ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

তদন্ত কমিটি

রাষ্ট্রপতির দেয়া নিয়োগ নিয়ে জালিয়াতি শান্ত-মারিয়ামের

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ২৫ জানুয়ারি ২০১৬

রাষ্ট্রপতির দেয়া নিয়োগ নিয়ে জালিয়াতি শান্ত-মারিয়ামের

বিভাষ বাড়ৈ ॥ রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের নিয়োগপ্রাপ্ত অধ্যাপককে নিয়োগ না দিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে গোপনে অন্য একজনকে উপাচার্য বানিয়ে অবৈধ কর্মকা- চালানোর অভিযোগ উঠেছে এক বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে। রাজধানীর উত্তরায় অবস্থিত শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি নামের এ প্রতিষ্ঠানটিকে ঘিরে চলা গুরুতর এ অভিযোগের ঘটনানকে ‘রহস্যজনক’ ও ‘রাষ্ট্রের সঙ্গে তামাশা’ হিসেবে অভিহিত করছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। রাষ্ট্রপতি ও আচার্য নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েও উপাচার্য হিসেবে যোগদানে বাধার মুখে পড়া অধ্যাপকের আবেদনের প্রেক্ষিতে দুই সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে ইউজিসি। ইউজিসি’র কর্মকর্তারা শান্তা-মারিয়াম ইউনিভার্সিটির ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলছেন, দেশের বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম দুর্নীতির বহু অভিযোগ আছে। তবে রাষ্ট্রপতির নিয়োগ দেয়া উপাচার্যকে যোগদানে বাধা দেয়া বা অন্য কোন অবৈধ পন্থা অবলম্বনের ঘটনা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এটাই প্রথম। প্রগতিশীল শিক্ষক চারুকলার ইনস্টিটিউটের প্রবীণ শিক্ষক অধ্যাপক ড. মিজানুর রহীমের লিখিত আবেদনে তোলপাড় শুরু হওয়ার প্রেক্ষাপটে আটঘাট বেঁধে নেমেছেন ইউজিসির কর্মকর্তারা। শান্তা-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজির মূল ক্যাম্পাস উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের ১৪ নম্বর রোডে। ২০০৩ সালে যাত্রা শুরু হওয়া এ বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়টির বিরুদ্ধে অবশ্য বিএড ও দূরশিক্ষণ কার্যক্রম চালানো নিয়ে বেশ কিছুদিন অভিযোগ ছিল। অনুমোদন ছাড়া এ শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর বিষয়ে সরকারী তদন্তও হয়। এক পর্যায়ে সে কার্যক্রম বন্ধ রাখে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে অন্যান্য কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে এটির বিরুদ্ধেও নানা কৌশলে অনুমোদানহীন আউটার ক্যাম্পাস পরিচালনার অভিযোগ আছে। শিক্ষার্থীদের এসব ক্যাম্পাসে ভর্তি না হতে ইউজিসি গণবিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করেছিল। তবে এসব অভিযোগ নিয়ে যখন সমালোচনা হচ্ছে তখন শিক্ষা প্রশাসনে তোলপাড় শুরু হয়েছে রাষ্ট্রপতির মনোনীত উপাচার্যকে যোগদানে বাধা দেয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে। ইউজিসি ও শান্তা-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি সূত্রে জানা গেছে, এখানে দীর্ঘদিন ফ্যাকাল্টি অব ফাইন এ্যান্ড পারফর্মিং আটর্স-এ ডিন হিসেবে ছিলেন অধ্যাপক মিজানুর রহীম। এখানে যোগদানের আগে তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যপক। জনপ্রিয় এ শিক্ষক প্রায় তিন বছর শান্তা-মারিয়াম ইউনিভার্সিটির ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর গেল বছর শেষের দিকে ট্রাস্টি বোর্ড তাকে উপাচার্য হিসেবে মনোনয়ন দেয়ার জন্য বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনুসারে আচার্য্য ও রাষ্ট্রপতির কাছে নাম পাঠায়। বিধান অনুমারে আরও দুজন অধ্যাপকের নামও পাঠায় কর্তৃপক্ষ। এরপর অধ্যাদেশ অনুসারে তিনজনের মধ্য থেকে অধ্যাপক মিজানুর রহীমকে মনোনয়ন দেন রাষ্ট্রপতি। তবে এরপরই ট্রাস্টি বোর্ড জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে হঠাৎই তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতির কাছে মিথ্যা তথ্য দেয়ার অভিযোগ আনে। হঠাৎ উদ্ভট সব অভিযোগ এনে উপাচার্য হিসেবে যোগদানে বাধা দেয়া হয়। অথচ রাষ্ট্রপতির কাছে সকল তথ্য বিধান অনুসারে কর্তৃপক্ষই পাঠিয়ে থাকে। যেখানে ট্রাস্টি বোর্ড সদস্যরাই একমাত্র ক্ষমতাপ্রাপ্ত। তবে অভিযোগ তোলার পরপরই ওই শিক্ষকের সঙ্গে অন্যান্য অনেক শিক্ষকই বিষয়টি নিয়ে কর্তৃপক্ষকে দায়ী করেন। তারা প্রমাণ তুলে ধরেন রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো