ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঈদে বাড়ি ফেরা ॥ পথে পথে ভোগান্তি

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৫

ঈদে বাড়ি ফেরা ॥ পথে পথে ভোগান্তি

রাজন ভট্টাচার্য ॥ মহাখালী থেকে জয়দেবপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত যেতে সময় লাগছে চার ঘণ্টারও বেশি। এরপর ময়মনসিংহ যেতে সময় লাগছে সর্বোচ্চ দুই ঘণ্টা। বগুড়া, দিনাজপুর, রংপুরসহ উত্তরবঙ্গের অন্তত ২১ জেলায় সড়ক পথের যাত্রীদের ভোগান্তির শেষ নেই। ছয় থেকে সাত ঘণ্টার রাস্তা যেতে সময় লাগছে প্রায় ১৭ ঘণ্টা। বলতে গেলে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক যানজটে কার্যত অচল। অন্যদিকে কমলাপুর থেকে ঈদ উপলক্ষে বিশেষ ট্রেনের যাত্রা শুরুতেই সিডিউল বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। বেশকিছু লঞ্চ নির্দিষ্ট সময়ের দেড় থেকে তিন ঘণ্টা পর সদরঘাট ছেড়েছে। থেমে থেমে বৃষ্টি তো আছেই। সেই সঙ্গে অতিবর্ষণে মহাসড়কের রাস্তা ভেঙেছে। রাজধানীতে গণপরিবহন সঙ্কটও চরমে। সব মিলিয়ে ভোগান্তির ঈদযাত্রায় ঘরমুখো মানুষ। এদিকে মহাসড়কে হাইওয়ে পুলিশসহ পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন না থাকার অভিযোগ করেছেন পরিবহন সংশ্লিষ্টরা। সড়ক, নৌপথে তিনগুণ ভাড়া আদায়ের অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। যানজট এড়াতে সরকারের পক্ষ থেকে মঙ্গলবার থেকে মহাসড়কে ট্যাঙ্কলরি চলাচল বন্ধের ঘোষণা দেয়া হলেও পরিবহন মালিক সমিতির কর্তাব্যক্তিরা এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না। তারা বলছেন, অন্যান্য ঈদেও ট্যাঙ্কলরি সড়ক-মহাসড়কে চলাচল করেছে। এবারের ঈদেও এর ব্যতিক্রম হবে না। তাছাড়া সড়ক পরিবহন মন্ত্রীর পক্ষ থেকে ঈদের আগে ও পরে তিন দিন করে এসব পরিবহন চলাচল বন্ধের ঘোষণা দেয়া হলেও আমাদের কাছে আনুষ্ঠানিক কোন চিঠি আসেনি। তাই ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান বন্ধ থাকলেও ট্যাঙ্কলরি চালানোর কথা জানিয়েছেন পরিবহন নেতারা। বাংলাদেশ ট্যাঙ্কলরি মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় নেতা নুরুল ইসলাম জনকণ্ঠকে জানান, গাড়ি বন্ধ রাখার বিষয়ে আমরা সরকারের পক্ষ থেকে কোন চিঠি পাইনি। তাছাড়া বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোন নির্দেশনা নেই। তাই ঈদের সময় ট্যাঙ্কলরি চলাচলের কথা জানান তিনি। রাস্তায় ভোগান্তি সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ জনকণ্ঠকে বলেন, রোজার ঈদের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা এবারও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে ঘরে ফেরা মানুষের দুর্ভোগ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলাম। বাস্তবে তাই হয়েছে। চন্দ্রা এলাকায় একটি বাইলেন উদ্বোধন হলেও যানজট হ্রাস পায়নি। কয়েক দিন যাবত যানজটের কারণে ঘরমুখো মানুষের দুর্ভোগ চরমে উঠেছে। রাস্তা সরু ও পণ্যসহ পশুবাহী পরিবহনের চাপ বেশি থাকায় যানজটের কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, যানজট নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়বে। তিনি জানান, ঢাকা-ময়মনসিংহের যাত্রীরাও যানজটের দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। এছাড়া অন্যান্য মহাসড়কে এখনও যানজটের খবর পাওয়া যায়নি। যানজট এড়াতে নষ্ট ও দুর্ঘটনা কবলিত গাড়ি দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে সরিয়ে নেয়া ও হাইওয়ে পুলিশের তৎপরতা বৃদ্ধির দাবি জানান তিনি। আজ থেকে মহাসড়কে ট্যাঙ্কলরি চলাচল বন্ধ ॥ প্রতিবছরের মতো এবারের ঈদে যানজট এড়াতে আজ মঙ্গলবার থেকে ঈদের পরের তিন দিন পর্যন্ত মহাসড়কে ট্যাঙ্কলরি ও ট্রাক চলাচল বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সোমবার রাজধানীর গাবতলী বাস টার্মিনাল পরিদর্শনে এসে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা জানান। তবে পশুবাহী ট্রাক, গার্মেন্টস পণ্য, পচনশীল পণ্য ও ওষুধবাহী ট্রাক এ নির্দেশনার আওতামুক্ত থাকবে বলে জানান তিনি। মন্ত্রী বলেন, টানা ভারি বর্ষণের কারণে মহাসড়ক বার বার ঠিক করা হলেও আবার নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে দুর্ভোগ কিছুটা হতে পারে। সেজন্য যানজট নিয়ন্ত্রণে মানুষের দুর্ভোগ এড়াতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। তবে শতভাগ যানজটমুক্ত করতে পারব কিনা, এটা বলা কঠিন। বাসচালকদের ওভারটেকিং না করার আহ্বান জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আপনারা (চালকরা) সাবধানে গাড়ি চালাবেন। গতবারের মতো এবারও যেন লাশের পাহাড় দেখতে না হয়। যে কোন সময় সব স্থান থেকে যেন বাসগুলো সিএনজি নিতে পারে, সেজন্য সোমবার থেকে ঈদের পঞ্চম দিন পর্যন্ত সারাদেশে রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা সিএনজি স্টেশন খোলা থাকবে।’ তিনগুণ ভাড়া আদায়ের অভিযোগ ॥ ঈদযাত্রায় যাত্রীদের কাছ থেকে পরিবহন সঙ্কটের দোহাই দিয়ে বাস ও লঞ্চে দ্বিগুণ-তিনগুণ বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। সোমবার সংগঠনের চেয়ারম্যান শরীফ রফিকউজ্জামান ও মহাসচিব মোঃ মোজাম্মেল হক চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক যৌথ বিবৃতিতে এ অভিযোগ করে বলা হয়Ñ অখ্যাত, অপরিচিত লোকাল পরিবহনগুলো গণপরিবহন সঙ্কটকে কাজে লাগিয়ে দূরপাল্লার রোডে সার্ভিস পরিচালনায় এ ধরনের গলাকাটা ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য ও অস্বাভাবিক ভাড়া নৈরাজ্য চালাচ্ছে। গণপরিবহন সঙ্কটের কারণে যাত্রীসাধারণ বাধ্য হয়ে এসব ফিটনেসবিহীন ও লক্কড়ঝক্কড় এসব বাস ও লঞ্চে দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করতে বাধ্য হচ্ছেন বলে বিবৃতিতে দাবি করা হয়। অনতিবিলম্বে এসব ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য বিআরটিএ, বিআইডব্লিউটিএ, সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের হস্তক্ষেপ কামনা করে বলা হয়Ñ এসব প্রতিষ্ঠান উদাসীন হলে বিগত ঈদ-উল-ফিতরের মতো এবারও দুর্ঘটনায় শত শত যাত্রীর প্রাণহানি ঘটতে পারে। সদরঘাট থেকে ছেড়ে যাওয়া প্রতিটি লঞ্চের লোড লাইনের দোহাই দিয়ে ধারণক্ষমতার ৩-৪ গুণ অতিরিক্ত যাত্রী তোলা হচ্ছে। ভয়াবহ জীবন ঝুঁকি নিয়ে যাত্রীরা এসব লঞ্চে যাতায়াত করছে বলে অভিযোগ করে আরও বলা হয়Ñ মাওয়া-কাওড়াকান্দি নৌরুটে চলাচলকারী স্পিডবোটগুলোতে বেপরোয়া-ভাবে অতিরিক্ত যাত্রী বহন করা হচ্ছে। পর্যাপ্ত বয়া ও জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম ছাড়া এসব নৌযান পরিচালনা করা হচ্ছে বলে সংগঠনের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়। এছাড়াও ঈদ বোনাসের দোহাই দিয়ে সদরঘাট, ফতুল্লাঘাটসহ সারাদেশের বিআইডব্লিউটিএ, জেলা পরিষদ পরিচালিত ঘাটগুলোতে যাত্রী পারাপারে মাত্র .৫০ পয়সার পরিবর্তে ৫-১০ টাকা হারে ইজারা আদায় করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়। কমলাপুরে যাত্রী ভোগান্তি ॥ কমলাপুর রেলস্টেশনে যাত্রীদের ভিড় লেগেই আছে। যেসব যাত্রী ১৫ সেপ্টেম্বর ট্রেনের অগ্রিম টিকেট কিনেছিলেন তারা রবিবার ভোর থেকেই নাড়ির টানে বাড়ির পথে যাত্রা শুরু করেছেন। আর যারা ১৬ সেপ্টেম্বর টিকেট কিনেছেন তাদের যাত্রা শুরু হয় সোমবার। ট্রেনে যানজটের সমস্যা না থাকলেও শিডিউল বিড়ম্বনা কম-বেশি রয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ে স্টেশনে ট্রেন না আসার অভিযোগ রয়েছে। এতে ঘরমুখো হাজারও যাত্রী পড়েছেন অসহনীয় দুর্ভোগে। গত দুই দিনে বেশ কয়েকটি ট্রেন ২০ মিনিট থেকে আড়াই ঘণ্টা বিলম্বে ছেড়ে গেছে। মহাসড়কের সার্বিক অবস্থা জানতে