ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ছাত্রকে মিথ্যা অপবাদে নির্যাতন ॥ পরিবার একঘরে

প্রকাশিত: ০৪:১৩, ১১ জানুয়ারি ২০১৬

ছাত্রকে মিথ্যা অপবাদে নির্যাতন ॥ পরিবার একঘরে

নিজস্ব সংবাদদাতা, কলাপাড়া, ১০ জানুয়ারি ॥ উপজেলার লতাচাপলী ইউনিয়নের মিশ্রিপাড়া ফাতেমা হাই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্র স্বপন চৌধুরী ও তার বড় ভাই সুমন চৌধুরীকে চুরির অভিযোগে বেধড়ক পেটানো হয়েছে। তুলাতলী গ্রামে প্রকাশ্যে সালিশ বৈঠক বসিয়ে তাদের মারধর করা হয়। শুক্রবার সকাল ১০টায় শত শত মানুষের সামনে এমন কা- করা হয়েছে। ২৫ হাজার টাকা জরিমানা ধার্য করা হয়েছে। এ নিয়ে এলাকায় তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। নির্যাতিত স্কুলছাত্র স্বপন ও তার ভাই এ ঘটনায় বিমর্ষ হয়ে পড়েছে। একে তো মিথ্যা চুরির অপবাদ। তারপরে প্রকাশ্যে মারধর ও জরিমানা। তুলাতলী গ্রামের স্বপন ডাক্তার, হাচন আলী মৃধা, মিশ্রিপাড়ার ফারুক ভুইয়া, জলিল প্যাদা এ সালিশ করেন। এ সালিশদাররাই স্বপনকে পেটায়। আর জরিমানার ২৫ হাজার দেয়ার জন্য ১৭ দিন সময় বেঁধে দিয়েছে। চরম আর্থিক দৈন্য ও লোকলজ্জায় আহত স্বপন ঘরে বসেই ট্যাবলেট খাচ্ছে। সঠিক চিকিৎসা পর্যন্ত করাতে পারছে না। জানা গেছে, বৃহস্পতিবার গভীর রাতে তুলাতলী গ্রামের নেপাল শাখারী, নিখিল শাখারী, পাচশনাথ চৌধুরী, শশধর চন্দ্র চৌধুরীর বাড়িতে চুরি হয়। সিঁদ কেটে চোর ঘরে ঢুকলে তারা টের পেলে চোর পালিয়ে যায়। ঘটনার পরপরই কোন প্রমাণ ছাড়াই আশপাশের ২৫-৩০ লোকজন মিলে রাত আড়াইটার দিকে স্বপনের বাড়িতে যায়। স্বপন চুরি করে পালিয়ে এসেছে তার বাবা-মাকে হুমকি দিয়ে চলে আসে। এরপর শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে সালিশ বৈঠকে বসতে বাধ্য করা হয়। ওই সালিশ-বৈঠকে শিক্ষার্থী স্বপনকে দোষী সাব্যস্ত করে তার পায়ের তলায় ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে বেধড়ক পেটানো হয়। করা হয় ২৫ হাজার টাকা জরিমানা। আর্থিক সংকটের কারণে চিকিৎসা করাতে পারছে না পরিবারটি। এ সময় স্বপনের মেঝো ভাই সুমন চৌধুরীকেও মারধর করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে পরিবারটি। এ ব্যাপারে শশধর চন্দ্র চৌধুরী দাবি করেন, স্বপন সিঁদ কেটে ঘরে প্রবেশ করে এ সময় তার বৃদ্ধা মা টের পেয়ে সৌরবিদ্যুতের বাতি জ্বালায়। চোর আত্মরক্ষার জন্য চৌকির নিচে পালায়। তখন জামার কলার ধরে বের করেন। ঘরের দরজা খুলে বাইরে নামার সময় স্বপন শশধরকে ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু শশধর চৌধুরীর স্ত্রী শম্পা রানী চৌধুরী জানান, তার স্বামী চোরকে ধরলে সে পালানোর চেষ্টা করে। পালাতে ব্যর্থ হয়ে দু’পা জড়িয়ে ধরলে ছেড়ে দেয়া হয়। তবে অভিযুক্ত স্বপন দাবি করে, এ সময় সে বাড়িতে ঘুমিয়ে ছিল। লোকজনের ডাকে ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলে বাড়ির উঠানে অনেক লোকজন দেখতে পায়। তখন সে জানতে পারে চুরির কথা। স্বপনের বাবা খিতিশ চন্দ্র চৌধুরী বলেন, প্রায় দুই বছর আগে তার বড় মেয়ে স্থানীয় মুসলমান দুই সন্তানের জনক মজিবর হাওলাদারের সঙ্গে প্রেমের টানে পালিয়ে বিয়ে করেছে। ওই ঘটনার পরপরই হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন তাকে সমাজচ্যুত করেছে। এরপরও এলাকা থেকে বিতাড়িত করতে তার পরিবারের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে থাকে হিন্দু সমাজপতিরা। এরই ধারাবাহিকতায় তার স্কুল পড়ুয়া মেধাবী ছেলেকে চোর সাব্যস্ত করে পিটানো হয়েছে। স্বপনের মা কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, মেয়ের ঘটনার রেশ ধরে একঘরে করে রাখা হয়েছে আমাদের। কাজকর্ম করতে পারছেন না তারা। বর্তমানে আর্থিক সঙ্কটে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। হিন্দু সম্প্রদায়সহ সমাজের কেউ তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসছে না। সালিশদার ফারুক ভূইয়া জানান, ঘটনার বিবরণে স্বপনই চুরি করেছে এমনটাই মনে হয়েছে। সালিশ বৈঠকে তিনি উপস্থিত থাকার কথা স্বীকার করলেও নিজ হাতে স্বপনকে মারধর করেননি। স্বপন ডাক্তার ও হাচন আলী মৃধা মারধর করেছেন এবং ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন। ফারুক আরও বলেন, ‘আমি না থামালে আরও বেশি মারধর করা হতো।’ মিশ্রিপাড়া জামে মসজিদ কমিটির সভাপতি ও স্থানীয় সমাজসেবক ইব্রাহীম বেপারী জানান, ১৫ বছরের স্কুল পড়ুয়া কিশোর একাই এক রাতে চার বাড়ি চুরি করেছে এটা অবিশ^াস্য। আবার রাতে চোর হাতেনাতে ধরে ছেড়ে দিলে আবার সকালে বিচার হলো কিভাবে। তিনি আরও বলেন, দরিদ্র স্বপনের পরিবার আমার বাড়িতে ২০ বছর বসবাস করেছে। বহুদিন না খেয়ে থাকলেও কারও ক্ষতি করতে দেখিনি। একই কথা জানালেন স্থানীয় সুলতান ব্যাপারী। তার মতে ওই রাতে চুরি হলেও স্বপনকে মিথ্যা অপবাদ দেয়া হয়েছে। তিনি দাবি করেন, খিতিশ চৌধুরীর মেয়েটি পালিয়ে যাবার পর থেকে স্থানীয় হিন্দুরা পরিবারটির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গোলাম মোস্তফা জানান, কিশোর বয়সের ওই ছাত্র এ কাজ করতে পারে বলে তিনি বিশ^াস করেন না।
×