ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সুপ্রীমকোর্টের বিচারক অপসারণ আইনের খসড়া সিনহার হাতে

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ৮ এপ্রিল ২০১৬

সুপ্রীমকোর্টের বিচারক অপসারণ আইনের খসড়া সিনহার হাতে

আরাফাত মুন্না ॥ কোন বিচারপতির বিরুদ্ধে ওঠা অসদাচরণ বা অসামর্থ্যরে অভিযোগ তদন্তের ক্ষমতা সাবেক একজন প্রধান বিচারপতি বা আপীল বিভাগের একজন সাবেক বিচারপতির নেতৃত্বাধীন কমিটিকে এবং ওই বিচারকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা সংসদকে দিয়েছে ‘সুপ্রীমকোর্টের বিচারকগণের অসদাচরণ ও অসামর্থ্যতা (তদন্ত ও দায় নির্ধারণ) আইন, ২০১৬’। কোন বিচারকের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগকারীকেও শাস্তির আওতায় আনার বিধান রাখা হয়েছে প্রস্তাবিত এই আইনে। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর আলোকেই এই আইনের খসড়া তৈরি করেছে আইন কমিশন। ইতোমধ্যে কমিশন থেকে খসড়াটি পাওয়ার পর আইন মন্ত্রণালয় তা প্রধান বিচারপতির মতামতের জন্য পাঠিয়ে দিয়েছে। প্রধান বিচারপতির মতামত পাওয়ার পরই আইনটি চূড়ান্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। ওই খসড়া আইনটির অনুলিপি জনকণ্ঠের হাতে এসেছে। বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে থাকলেও পরে নানা ঘটনায় তা পরিবর্তিত হয়েছে। পরে ২০১৪ সালে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারক অপসারণের ওই ক্ষমতা পুনরায় সংসদের হাতে ফিরিয়ে আনা হয়। এর পরই অপসারণের পদ্ধতি নিয়ে একটি আইন প্রণয়নের কথা বলেছিলেন আইনমন্ত্রী। যে কারণে অপসারণ ॥ খসড়া আইনে বিচারপতিদের অসদাচরণ ও অসামর্থ্যরে সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে, বিষয় বা প্রসঙ্গের সঙ্গে কোন কিছু না থাকিলে এই আইনে- ‘অসদাচরণ অর্থ- কোন বিচারক কর্তৃক ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী হয়ে বিচার পরিচালনা বা রায় দেয়া; পদমর্যাদা বা কার্যালয়ের অপব্যবহার করে আর্থিক, বস্তুগত কিংবা অন্য কোন সুবিধা নেয়া; নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধ; বিচারকাজে প্রভাবিত হওয়া বা অন্যকে প্রভাবিত করা।’ ইচ্ছাকৃত ও ক্রমাগত বিচারিক কর্তব্য পালনে ব্যর্থতা, জীবনবৃত্তান্তে ইচ্ছাকৃতভাবে প্রাসঙ্গিক কোন তথ্য গোপন করলেও অপসারণের উদ্যোগ নেয়া যাবে বলে প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে। এতে অসামর্থ্য বলতে কোন বিচারকের স্থায়ী প্রকৃতির শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যতাকে উল্লেখ করা হয়েছে। যেভাবে অপসারণ করা যাবে ॥ খসড়া আইনে বলা হয়েছে, যে কেউ সংসদের স্পীকারের কাছে কোন বিচারকের বিরুদ্ধে অসদাচরণ ও অসামর্থ্যরে অভিযোগ আনতে পারেন। সংক্ষুব্ধ ওই ব্যক্তির অভিযোগ প্রাথমিক বিবেচনার জন্য স্পীকার ১০ জন সংসদ সদস্য নিয়ে গঠিত কমিটির কাছে পাঠাবেন। সংসদ সদস্যদের ওই কমিটি যদি মনে করেন প্রাথমিকভাবে অভিযোগটির সত্যতা রয়েছে তাহলে তারা স্পীকারকে লিখিতভাবে জানাবেন। কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর স্পীকার সংসদে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বিষয়টি উত্থাপন করবেন। সংসদ যদি মনে করে ওই অভিযোগ তদন্ত করা প্রয়োজন তাহলে তা তদন্ত কমিটির কাছে পাঠাবে। অভিযুক্ত বিচারক আত্মপক্ষ সমর্থন করে কমিটির চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত বক্তব্য রাখতে পারবেন বলেও খসড়ায় বলা হয়েছে। কোন বিচারকের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠনের প্রস্তাব রেখেছে আইন কমিশন। একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি অথবা আপীল বিভাগের সাবেক একজন বিচারপতিকে কমিটির চেয়ারম্যান করা হবে। সদস্য থাকবেন একজন সাবেক এ্যাটর্নি জেনারেল এবং একজন সম্ভ্রান্ত নাগরিক। তবে কোনভাবেই কমিটির কোন সদস্যের বয়স ৬৭ বছরের কম হবে না। কোন বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য যদি প্রমাণিত হয় তাহলে ওই বিচারককে