ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অনন্য সাধারণ চার্চিল

প্রকাশিত: ০৪:২৫, ১ ডিসেম্বর ২০১৫

অনন্য সাধারণ চার্চিল

ব্রিটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের জীবন ছিল বিচিত্র অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে অনেক সময় তিনি বড় ধরনের বাজি ধরতেন। বাজিতে অনেক সময় জিততেন আবার হেরেও যেতেন। যেমন প্রথম মহাযুদ্ধে তিনি ছিলেন ফার্স্ট লর্ড অব এডমিরালটি। অর্থাৎ ব্রিটিশ নৌবাহিনীর শীর্ষ সারির অফিসার। এই দায়িত্বে থাকাকালে তিনি তুরস্ককে যুদ্ধ থেকে ছিটকে ফেলার লক্ষ্যে দার্দানেলস অভিযানের পরিকল্পনা করেছিলেন। যার উদ্দেশ্য ছিল গ্যালিপলি প্রণালী দখল করে নেয়া। ব্রিটিশ নৌবাহিনীর সেই আক্রমণাভিযান সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিল। চার্চিলের এই উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার চরম মাসুল দিতে হয়েছিল ব্রিটেনকে। আবার হাইস্টেক জুয়ায় তিনি যে জেতেননি তাও নয়। যেমন ১৯৪০ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি নাৎসি জার্মানিকে প্রতিরোধ দিয়ে গিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত আমেরিকা ব্রিটেনকে উদ্ধারে এগিয়ে আসে। তার এই প্রতিরোধ যুদ্ধের সিদ্ধান্ত অতিমাত্রায় সঠিক ছিল। তবে জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও চার্চিল যে একজন তুখোড় জুয়াড়ির মতো আচরণ করে গেছেন তা অনেক জীবনীকারের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। সম্প্রতি নতুন দুটি গ্রন্থে তাঁর এ জাতীয় কিছু ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। একটি গ্রন্থের নাম! ‘নো মোর শ্যাম্পেন।’ লিখেছেন ডেভিড লাফ। জীবনের উত্থান পতনের অধ্যায়গুলোতে চার্চিলের আর্থিক অবস্থা কেমন ছিল তারই এক বিবরণ। এই প্রথম চার্চিলের কোন জীবনীতে তাঁর এই দিকটির ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। লেখক চার্চিলের ব্যক্তিগত ব্যাংক এ্যাকাউন্টগুলো খতিয়ে দেখেছেন। তিনি লক্ষ্য করেছেন যে, এডমিরাল অথবা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি যেমন ঝুঁকি নিতেন তেমনি ব্যক্তিগত টাকা পয়সা খরচের ব্যাপার এলেও সে ধরনের ঝুঁকি নিতে অভ্যস্ত ছিলেন। চার্চিল মার্লবরোর ডিউক পরিবারের সন্তান হলেও তার বাবা-মার অর্থসম্পদ বলতে তেমন কিছু ছিল না। তথাপি বিলাসবৈভবের জীবনযাপন থেকে তারা পিছপা হননি। তরুণ চার্চিলও পোলো খেলা থেকে শুরু করে হাভানা চুরুট টানা পর্যন্ত সবকিছুর পেছনে দেদার টাকা পয়সা উড়াতেন। কিউবায় সমর সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করার সময় তিনি এই চুরুট খাওয়ার অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। ১৯০৮ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত চার্চিল পরিবার প্রতিবছর শুধু মদের পিছনেই গড়ে ১১৬০ পাউন্ড উড়াতেন যা আজকের হিসাবে ১ লাখ ৪৪০০ পাউন্ড বা ১ লাখ ৪৫ হাজার ডলার। কাজেই অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, জীবনের বেশিরভাগ সময়ই চার্চিল এক আর্থিক সঙ্কট থেকে আরেক আর্থিক সঙ্কটের মধ্য দিয়ে গেছেন। পাওনাদারের পয়সা মেটাতে গিয়ে সর্বদাই তিনি পিছিয়ে পড়ে থাকতেন। আরেকটা বই আছে মার্কিন সাংবাদিক সাইমন রিডের লেখা ‘উইনস্টন চার্চিল রিপোর্টং’। সেখানে চার্চিল তার কিছু কিছু দেনা শেষ পর্যন্ত কিভাবে পরিশোধ করেছিলেন তার বিবরণ আছে। রিড এই বইতে