ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চুরি প্রক্রিয়ার সিংহভাগ কাজই হয় ব্যাংকের কম্পিউটার সার্ভার হ্যাক করে ;###;সার্ভার সংশ্লিষ্ট ৪০ কম্পিউটার শনাক্ত ;###;২২ আইটি বিশেষজ্ঞসহ ৫০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ ;###;১১ কর্মকর্তার সাক্ষ্যগ্রহণ

গাফিলতি মনিটরিংয়ে

প্রকাশিত: ০৫:২১, ১৮ মার্চ ২০১৬

গাফিলতি মনিটরিংয়ে

গাফফার খান চৌধুরী ॥ শুধু মনিটরিংয়ের অভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভার হ্যাক হয়; আর সার্ভার হ্যাক করে অর্থ লুটে নেয়ার ঘটনাটি ঘটে। টাকা চুরির পুরো প্রক্রিয়াটির সিংহভাগ কাজই হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের কম্পিউটার সার্ভার হ্যাক করে। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে আজ ঢাকার মালিবাগ সিআইডি সদর দফতরে সিআইডি কর্মকর্তাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার (এফবিআই) একটি দল বৈঠকে বসছে। ইতোমধ্যেই সার্ভারের সঙ্গে যুক্ত ৪০টি কম্পিউটারের হাজার হাজার ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে সংগ্রহ করা হয়েছে অসংখ্য সিসি ক্যামেরা ফুটেজ। কম্পিউটার সার্ভারের সঙ্গে যুক্ত ২২ জন আইটি বিশেষজ্ঞসহ মোট ৫০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাদের জবানবন্দী রেকর্ড রাখা হয়েছে। যাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে এবং যাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তালিকা করা হয়েছে- তাদের দেশের বাইরে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। তাদের রাখা হয়েছে সর্বক্ষণিক গোয়েন্দা নজরদারির মধ্যে। গত ১৫ মার্চ মঙ্গলবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের জমা রাখা টাকা চুরির ঘটনায় মতিঝিল থানায় একটি মামলা দায়ের হয়। মামলার এজাহারে কাউকে অভিযুক্ত করা হয়নি। আসামিদের অজ্ঞাত হিসেবে এজাহারভুক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব ও বাজেট বিভাগের যুগ্মপরিচালক জোবায়ের বিন হুদা মামলাটি দায়ের করেন। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে তিনি মামলাটি দায়ের করেন। মামলা দায়েরের পর পরই মামলাটির তদন্তভার পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডিতে স্থানান্তর করা হয়। বুধবার প্রযুক্তি বিষয়ে পারদর্শী সিআইডির একটি বিশেষ স্কোয়াড বাংলাদেশ ব্যাংকে যায়। তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের উর্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে। বৈঠকে ঘটনার আদ্যোপান্ত আলোচনা হয়। বৃহস্পতিবারও প্রযুক্তি বিষয়ে বিশেষভাবে পারদর্শী সিআইডির সাত সদস্যের একটি স্কোয়াড বাংলাদেশ ব্যাংকে যায়। তারা সেখান থেকে বহু আলামত জব্দ করে। সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের টাকা যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে রাখা হয় নানা কারণে। বিশেষ করে বিদেশী কোম্পানির বিল পরিশোধ, ব্যবসায়িক লেনদেনসহ নানা কারণে সেখানে রাখা হয়। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশই যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে অর্থ রাখে। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে এভাবেই ফেডারেল ব্যাংকে টাকা রাখছে। এতে অনেক লেনদেনে দেশের আর্থিক সাশ্রয় হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যাংকে টাকা রাখলেও তা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে মনিটরিং করার ব্যবস্থা আছে। চব্বিশ ঘণ্টাই ফেডারেল ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের। এমন যোগাযোগ রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি বিশেষ সার্ভার স্টেশন রয়েছে। সেই স্টেশনে বসেই বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিষয়ের প্রযুক্তিবিদরা অনায়াসে টাকার লেনদেন থেকে শুরু করে সার্বিক বিষয়ের ওপর নজর রাখতে পারে। সেই সার্ভার স্টেশনটি চব্বিশ ঘণ্টা মনিটরিং করতে বাংলাদেশ ব্যাংকেই ২২ জন আইটি বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। যাদের মূল কাজই হচ্ছে পর্যায়ক্রমে সার্ভারটি চব্বিশ ঘণ্টা মনিটরিং