ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ৩০ জুন ২০২৫, ১৬ আষাঢ় ১৪৩২

হারিয়ে যাচ্ছে একতলা লঞ্চ: নদীপথের নীরব প্রস্থানের গল্প

কামরুজ্জামান বাচ্চু, নিজস্ব সংবাদদাতা, বাউফল, পটুয়াখালী

প্রকাশিত: ১৩:১৬, ৩০ জুন ২০২৫

হারিয়ে যাচ্ছে একতলা লঞ্চ: নদীপথের নীরব প্রস্থানের গল্প

এক সময়ে নদীমাতৃক দক্ষিণাঞ্চলে একতলা লঞ্চ ছিল যাত্রী পরিবহনের অন্যতম নির্ভরযোগ্য মাধ্যম। 

কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিকতা, গতির প্রয়োজনে ও ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতার চাপে এই লঞ্চগুলো আজ বিলুপ্তির পথে।

দেখতে যতই সাধারণ মনে হোক না কেন, একতলা লঞ্চগুলো একসময় এ অঞ্চলের  যোগাযোগ ব্যবস্থার অন্যতম মাধ্যম ছিল। 

সহজ গঠন, স্বল্প খরচে রক্ষণাবেক্ষণ, এবং যাত্রীদের সঙ্গে চালকের সরাসরি সংযোগ—এই লঞ্চগুলো যেন ছিল একপ্রকার "মানবিক যান"।

বিশেষ করে বাউফল, দশমিনা, গলাচিপা, কলাপাড়া, ভান্ডারিয়া, রাজাপুর, বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের অজস্র নদীপথে একতলা লঞ্চই ছিল একমাত্র ভরসা। কিন্তু এখন এসব পথে বড় আকারের, আধুনিক নকশার লঞ্চ চলাচল করছে। 

দুই-তিনতলা বিশিষ্ট বিশাল লঞ্চগুলোর জাঁকজমক ও আয়তনের চাপে একতলা লঞ্চ যেন নিঃশব্দে হারিয়ে যাচ্ছে।

পুরোনো যাত্রীদের কাছে এই লঞ্চ মানেই একরাশ স্মৃতি। কাঠের ঘ্রাণ মেশানো ডেকে বসে থাকা যাত্রীরা এখনো মনে করেন সেই নির্ভরতার দিনগুলো। ছিল না অতিরিক্ত ভিড়, না ছিল যন্ত্রচালিত শব্দের কর্কশতা। একতলা লঞ্চ মানেই ছিল নদীর সঙ্গে এক আত্মিক সংযোগ। এখন সেই শান্ত যাত্রা যেন শুধুই কল্পনা।

বড় ও আধুনিক লঞ্চগুলোর তুলনায় একতলা লঞ্চ অনেক সময় নিরাপত্তাহীন মনে করা হতো। আবহাওয়া খারাপ হলে বা ঢেউ বাড়লে এসব লঞ্চ টিকতে পারত না বলেই ধারণা। তবে অনেক লঞ্চচালক ও পুরোনো যাত্রী বলছেন, "শুধু ভালোভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করলেই এসব লঞ্চ চালানো যেত। কিন্তু বিনিয়োগকারীরা লাভ কম দেখে সরে পড়েছেন।"

এক সময় যারা এই লঞ্চ পরিচালনা করতেন, তারা আজ হতাশ। একজন লঞ্চ মালিক জানালেন, “এই লঞ্চটা আমার বাবা চালাতেন। আমিও চালিয়েছি বছর বিশেক। এখন যাত্রী কমে গেছে। সবাই বড় লঞ্চে চড়তে চায়। একতলা লঞ্চ শুধু শখের বস্তু হয়ে গেছে।

সকল উন্নয়নের মাঝেও কিছু ঐতিহ্য ধরে রাখার প্রয়োজন পড়ে। একতলা লঞ্চ শুধু একটি যানবাহন নয়, এটি এই দেশের জলসাংস্কৃতিক ইতিহাসের একটি অংশ। চাইলে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে কিছু লঞ্চকে রক্ষণাবেক্ষণ করে পর্যটন বা ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবেও রাখা সম্ভব।

সময় বদলায়, প্রযুক্তি আসে, যাত্রা দ্রুত হয়—তবুও কিছু জিনিস থেকে যায় হৃদয়ের খুব কাছাকাছি। একতলা লঞ্চ হয়তো আর আগের মতো চলবে না, কিন্তু তার স্মৃতি, আত্মিক যোগাযোগ ও নান্দনিক সরলতা হারিয়ে যাওয়ায় আমাদের নদীপথ ইতিহাসের এক অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। 

মুমু

×