অফিসেই পরিকল্পিভাবে কাগজপত্র জালিয়াতি করা হয়েছে। ভেতরের একটি চক্র এ কাজ করেছে কারণ ওই শিক্ষক কোন তথ্য মিথ্যা দেননি। এ অবস্থায় প্রবীণ এ শিক্ষককে রাষ্ট্রপতির আদেশ মেনে যোগদানের পক্ষে অবস্থান নেন অনেক শিক্ষক। এ অবস্থ্য়া ইউজিসির সহায়তা কামনা করে চিঠি দেন ক্ষতিগ্রস্ত অধ্যাপক। তিনি অবিলম্বে ঘটনার বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি তোলেন। বিষয়টি বুঝতে পেরে রাতারাতি অন্য একজনকে উপাচার্য বানাতে কাজ শুরু করে ট্রাস্টি বোর্ডের একটি পক্ষ। এ লক্ষ্যে আগের মনোনয়নের তথ্য লুুকিয়ে কাজী মুফিজুর রহমানকে নিয়োগের জন্য আবার রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠায় কর্তৃপক্ষ। এদিকে রাষ্ট্রপতি যেখানে একজনকে উপাচার্য নিয়োগ দিয়েছেন সেখানে আরেকজনকে নিয়োগ দানের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ব্যবস্থা নিতে তদন্ত কমিটি গঠন করে ইউজিসি। যার প্রধান হলেন ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ইউসুফ আলী মোল্লা। অপর সদস্য হচ্ছে ইউজিসির উপ-পরিচালক (প্রশাসন) ড. ফখরুল ইসলাম। ইতোমধ্যেই তদন্তের প্রাথমিক কাজ শেষ করেছে কমিটি। কর্মকর্তারা বলেছেন, তদন্তের ঘটনাস্থলে যাওয়ার আগেই যে কাগজপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে তাতেই প্রমাণ মেলে রাষ্ট্রপতির আদেশ লঙ্ঘন ও জালিয়াতির বিষয়টি। রাষ্ট্রপতি মনোনীত ব্যক্তিকে নিয়োগে বাধা দিতেই তার কম্পিউটারে কর্তৃপক্ষ তথ্য নষ্ট করেছে। এগুলো করেছে তাকে ফাঁসানোর জন্য। তবে কোন অনিয়ম করেই পার পাওয়া যাবে না বলে বলছেন ইউজিসি কর্মকর্তারা। ইউজিসির পরিচালক (বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়) ড. মো: খালেদ জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, আমরা তদন্ত কমিটি করেছি। কমিটি কাজ করছে। রিপোর্ট পেলেই ব্যবস্থা নেয়া হবে। এদিকে রাতারাতি অধ্যাদেশ অমান্য করে অন্য একজনকে উপাচার্য বানিয়ে পুরো ঘটনাকে ‘সেটেল ম্যাটার’ বলে দাবি করছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান মোঃ ইমামুল কবীর শান্তর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলার চেষ্টা করলে তিনি অপর দুই কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেন এ সাংবাদিকের সঙ্গে যোগাযেগ করতে। এরপর দু’কর্মকর্তা যোগাযোগ করে বলেন, ‘যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। ওটা এখন সেটেল ম্যাটার।’ কিভাবে সেটেল? এ প্রশ্নে তারা বলেন, ‘আমরা আরেকজনকে নিয়োগ দিয়েছি, তাই সেটেল।’ তবে এ ধরনের কর্মকা- চালানোর কোন সুযোগ নেই বলে জানিয়ে দিয়েছেন ইউজিসির তদন্ত কমিটির সদস্য অতিরিক্ত-পরিচালক (প্রশাসন) ড. ফখরুল ইসলাম। তিনি বলেন, তামাশা নাকি যা ইচ্ছে তাই করবে? এটা তো রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তামাশা করা। দেশে আইন আছে। রাষ্ট্রপতিকে আগের নিয়োগের তথ্য না দিয়ে আবার রাতারাতি নিয়োগ সম্পর্কে ইউজিসির কর্মকর্তারা বলেন, নিয়োগ দিলেই হবে? কোন সুযোগ নেই। রাষ্ট্রপতি যাকে মনোনয়ন দিয়েছেন নেই নিয়োগ পেতে বাধ্য। আর এটা তো পরিষ্কার যে, কর্তৃপক্ষই ওই শিক্ষকের কাগজপত্র জালিয়াতি করেছে। শিক্ষক তো কিছু করেননি। জানা গেছে, এখানেই শেষ নয়। এর আগেও ১২টি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮৯ শাখায় ভর্তিতে সাবধান করে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল ইজিসি। সেখানেও আছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন শাখার নাম। ইউজিসি বলছে, আদালতের স্থগিতাদেশ, ইউজিসির তালিকার বাইরে অননুমোদিত ক্যাম্পাস পরিচালনা, সরকার বন্ধ করে দেয়ার পরও আদালতে স্থগিতাদেশ নিয়ে ক্যাম্পাস পরিচালনা, ট্রাস্ট্রি বোর্ডের দ্বন্দ্ব, নানা অনিয়মের কারণে আদালতে মামলা চলছে ইত্যাদি কারণে এ নির্দেশে দেয়া হলো। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরেজমিন পরিদর্শন করেছিল। দুদকের অভিযানের প্রথম পর্যায়ে ৪০টি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে পরিচালনার নীতিমালা অনুসরণ না করাসহ বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য উঠে আসে। সে অনুযায়ী এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন বাতিলের সুপারিশ করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকেও চিঠি দিয়েছিল দুদক। এসব প্রতিষ্ঠানের তালিকায়ও আছে শান্তা-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি নাম।
×