করা। সার্ভার রুমে কোন প্রকার ত্রুটি দেখা দিলে তারা তা নিজেরাই সারবেন। না পারলে বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার কথা। কিন্তু অবাক করা বিষয় হচ্ছে, অনেক দিন ধরেই সার্ভার রুমটি চব্বিশ ঘণ্টা মনিটরিং হচ্ছিল না। মনিটরিং না হওয়ার ফলে কম্পিউটারে ত্রুটি দেখা দেয়। সে বিষয়টি নিজস্ব আইটি বিশেষজ্ঞরা সমাধানে ব্যর্থ হন। এরপর বিষয়টি কাউকে না জানিয়ে সেভাবেই ফেলে চলে যান। গত ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কম্পিউটারের কোন কিছুই প্রিন্ট হয়নি। নানা চেষ্টা করেও আইটি বিশেষজ্ঞরা প্রিন্ট করতে ব্যর্থ হয়েছেন, যা সংশ্লিষ্টরা বাংলাদেশ ব্যাংকের উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানানোর কথা থাকলেও জানায়নি। শুধু তাই নয়, সার্ভারে ত্রুটি দেখার পর দায়িত্বরতরা নির্ধারিত সময়ের আগেই কাউকে কিছু না বলেই অফিস ত্যাগ করেন। পর্যায়ক্রমে দায়িত্বরত সবাই একই কাজ করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের রির্জাভ থেকে টাকা চুরির বিষয়টি প্রকাশ্যে এলে এসব বিষয় তদন্তে বেরিয়ে আসে। কর্মকর্তাদের এমন গাফিলতির সুযোগে হ্যাকাররা টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যায়। সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের সার্ভারের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৪০টি কম্পিউটারের সার্ভার নানাভাবে যুক্ত। তদন্তে ৪০টি কম্পিউটারকেই শনাক্ত করা হয়েছে। শনাক্ত হওয়া কম্পিউটারগুলোকে তদন্তের স্বার্থে একেকটির একেক নম্বর দেয়া হয়েছে। এসব কম্পিউটার থেকে হাজার হাজার ফুটেজ ও ডাটা সংগ্রহ করা হয়েছে। সেসব সংগৃহীত ডাটা পর্যালোচনার কাজ চলছে। শুধু কম্পিউটার নয়, কম্পিউটারগুলোর সঙ্গে যারা যারা যুক্ত তাদের নামীয় তালিকা করা হয়েছে। তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করার কাজ চলছে। পাশাপাশি তাদের ওপর বাড়তি নজরদারি করা হচ্ছে। এমনকি তাদের দেশত্যাগের ওপরও অলিখিত বিধি-নিষেধ জারি করা হয়েছে। শুধু এদের নয়, সংশ্লিষ্ট কাজের সঙ্গে নানাভাবে যুক্তদেরও একটি পৃথক তালিকা করা হয়েছে। সে তালিকাভুক্তদেরও নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অবগত অন্তত ৫০ জনকে কড়া জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাদের চলাফেলার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সীমানা পর্যন্ত বেঁধে দেয়া হয়েছে। তাদের তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত দেশত্যাগ না করতে বলা হয়েছে। বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের উর্ধতন কর্তৃপক্ষকেও অবহিত করা হয়েছে। সূত্র বলছে, সার্ভার রুম এবং এ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও আইটি বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশ ব্যাংকের যেসব জায়গায় যাতায়াত করতেন, সেসব জায়গায় থাকা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। যোগাড় করা হয়েছে শত শত ফুটেজ। সিআইডির অন্তত ২০ জন কর্মকর্তা পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। ভবিষ্যতে এ মামলার তদন্ত করতে আরও প্রযুক্তি বিষয়ে দক্ষ পুলিশ কর্মকর্তাদের সংযুক্ত করার প্রয়োজন হতে পারে। কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে মামলাটির তদন্ত করছে সিআইডি। একটি ভাগ শুধু সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যালোচনা করছে। তারা ফুটেজ দেখে সন্দেহভাজন তালিকাভুক্তদের ফুটেজ আলাদা করছেন। আরেকটি দল শুধু কম্পিউটারের ভিডিওফুটেজ পর্যালোচনা করছেন। তারাও সন্দেহভাজনদের ছবিযুক্ত ফুটেজগুলো আলাদা করছেন। এভাবে বহুভাগে ভাগ হয়ে কাজ চলছে। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা সার্ভারে নানা ফুটেজ পর্যালোচনা এবং সার্ভার রুমে থাকা কম্পিউটারগুলোর ফরেনসিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। এর সঙ্গে পুলিশের ইন্টারপোল সেকশন যুক্ত হচ্ছে। ইতোমধ্যেই হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে টাকা লুটের সঙ্গে জড়িত যেসব অপরাধী শনাক্ত হয়েছে তাদের সম্পর্কে ইন্টারপোলের মাধ্যমে সহায়তা নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ সরকার কূটনৈতিক চ্যানেলে যোগাযোগ শুরু করেছে। সিআইডি সূত্র বলছে, টাকা লুটের সঙ্গে হ্যাকার ছাড়াও অন্তত একাধিক দেশের ব্যাংক, জুয়াড়ি চক্র এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তার জড়িত থাকার সম্ভবনা বেশি। ইতোমধ্যে ফিলিপিন্সের রিজাল ব্যাংকের উর্ধতন কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততার কথা জানিয়ে ব্যাংকটির জুপিটার শাখা ব্যবস্থাপক মায়া দেগুইতো নিজের দোষও স্বীকার করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের দ্য ব্যাংক অব নিউইয়র্ক, সিটি ব্যাংক ও ওয়েলস ফারগো ব্যাংকের মাধ্যমে রিজাল ব্যাংকে এ অর্থ পাঠানো হয়। ইতোমধ্যেই হ্যাকিংয়ের সঙ্গে জড়িত সন্দেহভাজন ছয়জনকে শনাক্ত করেছে ফিলিপিন্সের এ্যান্টি মানি লন্ডারিং কাউন্সিল (এএমএলসি)। শনাক্ত হওয়ারা হচ্ছেন- মাইকেল ফ্রান্সিসকো ক্রুজ, জেসি ক্রিস্টোফার লাগ্রোসাস, আলফ্রেড সান্তোস ভারজারা, এনরিকো তিয়োডোরো ভাসকুয়েজ, উইলিয়াম সো গো ও কাম সিন অং (কিম অং)। এদের মধ্যে লাপাত্তা হয়ে গেছে বাংলাদেশের ৮শ’ কোটি টাকা চুরির সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ী কিম অং। তার আইনজীবীর দাবি, তিনি চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে রয়েছেন। সন্দেহভাজন ছয়জনকে আইনের আওতায় আনতে ইন্টারপোলের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে। তাদের গ্রেফতার করতে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড ওয়ারেন্ট জারির প্রস্তুতি চলছে। এ ব্যাপারে বৃহস্পতিবার যোগাযোগ করা হলে সিআইডির সংঘবদ্ধ অপরাধ বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মীর্জা আবদুল্লাহেল বাকী জনকণ্ঠকে বলেন, ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের টাকা মনিটরিং করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের মনিটরিং রুমে কম্পিউটার রয়েছে। এসব কম্পিউটারের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের যত কম্পিউটার যুক্ত, প্রতিটি কম্পিউটার থেকে প্রয়োজনীয় ডাটাসহ ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। ঘটনা তদন্তে এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকটির বহু কম্পিউটারের সার্ভার থেকে পর্যাপ্ত আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। সংগৃহীত ডাটা ও আলামতের পর্যালোচনা চলছে। এছাড়া অসংখ্য সিসি ক্যামেরা ফুটেজও সংগ্রহ করা হয়েছে। বহুজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তবে তাদের আটক বা গ্রেফতার করা হয়নি। আরও অনেকের বিষয়েই খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। তবে তারা কঠোর গোয়েন্দা নজরদারির মধ্যে রয়েছেন কিনা বা তাদের দেশত্যাগের ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে কি-না, সে সর্ম্পকে সুষ্পষ্ট করে কিছুই জানাননি তিনি। তিনি জানান, সিআইডির কয়েকটি দল বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে একেকটি বিষয় নিয়ে তদন্ত করছে। তালিকাভুক্তরা স্বাভাবিক কারণেই নানা বিধি-নিষেধের মধ্যে রয়েছেন। তবে কী ধরনের বিধি-নিষেধ তা স্পষ্ট করেননি এই তদন্তকারী কর্মকর্তা। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরি ঘটনায় তদন্তকারী সংস্থা সিআইডির সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে সিআইডি অফিসে আসছে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার (এফবিআই) একটি দল। শুক্রবার দুপুরে সিআইডি কার্যালয়ে এফবিআইয়ের দলটি আসছে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন সিআইডির ডিআইজি সাইফুল আলম। তিনি আরও জানান, বিকেল ৪টা থেকে চুরির ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্তের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন সিআইডির ৮ সদস্যের একটি দল। ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক হয়। সিআইডি কর্মকর্তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের নেটওয়ার্কিং ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করেছেন। তারা বুঝতে চেষ্টা করেছেন অর্থ চুরির ঘটনায় নেটওয়ার্কিংয়ের কোন দুর্বলতা রয়েছে কি-না।
×