ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

গোয়েন্দা নজরদারিতে ওয়েব জগত

প্রকাশিত: ০৬:৩১, ৫ এপ্রিল ২০১৬

গোয়েন্দা নজরদারিতে ওয়েব জগত

এনামুল হক ইন্টারনেটের আবির্ভাব তথ্য ও বিনোদনের জগতকে বদলে দিয়েছে। যে তথ্য ও বিনোদন একদা অতি ব্যয়বহুল ছিল অথবা সরকারী অফিসগুলোর ভেতরেই আবদ্ধ ছিল তা নিমেষের মধ্যে সহজলভ্য হয়ে ওঠে। প্রতিভাবান তরুণরা তথ্যের জগত গড়ে তুলতে এবং বিশ্বকে আরও উন্মুক্ত ও সংযোগসাধিত করতে লেগে যায়। এই সহজ অনলাইন যোগাযোগের বদৌলতেই মিসরীয়রা স্বৈরাচারী হোসনি মোবারককে উৎখাতের আন্দোলন করতে পেরেছিল। কিন্তু ইন্টারনেটের সেই অবস্থা আর থাকেনি। রাষ্ট্রসমূহ এই নতুন এলাকাটিকে বেশিদিন শাসন ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে রাখতে দেয়নি। ইউরোপিয়ান কমিশনার ফর কমপিটিশন আস্থাহানির অভিযোগ এনে গুগলকে ঘায়েল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ্যাপল তার আইফোনের তথ্যের গোপনীয়তা প্রকাশ করবে কি করবে না তা নিয়ে এফবিআইয়ের সঙ্গে এই কোম্পানির মামলার লড়াই চলছে। সারা বিশ্বের স্বৈরাচারী সরকারগুলো মিশরের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে অনলাইন গোয়েন্দাগিরি ও নজরদারির পেছনে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছে। ফিল্টারিং ব্যবস্থায় অনলাইনে সংযোগপ্রাপ্তি সীমিত করা হয়েছে। যেমন ব্রিটেনে পর্ণ, চীনে ফেসবুক ও গুগল এবং রাশিয়ায় ভিন্নমত প্রকাশ। পরস্পর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত অপারেটিং সিস্টেম ও নেটয়ার্কগুলো তাদের ব্যবহারকারীদের নিজেদের আওতায় ধরে রাখার জন্য নানা ধরনের প্রণোদনা দিয়ে থাকে এবং এভাবে নিজ নিজ শক্তি ও ক্ষমতাকে সংহত করে। তাদের এলগোরিদমগুলো ওয়েবকে এমনভাবে ব্যক্তিগতকরণ করে ফেলে যে দু’জন মানুষ একই সার্চ রেজাল্ট কিংবা সামাজিক মিডিয়ার উপকরণ পায় না। তার ফলে ডিজিটাল ব্যবস্থায় অভিন্নতার ধারণাটি আর থাকে না। ওয়েবের ব্যবসার প্রধান মডেল হলো বিজ্ঞাপন। এই বিজ্ঞাপন থেকে আয়ের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই চলে যায় পাঁচ কোম্পানির হাতে। ডাউনলোড করার জন্য যে মিলিয়নসংখ্যক এ্যাপ আছে অধিকাংশ লোক মাসে তার ত্রিশটিরও কম ব্যবহার করে। গোটা ওয়েবের মাত্র প্রায় ২০ শতাংশ হলো উন্মুক্ত ইন্টারনেট। বাকিটা ফেসবুকের মতো সার্চ করার অসাধ্য প্রাচীর বেষ্টিত উদ্যানগুলোতে যার এলগোরিদম অস্পষ্ট, ছায়াময়। কিংবা তা রয়েছে ‘ডার্ক ওয়েবে’। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ক্রিয়াকলাপ থেকে সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত মুষ্টিমেয় কয়েকটি হাতে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে এবং সেই হাতগুলো যথেষ্ট লম্বাও বটে। এক তথ্যে জানা গেছে এ বছর বিশ্বের ২০টি বড় অর্থনীতির দেশের জিডিপির ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বা ৪ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার আসবে ইন্টারনেট থেকে। এই অবস্থাটা হলো কিভাবে? এর সহজ উত্তর হলো সিলিকন ভ্যালির আশাবাদী মহল যে অবাধ, মুক্ত ও গণতান্ত্রিক ইন্টারনেটের স্বপ্ন দেখেছিল সেটির অস্তিত্ব অতি সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্যই কেবল ছিল। তার বাইরে আর কখনই ছিল না। আরও সূক্ষ্মভাবে বলতে গেলে উন্মুক্ত ইন্টারনেটের অস্তিত্ব সত্যিকার অর্থে কখনই ছিল না। এতে অবাক হবার কিছু নেই। স্কট ম্যালকমসন ‘স্পিøন্টারনেট’ নামে এক বই লিখেছেন সেটাকে ইন্টারনেটের অতীত ও ভবিষ্যতের একটা জরিপ বলা যেতে পারে। আসলে মার্কিন সামরিক বাহিনী তাদের সামরিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য এই জরিপ চালিয়েছে। তা থেকে জানা যায় যে, প্রায় প্রতিটি