চাইলে মহাখালী আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম জনকণ্ঠকে বলেন, রাস্তা সরু হওয়া, যেখানে সেখানে যাত্রী ওঠানো, পণ্য-যাত্রী ও পশুবাহী পরিবহনের বাড়তি চাপ, সড়ক দুর্ঘটনাসহ নানা কারণে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে যানজট হচ্ছে। তিনি বলেন, যানজটের কারণে ঢাকা-টাঙ্গাইল আড়াই ঘণ্টার রাস্তা যেতে সময় লাগছে ৬-৭ ঘণ্টা। টানা বর্ষণের কারণে রাস্তা খারাপ হওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, রাস্তা ভেঙ্গে যাওয়ায় কোথাও কোথাও ধীরগতিতে যানবাহন চলছে। চন্দ্রা-আশুলিয়া-মৌচাক-কোনাবাড়ি-এলেঙ্গা এই পাঁচ পয়েন্টে যানজট বেশি হওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, উত্তরবঙ্গের সকল জেলার যাত্রীরা চরম দুর্ভোগ মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। বৃষ্টিতে রাস্তা খারাপ হওয়ায় ভোগান্তি আরও বেড়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট মহাসড়কের অবস্থা সন্তোষজনক জানিয়ে কালাম জানান, ফেরি ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ভাল হলে মাওয়া ও আরিচা ফেরিঘাটে যানজটের ভোগান্তি হবে না। তবে সময় যত যাবে রাস্তায় তত বাড়বে গাড়ির চাপ। এ জন্য ঘাট সংশ্লিষ্টদের ব্যাপক প্রস্তুতি রাখারও পরামর্শ দেন। মহাখালী থেকে জয়দেবপুর চৌরাস্তা যেতে চার ঘণ্টা সময় লাগছে এ কথা জানিয়ে তিনি বলেন, রাস্তায় হাটবাজার, বাড়তি পরিবহনের চাপ, ভোগড়া বাইপাস সিগন্যাল দীর্ঘ হওয়াসহ নানা কারণে বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও সিলেট রুটের যাত্রীদের ভোগান্তি বেড়েছে। তবে জয়দেবপুর চৌরাস্তার পর ময়মনসিংহ পর্যন্ত যানজটমুক্ত থাকার কথা জানান তিনি। স্বাভাবিক যাতায়াতের নিশ্চয়তা চায় জাতীয় কমিটি ॥ নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির উপদেষ্টা প্রবীণ রাজনীতিবিদ মনজুরুল আহসান খান বলেছেন, সাধারণ মানুষের নিরাপদ ও আরামদায়ক যাতায়াতের জন্য একটি পরিবেশবান্ধব সমন্বিত গণপরিবহন ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় অপরিহার্য। কারণ গণমানুষের ন্যূনতম নাগরিক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত না হলে গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য থাকে না। কিন্তু ঢাকা শহরের দুঃসহ যানজট, জলজট ও বিশৃঙ্খল পরিবহন ব্যবস্থার নিত্যচিত্র বলে দেয় এখানকার মানুষ তাদের ন্যূনতম নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এক কথায় বলা যায়, রাজধানীবাসীর নিরাপদ ও স্বাভাবিক যাতায়াত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সরকার ব্যর্থ। সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি সংলগ্ন তারেক মাসুদ-মিশুক মুনীর দুর্ঘটনা স্মৃতিচত্বরে সিটিজেনস রাইটস মুভমেন্ট এবং নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটিসহ (এনসিপিএসআরআর) ছয়টি বেসরকারী সংগঠন আয়োজিত এক মানববন্ধন ও নাগরিক সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় তিনি ঢাকা মহানগরীর দুঃসহ যানজট নিরসনে রাজধানীতে নতুন প্রাইভেটকার আমদানি ও চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবি জানান। বিশিষ্ট পরিবেশবিদ ও পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বলেন, ঢাকাকে পরিবেশসম্মত ও বাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে হলে প্রাইভেটকার নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সড়কের আয়তন ও সরকারী ব্যবস্থাপনায় গণপরিবহনের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। এছাড়া জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল-বিলসহ রাজধানীর সকল প্রাকৃতিক জলাভূমিকে বৈধ-অবৈধ দখলমুক্ত করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে।
×