ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

হিযবুত তাওহীদের ১১০ জন কারাগারে প্রেরণ, ৩ জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন

নোয়াখালীর গ্রামে সংঘর্ষে জামায়াত-হেফাজতের ইন্ধনের অভিযোগ

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ১৬ মার্চ ২০১৬

নোয়াখালীর গ্রামে সংঘর্ষে জামায়াত-হেফাজতের ইন্ধনের অভিযোগ

নিজস্ব সংবাদদাতা, নোয়াখালী, ১৫ মার্চ ॥ নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীর চাষিরহাট ইউনিয়নের পোরকরা গ্রামে হিযবুত তাওহীদ ও গ্রামবাসীর মধ্যে সংঘর্ষের পর থকে মানুষের মধ্যে এখন চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছে। পুরো গ্রাম যেন নিস্তব্ধ-নীরব। আবার পড়ে থাকা ধ্বংসস্তূপ মনে করিয়ে দেয় সোমবার সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত এ গ্রামে কি হয়েছিল? হামলা, সংঘর্ষ, ভাংচুর আর অগ্নিকা-ের সাক্ষীস্বরূপ পড়ে আছে পুড়ে যাওয়া ঘরের ছাই, মোটরসাইকেলর অবশিষ্টাংশ আর বসতঘর, দোকানপাট ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভাংচুরের চিহ্ন। কোথাও কোথাও ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা যায় চাষিরহাট ইউনিয়নের পোরকরাসহ পাশের গ্রামীণ সীমানাজুড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দিয়েছে। জেলার পুলিশের সঙ্গে নিরাপত্তা প্রাচীর গড়তে এখানে রয়েছে লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, ফেনী, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানের পুলিশ। টহলে আছে র‌্যাব ও বিজিবি সদস্যরা। অপরদিকে হিযবুত তাওহীদের নারী ও পুরুষ মিলিয়ে ১১৩ জনকে ৫৪ ধারায় আটক দেখিয়ে মঙ্গলবার আদালতে ১১০ জনকে সোপর্দ করার পর কারাগারে পাঠানো হয়েছে। অপর তিনজনকে গুরুতর আহত অবস্থায় পুলিশ পাহারায় নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে পুলিশী কাজে বাধা ও হামলা, ভাংচুর এবং হত্যা মামলায় আরও মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে পুলিশ। ঘটনার সূত্রপাত ও হিযবুত তাওহীদের বক্তব্য ॥ সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০৯ সালে সোনাইমুড়ীর চাষিরহাট ইউনিয়নে হিযবুত তাওহীদের অনুসারীদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ এনে নূরুল হক মেম্বারের বাড়িসহ কয়েকটি বসত ঘরে হামলা ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। ওই সময় হিযবুত তাওহীদ অনুসারী ও গ্রামবাসী থানায় পাল্টাপাল্টি মামলা করে। ওই সময় পুলিশ হিযবুত তাওহীদের কয়েকজনকে গ্রেফতার করে এবং গ্রামবাসীর নিয়মিত বাধার মুখে হিযবুত তাওহীদের অনুসারীরা গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে তাদের বাড়িঘর। পরে তারা কেউ জজকোর্ট ও কেউ হাইকোর্ট থেকে গত কয়েক মাস পূর্বে জামিনে এসে পুনরায় বসতি স্থাপন করে এবং এলাকায় তাদের ধর্মীয় মতবাদ প্রচার শুরু করে। একই সঙ্গে হিযবুত তাওহীদের বর্জ্যশক্তি ও দেশের পত্র নামে দুটি পত্রিকা প্রকাশ করে। নিজেদের এ প্রকাশনার মাধ্যমেও তারা তাদের মতবাদ প্রকাশ করতে থাকে। সম্প্রতি তারা নিজেদের বাড়ি এলাকায় একটি মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। ইতোমধ্যে মাটি ফেলে ও মসজিদের ভবন নির্মাণ করার চেষ্টা করলে পুনরায় গ্রামবাসী বাধা দেয়। সর্বশেষ গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ওই এলাকায় একটি সমাবেশ করে হিযবুত তাওহীদ। সমাবেশে তারা যে কোন মূল্যে এখানে মসজিদ নির্মাণের ঘোষণা দেন। একই সঙ্গে বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসার হুজুর ও মাওলানাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন উস্কানিমূলক মন্তব্য করেন। একই সঙ্গে ইসলাম ও মহানবীকে (স.) জড়িয়ে বিভিন্ন অপপ্রচার চালিয়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে। এতে স্থানীয় ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। আহত হিযবুত তাওহীদের কয়েক সদস্য দাবি করেন, পোরকরা গ্রামের একটি কওমী মাদ্রাসা ও তৎসংলগ্ন মসজিদের হুজুররা হিযবুত তাওহীদের অনুসারীরা ইসলাম, আল্লাহ্ ও মহানবী (স.) বিরোধী এবং তারা খ্রীস্টান বলে গুজব ছড়ায়। একই সঙ্গে হিযবুত তওহীদের লোকজন এখানে থাকলে পুরো গ্রামের মানুষদেরকে খ্রীস্টানে পরিণত করবে বলেও অপপ্রচার চালায়। এক পর্যায়ে মাদ্রাসা ও মসজিদের হুজুররা স্থানীয় জামায়াত ও হেফাজতকে সঙ্গে নিয়ে এলাকার সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষকে মিথ্যা অপপ্রচারে ভ্রান্ত করে এবং ভুল বুঝিয়ে হিযবুত তাওহীদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলে। সোমবার হিযবুত তাওহীদের অনুসারীরা তাদের এলাকায় একটি মসজিদ নির্মাণের কাজ শুরু করে। এ সময় তাদের বিভিন্ন স্থানের অনুসারীরা স্বেচ্ছাশ্রমের বিনিময়ে মসজিদ নির্মাণ কাজ করতে আসে। তারা বলেন, সম্প্রতি মসজিদ নির্মাণ করতে গেলে স্থানীয় কিছু স্বার্থান্বেষী লোক মসজিদ নির্মাণে বাধা দেয়। ফলে কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতাদের নির্দেশে গত কিছুদিন থেকে বিভিন্ন স্থানের সংগঠনের অনুসারীরা দলবদ্ধ হয়ে এখানে মসজিদ নির্মাণে কাজ করছে। আর এ সুযোগে মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়ে জামায়াত-হেফাজতের লোকজন সাধারণ মানুষকে ভুল বুঝিয়েছে। তারা গ্রামবাসীকে বুঝিয়েছে হিযবুত তাওহীদ ইসলাম বিরোধী, তারা এখানে ইসলামবিরোধী কর্মকান্ড করতে মসজিদের নামে আস্তানা গাড়ছে। এসব বলে গ্রামবাসীকে ক্ষেপিয়ে তুলেছে। তাছাড়া সোমবারের ঘটনায় গ্রামবাসীর ওপর হিযবুত তাওহীদের কোন অনুসারী হামলা চালায়নি। মিছিল নিয়ে কথিত গ্রামবাসী হিযবুত তাওহীদের অনুসারীরা যখন মসজিদ নির্মাণের কাজ করছে তখন কিছু বুঝে ওঠার আগেই অতর্কিতে তাদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। এদিকে সোনাইমুড়ীতে হামলা এবং হত্যাকা-ের জন্য জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলামী জড়িত দাবি করে সোমবার রাতেই হিযবুত তাওহীদের আমির মসিহ্ উর রহমান স্বাক্ষরিত বিবৃতি দেয়া হয়। দুই কর্মী নিহতের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও সংগঠনটির দাবি এই হামলায় তাদের ১০ জন কর্মী মারা গেছে। আগেই প্রশাসনকে জানানো হলেও ঘটনার সময় প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ এনেছে হিযবুত তাওহিদ। পরিস্থিতি শান্ত ॥ বর্তমানে এলাকার পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে পরবর্তী যে কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। এ ছাড়া র‌্যাব ও বিজিবি টহলে রয়েছে। এ দিকে মঙ্গলবার দুপুরে সংঘর্ষের ঘটনার খোঁজখবর ও বর্তমান পরিস্থিতি জানতে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন নোয়াখালী-২ (সোনাইমুড়ী-চাটখিল) আসনের সংসদ সদস্য এইচএম ইব্রাহিম। এ সময় তিনি চাষিরহাট ইউপি পরিষদের সামনে এক মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মমিনুল ইসলাম বাকেরের সভাপতিত্বে উপস্থিত ছিলেন সোনাইমুড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ড. রহিমা খাতুন, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আনোয়ারুল হক কামাল, সাবেক চেয়ারম্যান আ. ফ. ম. বাবুল সোনাইমুড়ী পৌর মোতাহের হোসেন মানিক প্রমুখ। সভায় সংসদ সদস্য বলেন, আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া যাবে না। রাস্তাঘাট বন্ধ করে পুলিশী কাজে বাধা দেয়া উচিত নয়। কারণে-অকারণে শান্তি নষ্ট করা যাবে না। যদি কোন ব্যক্তি বা সংগঠন ইসলাম ও মহানবীর বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করে বা উস্কানিমূলক প্রচার চালিয়ে থাকে তাদের বিরুদ্ধে বিদ্যমান আইনে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি এলাকাবাসীকে শান্ত ও আইনশৃঙ্খল বাহিনীকে সহযোগিতা করার আহ্বান জানান।
×