ও বাঁশবেতের শিল্পীরা নিপুণ হাতে তৈরি করে নানা জিনিসপত্র। শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সের মানুষের আকর্ষণ থাকে মেলায়। গ্রাম-বাংলার অনেকে মেলা থেকেই সারা বছরের ঘর গেরস্থালির অনেক জিনিসপত্র কিনে নেয়। তাই মেলার দর্শকদের প্রস্তুতিও কম থাকে না। অভাব-অনটন যাই থাকুক, মেলার জন্য সকলেরই ছোটখাটো বাজেট থাকে। মেলার আগে বড়রা শিশুদের নগদ টাকা বকশিশ দেয়। দূর-দূরান্তের আত্মীয়স্বজনরাও মানি অর্ডারে বা লোক মারফত পাঠিয়ে দেয় টাকা। কোন কোন অঞ্চলে এ ধরনের উপহারকে বলা হয় ‘মেলার পরবী’। বাহারি পণ্যের পসরা বসে মেলায়। শিশুদের আনন্দ-বিনোদনের জন্য মেলায় পাওয়া যায় মাটির পুতুল, পালকি, ঘোড়া, ষাঁড়, হরিণ, হরেক রকমের ঘুড়ি, টমটম, লাটিম, গাড়ি, বল, বেলুন, বাঁশিসহ নানা রকমের খেলনা। বহুল প্রচলিত ‘আমি মেলা থেকে তালপাতার এক বাঁশি কিনেছি...’ গানটি আজও গ্রামবাংলার মেলার সেই ঐতিহ্যকেই ধারণ করে আছে। গাঁয়ের কুলবধূ ও কিশোরীরা মেলা থেকে কিনে আনে আলতা, স্নো, পাউডার, কাঁচের চুড়ি, নাকের নোলক, কানের দুল, চুলের ফিতা, খোপা, ক্লিপসহ দেহাবরণের জিনিসপত্র। হিন্দু রমণীরা মেলা থেকে ফিরে একজন আরেকজনকে জলে ভাসা সাবান ও সিঁদুর উপহার দিয়ে শুভ কামনা জানায়। এ ছাড়া গেরস্থালির জিনিসপত্র যেমন : দা, কাঁচি, কুড়াল, খুন্তি, রান্নাবান্নার সরঞ্জাম, পাখা, ঢাকি, চালনি, ছিপি, জলচৌকি, পিঁড়ি থেকে শুরু করে বৃদ্ধদের ছড়িও পাওয়া যায় মেলায়। থাকে রসনা তৃপ্তির জিনিসপত্রও। বিশেষ করে মেলায় কেনা জিলাপি, গজা, লবঙ্গ, রসগোল্লা, কদমা, তিলুয়া-বাতাসা, ওখরা, বিন্নি ধানের খৈ ও দই-চিড়ার স্বাদই আলাদা। কাপড়, মনোহারি, প্লাস্টিক পণ্য, পূজার জিনিসপত্র, ধর্মীয় পোস্টার, ছবি, বাঁশবেতের সামগ্রী, তামা-কাঁসা-পিতলের বাসনপত্র প্রভৃতির দোকানও বসে মেলায়। দর্শকদের তাৎক্ষণিক মনোরঞ্জনের জন্যও থাকে নানা আয়োজন। নাগরদোলা, লাঠিখেলা, কুস্তিখেলা, পুতুলনাচ, যাত্রাগান, কবিগান, বাউলগান, ঘাটুগান, জারিগান, গাজীর গান, পীর-ফকিরদের গান, বায়োস্কোপ, সঙ, সার্কাস, লটারি, পুণ্যস্থানে কীর্তন, গঙ্গাপূজা, শীতলা পূজা, নৌকা বাইচ, ষাঁড়ের লড়াই প্রভৃতি আয়োজন দর্শকদের বাড়তি খোরাক যোগায়, মেলাকে পরিণত করে আনন্দ সাগরে। অষ্টমী, বারুনী বা বিভিন্ন পুণ্যস্থানের মেলাকে বাংলার মানুষ ধর্মীয় উৎসব বলেই মনে করে। প্রসঙ্গত কোথাও কোথাও মেলার নামে জুয়া-হাউজি-অশ্লীল নৃত্যসহ কিছু অপসাংস্কৃতিক কর্মকা-ও চলে। মূলত এর পেছনে থাকে অর্থলিপ্সা। মেলায় হাজারো মানুষের স্রোতকে পুঁজি করে এক শ্রেণীর লোক এ ধরনের বেআইনী উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার চেষ্টা করে। এতে মেলার পরিবেশ শ্রীহীন হয়। তবে সর্বসাধারণ কখনও এ বিষয়গুলোকে মেলার আঙ্গিক হিসেবে মনে করে না। তারা মেলাকে ধর্মীয় উৎসব, লোকাচার, আনন্দ-বিনোদন বা বছরের বিশেষ দিন হিসাবেই মনে করে। বাংলাদেশ ‘মেলার দেশ’ হলেও গ্রামীণ মেলার সেই জৌলুস দিন দিন কমে আসছে। কমছে মেলার সংখ্যাও। আগে গ্রামাঞ্চলে বা বিভিন্ন তীর্থস্থানে আয়োজক কমিটির ব্যবস্থাপনায় যেভাবে মেলার আয়োজন হতো- এখন তা আগের মতো হয় না। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু দায়িত্ব পালন ছাড়া সরকারীভাবে গ্রামীণ মেলাকে তেমন পৃষ্ঠপোষকতা করা হয় না বললেই চলে। তবে কিছুটা সুখবর হচ্ছে- গ্রামীণ মেলার কনসেপ্টকে ধারণ করে এখন অনেক আধুনিক জিনিসপত্রেরও মেলা বসে। বিভিন্ন মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতায় এ ধরণের আয়োজন হয় শহরাঞ্চলে। যেমন : মোবাইল মেলা, কম্পিউটার মেলা, আইটি মেলা, আবাসন মেলা। আবার সরকারী পৃষ্ঠপোষকতাতে বিজ্ঞান মেলা, বাণিজ্যমেলা, শিল্পমেলা, বইমেলা, কৃষি মেলা, স্বাধীনতা মেলা প্রভৃতি নামের কিছু মেলার আয়োজন করা হয়। আয়োজন যারাই করুক আর যেভাবেই হোক, মেলা যুগ যুগ ধরে মানুষের মধ্যে মেলবন্ধন তৈরি করে আসছে। নানা ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ের মধ্যে রচনা করছে সেতুবন্ধন। তাই মেলা বেঁচে থাকুক চিরদিন। Ñসঞ্জয় সরকার, নেত্রকোনা থেকে
×