তথ্যানুসন্ধান করে দেখিয়েছেন কিভাবে চার্চিল এক তরুণ সেনা অফিসার ক্যাডেট থেকে যাত্রা শুরু করে ২৫ বছর বয়সের মধ্যে ব্রিটেনের সর্বোচ্চ পারিশ্রমিকের সমর সংবাদদাতায় পরিণত হয়েছিলেন। চার্চিল এমন স্বনামধন্য হয়ে উঠেছিলেন যে, তার পরিচয় পেলেই সারা দুনিয়ার সংবাদপত্রের সম্পাদকরা তাকে স্বাগত জানাতে কার্পণ্য করতেন না। তবে বিশ্বের যে কোন স্থানের রণাঙ্গনে এই তরুণ রিপোর্টার এমন পরিসরে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতেন যার জন্য তাঁর কলাম সমসাময়িক অন্যান্য রিপোর্টারের কলাম থেকে স্বতন্ত্র একটা ব্যঞ্জনা লাভ করেছিল। স্পেনের বিরুদ্ধে কিউবার স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে চার্চিল ১৮৯৫ সালে সেদেশে যান। তখন তিনি ‘ডেইলি গ্রাফিক’-এর পক্ষে লিখতেন। এ সময় তিনি কিউবার কয়েকটি অতি বিপজ্জনক ও বিপদসঙ্কুল এলাকা অনেক ঝুঁকি নিয়ে পাড়ি দিয়েছিলেন। তার জন্য এতটুকু বিচলিত হননি। পরের বছর তাঁর রেজিমেন্টকে ভারতে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে তিনি আফগানিস্তান সীমান্তে পশতু উপজাতীয়দের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন এবং রক্তাক্ত রণাঙ্গন থেকে ডেইলি টেলিগ্রাফের জন্য নিবন্ধ লিখে পাঠাতেন। এরপর তাঁকে সুদানে পাঠান হয়। সেখানে তিনি ১৮৯৮ সালে ওমদুরমানের যুদ্ধে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী শেষ বড় ধরনের ক্যাভালরি আক্রমণে অংশ নেন। ওল্ডহামে উপনির্বাচনে সামান্য ব্যবধানে হেরে যাওয়ার পর তিনি সাংবাদিকতা পেশায় ফিরে যান এবং ১৮৯৯-১৯০২ সালের দ্বিতীয় বুয়ার যুদ্ধের সময় তিনি মর্নিং পোস্টের পক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকায় সমর সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করতে থাকেন। সেখানে একবার তিনি নিজেই প্রথম পৃষ্ঠার সংবাদে পরিণত হন। তিনি একটি উদ্ধারকারী দলের সঙ্গে সাঁজোয়া ট্রেনে করে যাওয়ার সময় বুয়ারদের হাতে বন্দী হন। কিন্তু চার্চিল তো আর ক্ষান্ত থাকার বান্দা নন। তিনি অচিরেই যুদ্ধবন্দী শিবির থেকে পালিয়ে যান এবং প্রায় ৩শ’ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে পর্তুগীজ শাসিত ইস্ট আফ্রিকায় চলে যান। আফ্রিকা থেকে দেশে ফিরে আসার সময় লেখালেখি থেকে চার্চিলের সঞ্চয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ৪ হাজার পাউন্ডেরও বেশি যা আজকের হিসাবে ৪ লাখ পাউন্ড। চার্চিল তার ভাইকে বললেন, বিচক্ষণতার সঙ্গে এই অর্থ খরচ করলে জীবনের দুঃসময়টা কাটিয়ে দিতে পারবে বলে আশা রাখি। কিন্তু হিসাব করে চলা তো চার্চিলের ধাতে ছিল না। তিনি আগের বেহিসাবী অভ্যাসে ফিরে গেলেন। অমিতব্যয়ের উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল মন্টিকার্লোতে জুয়ায় শোচনীয়ভাবে হেরে যাওয়া। তাছাড়া তিনি যখন বাজি ধরে বলেছিলেন যে, শেয়ারের দাম বাড়তে থাকবে তার পরপরই ওয়াল স্ট্রিটে ধস নামে। চার্চিল যে এ্যাডভেঞ্চারের জন্য কিংবা মজা পাওয়ার জন্য লিখে চলেছিলেন তা নয়, তিনি তার জীবিকা নির্বাহের জন্য লিখতেন। কিন্তু যা পেতেন সেটা প্রয়োজন মেটানোর জন্য যথেষ্ট ছিল না। দেউলিয়া হওয়ার হাত থেকে উদ্ধার পেতে ১৯৩৮, ১৯৪০ ও ১৯৪৬ সালে তাকে ধনাঢ্য বন্ধুদের সাহায্য নিতে হয়েছিল। আর্থিক জীবনের এই টানাপোড়েন ও মন্দাই হয়ত তাঁকে ঝুঁকি নেয়ার ও বড় ধরনের বাজি ধরার পিছনে তাড়না হিসেবে কাজ করেছিল। (সূত্র : দি ইকোনমিস্ট)
×