সংসদে আত্মপক্ষ সমর্থন করে লিখিত বা মৌখিক বক্তব্য দেয়ার বিধান প্রস্তাব করেছে আইন কমিশন। এর পর সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য যদি ওই বিচারকের অসামর্থ্য বা অসদাচরণের জন্য অপসারণের সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে ওই প্রস্তাব রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হবে। রাষ্ট্রপতি তাকে অপসারণ করবেন। আর কমিটির তদন্তে যদি অভিযুক্ত বিচারক নির্দোষ প্রমাণিত হন তাহলে তা প্রতিবেদন দিয়ে স্পীকারকে জানানো হবে। স্পীকার তা সংসদে উপস্থাপন করবেন। খসড়া আইনে বলা হয়েছে, সংসদ যদি ওই প্রতিবেদন নিষ্পত্তি না করে আবার তদন্ত কমিটি গঠন করতে বলে তাহলে একই প্রক্রিয়ায় আবার তদন্ত হবে। খসড়ায় বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি যদি কোন বিচারকের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন, হয়রানিমূলক বা অসত্য অভিযোগ আনেন, তবে ওই ব্যক্তির দুই বছর বিনাশ্রম কারাদ- এবং অনুর্ধ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা হবে। ফিরে দেখা ॥ ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের সময় উচ্চ আদালতের বিচারকদের পদের মেয়াদ নির্ধারণ এবং তাদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে ছিল। এর পর ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীতে এই ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে চলে আসে। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর চতুর্থ সংশোধনী বাতিল হলে জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকারের আমলে ১৯৭৭ সালে এক সামরিক ফরমানে বিচারপতিদের অভিশংসনের জন্য সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করা হয়। আইন কমিশন এই জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে ‘সামরিক ফরমানের মাধ্যমে একজন অবৈধ সামরিক শাসকের খেয়ালখুশি ও মর্জিমাফিক সম্পূর্ণ এখতিয়ারবিহীন ও অসাংবিধানিক’ বলে আখ্যায়িত করেছে। জিয়ার আমলে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে বৈধতা দেয়া হয়েছিল। তার পর থেকে ওই ধারাই চলে আসছিল। তবে এর মধ্যে সর্বোচ্চ আদালত পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ এবং সামরিক শাসনামলে প্রণীত সব আইন ও কার্যাবলী বাতিল ঘোষণা করলে এই সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিলও অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়ে। পরে ২০১২ সালে তৎকালীন স্পীকার ও বর্তমান রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের একটি রুলিংকে কেন্দ্র করে কয়েকজন সংসদ সদস্য হাইকোর্টের একজন বিচারপতিকে অপসারণের দাবি তোলেন। মূলত সে সময়েই বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে আনার দাবি জোরালো হয়। এর পর ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী সংক্রান্ত বিল পাস হয়। রিট আবেদন ॥ উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর বৈধতা নিয়ে একটি রিট আবেদনও হয়েছে। হাইকোর্টে বিচারাধীন এই রিট আবেদনে আগামী ৫ মে রায় ঘোষণার দিন ধার্য রয়েছে। বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মোঃ আশরাফুল কামালের বিশেষ বেঞ্চ এই আবেদনের রায় দেবে। ষোড়শ সংশোধনী সংসদে পাসের পর সুপ্রীমকোর্টের নয়জন আইনজীবী ২০১৪ সালের ৫ নবেম্বর রিট আবেদনটি করেন। রিট আবেদন দাখিলের পর এতে আদালতের একটি রুল আসে। তাতে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের কাছে ন্যস্ত করা সম্পর্কিত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আইন কেন বেআইনী ও সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চাওয়া হয়। এই রুলের ওপর গত বছরের ২১ মে শুনানি শুরু হয়। শুনানিতে এ্যামিকাস কিউরি (আদালত বন্ধু) হিসেবে ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, মাহমুদুল ইসলাম, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ ও আজমালুল হোসেন কিউসির বক্তব্য শোনে আদালত।
×