প্রযুক্তি যা স্মার্টফোনকে এমন চমৎকার রূপ দিয়েছে সেটির জীবন শুরুই হয়েছে যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে। যুদ্ধজাহাজের আকার বা সাইজ সীমিত করার জন্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপরই ‘দি ওয়াশিংটন নেভাল ট্রিটি’ নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ওতে এমন মেশিন উদ্ভাবনের প্রেরণা দেয়া হয়েছিল যা বন্দুক বা কামানের নিখুঁত লক্ষ্যভেদের জন্য প্রয়োজনীয় জটিল গাণিতিক হিসাব করতে সক্ষম। পার্ল হারবারের ওপর আক্রমণই অপারেটিং সিস্টেম সংবলিত প্রথম কম্পিউটার নির্মাণে বেগ সঞ্চারিত করেছিল। রাডার সন্ধানী স্ক্রিনের প্রয়োজন থেকেই কম্পিউটার স্ক্রিন উদ্ভাবিত হয়েছিল। ইন্টারনেটের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তাই। ইন্টারনেটের পূর্বসূরি ছিল আরপানেট। এটি সৃষ্টি করেছিল এ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্টস এজেন্সি। সোভিয়েত ইউনিয়ন মহাশূন্যে স্ফুটনিক পাঠানোর জবাবে প্রেসিডেন্ট আইজেন হাওয়ার এই সংস্থা গঠন করেছিলেন। ইন্টারনেটের ভিত্তি হলো যোগাযোগের বিকেন্দ্রীকৃত প্যাকেটভিত্তিক ব্যবস্থা। নিজের মাটিতে বড় ধরনের আক্রমণ সামলে নেয়ার প্রয়োজন থেকে আমেরিকায় এটা উদ্ভাবিত হয় বলে স্কট ম্যালকমসন উল্লেখ করেন। আশির দশকে মার্কিন সামরিক বাহিনী ইন্টারনেটে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে শুরু করে। সোভিয়েতের পতন ও স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের ফলে অগ্রাধিকার আরও পরিবর্তন ঘটে। হ্যাকার ও গিকরা যারা গোড়ারদিকের কম্পিউটার ও ফোনলাইন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছিল তাদের সময় এসে যায়। আজ তারা জায়েন্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে। গুগল, এ্যাপল, ফেসবুক, এ্যামাজন ও মাইক্রোসফট এবং সেইসঙ্গে কতিপয় টেলিকম অপারেটর মিলে ইউরোপ ও আমেরিকায় প্রাইভেসির অধিকার ও কপিরাইট আইন থেকে শুরু করে শিশু নিরাপত্তা ও জাতীয় নিরাপত্তা পর্যন্ত সবকিছুর নীতি নির্ধারণ করছে। এই কোম্পানিগুলো যতই শক্তিশালী হয়ে উঠছে রাষ্ট্র ততই পিছু হটছে। ১৯৯৬ সালের ইন্টারনেট এবং ২০১৬ সালের ইন্টারনেটের মধ্যে মিল খুবই কম। ১৯৯৬ সালে প্রায় ৫ কোটি লোক বা বিশ্বের শূন্য দশমিক ৮৬ ভাগ জনগোষ্ঠী ইন্টারনেট ব্যবহার করত। আজ মানবজাতির ৪০ শতাংশেরও বেশি অনলাইনে রয়েছে। সেই ইন্টারনেটের ওপর এখন নজরদারির হুমকি যার ফলে বাক-স্বাধীনতার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এডওয়ার্ড স্নোডেন ও জুলিয়ান এসেঞ্জের ফাঁস করা তথ্য থেকে প্রমাণ হয়ে গেছে ডিজিটাল তথ্যের ওপর গোয়েন্দাবাহিনীর নজরদারির প্রবণতা ও প্রলোভন অবদমিত রাখা কত কঠিন। এমনকি সবচেয়ে উদারপন্থী দেশও এ থেকে মুক্ত নয়। আরেকটা বড় ঝুঁকি হলো রাষ্ট্রসমূহ ও কোম্পানিগুলোর মধ্যকার মিথোজীবী সম্পর্ক। ফাঁস হয়ে যাওয়া এক ই-মেইলে দেখা গেছে যে গুগুলের এক কর্মকর্তা হিলারি ক্লিন্টন পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে তাঁর পররাষ্ট্র দফতরের সঙ্গে এক অনলাইন কৌশল নিয়ে কথাবার্তা বলেন যে কৌশলের দ্বারা আরও বেশিসংখ্যক সিরীয়কে সরকারের পক্ষত্যাগ করতে উৎসাহিত করা ও বিরোধী শিবিরে আস্থার ভাব সঞ্চার করা যাবে। ম্যালকমসন তাই মন্তব্য করেছেন যে বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো যদি একটা দেশের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক স্বার্থোদ্ধারে নীরবে সহায়তা করে তাহলে সংশয় সন্দেহ কেবল বাড়বে এবং ওয়েব জগতটি বিভিন্ন আঞ্চলিক ইন্টারনেটে খ-বিখন্ড হওয়ার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হবে। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×