ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

ঈদের আগে 

১২০ টাকায় পুলিশে চাকরি পেয়ে আবেগাপ্লুত ৩৭ তরুণ-তরুণী

বাবুল সরদার, বাগেরহাট

প্রকাশিত: ২২:০৮, ৮ এপ্রিল ২০২৪

১২০ টাকায় পুলিশে চাকরি পেয়ে আবেগাপ্লুত ৩৭ তরুণ-তরুণী

নিয়োগপ্রাপ্ত তরুণ-তরুণী

বাগেরহাটের বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের কু-বিষ্ণুপুর গ্রামের ৭১ বছর বয়সী বীর মুক্তিযোদ্ধা আঃ ছালাম মোল্লা। শীর্ণকায় পড়ন্ত শরীর নিয়ে এখনও তিনি কৃষিকাজ করেন। মুক্তিযোদ্ধার সন্মানী আর সামান্য জমির ওপর পরিবারের জীবিকা চলে। পরিবার বলতে ৪ জন। এরমধ্যে মেয়ে নূরজাহান আক্তার সুমা (২৩) ঢাকাতে বেসরকারী কলেজে নার্সিং পড়ে। আর ছাব্বির মোল্লা (১৯) পড়ে চিরুলিয়া বিষ্ণুপুর স্কুল এন্ড কলেজে মানবিক ২য় বর্ষে। এই ছাব্বিরের চাকরী হয়েছে বাংলাদেশ পুলিশে। 

বীর মুক্তিযোদ্ধা ছালাম মোল্লার সাথে সোমবার দেখা হয় এ প্রতিবেদকের। আপনার ছেলের চাকরি হয়েছে পুলিশে- প্রশ্ন করতে তিনি বলেন- হ্যাঁ। কিভাবে চাকরি হল, কে তদবীর করেছিল, কত টাকা লেগেছে ... এমন প্রশ্ন করতে তিনি বলেন, আমি খুব গরিব মানুষ, ঠিকমত খেতে পারি না, ছেলে-মেয়ে দুটোর পড়ার খরচ চালাতে পারি না, টাকা কোথায় পাব, কে আমাদের তদবির করবে, আল্লাহ্পাক তদবীর করেছে, আমার বিশ্বাস ছিল.. বলেই তনি কাঁদতে শুরু করেন। সে কান্না যেন থামেই না। এ কান্না আনন্দের, প্রাপ্তির। প্রাপ্তি যখন প্রত্যাশাকে ছাপিয়ে যায়, তখন বোধকরি এমন হয়। 

বিনা তদবিরে, বিনে টাকায় তাঁর ছেলের চাকরি হওয়ায় তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আইজিপি এবং বাগেরহাটের পুলিশ সুপার-সহ বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এ সময় তিনি দু’হাত তুলে মোনাজাত করতে থাকেন। বাবার সাথে সাথে সদ্য চাকরি হওয়া ছেলে ছাব্বির এবং তার মা জাহানারা বেগমও মোনাজাতে শরীক হন।  

এইচএসসি পাশ না করতেই সরকারী চাকরি হয়ে গেল বলতে ছাব্বিরের মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল। এক পর্যায়ে বলল, আমাদের সংসারে বাবাই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। আমাদের দুই ভাই-বোনের পড়ার খরচ আর সংসার চালাতে আব্বুর ভিষণ কষ্ট হচ্ছিল। বয়সের ভারে তিনি নিজেও অসুস্থ। তাই আমার চাকরির খুব দরকার ছিল। তার ভাষায়,‘ এ খুশি প্রকাশ করা যায় না। আল্লাহ্ অশেষ মেহেরবান। আমি প্রধানমন্ত্রী, আইজিপি স্যার বাগেরহাটের এসপি স্যার সবার কাছে অশেষ কৃতজ্ঞ।’

উপকূলীয় বাগেরহাটের সুন্দরবনসংলগ্ন শরণখোলা উপজেলার প্রত্যন্ত আমড়াগাছিয়া গ্রামের হতদরিদ্র দিনমজুর সিদ্দিকুর রহমান ও রুখছানা বেগম দম্পতির ছেলে জুয়েল রহমানের অনুরূপ চাকরি হয়েছে। মাটির ঘরের ছোট বসত বাড়ি ছাড়া একতিল জমি নেই। ৪ ছেলে-মেয়েসহ ৭ জনের সংসার চলে প্রায় ৬৯ বছর বয়সী দিনমজুর সিদ্দিকুর রহমানের আয়ে। সিদ্দিকুর রহমানের পিতা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বিনা তদবীর ও বিনা টাকায় ছেলের পুলিশে চাকরী হওয়ায় তিনি যেন বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। শুধু বলছেন, আমি দোয়া করি, আমি দোয়া করি ..।’

শরণখোলা ডিগ্রী কলেজের রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের ১ বর্ষের ছাত্র সদ্য পুলিশে চাকরি হওয়া জুয়েল জনকণ্ঠকে বলেন, বসতবাড়ি ছাড়া আমাদের কোন জমি নেই। হতদরিদ্র বলতে যা বোঝায়, আমরা তাই। আব্বু-আম্মু আমাদের মানুষ করতে (লেখাপড়া) খুব কষ্ট করেছেন। আমি শহীদ পরিবারের সন্তান। আমার দাদা (পিতার পিতা) স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ হন। আমার বাবা আর কষ্ট করতে পারছিলেন না। আমার চাকরির খুব প্রয়োজন ছিল। তাই লেখাপড়া শেষ না করতেই পুলিশে আবেদন করেছিলাম। আল্লাহর অশেষ রহমতে কোন প্রকার তদবির ছাড়াই আমার চাকরি হয়েছে। আমি প্রধানমন্ত্রী, আইজিপি স্যার ও বাগেরহাটের পুলিশ সুপার স্যার এবং এ নিয়োগে যাঁরা যুক্ত ছিলেন, তাঁদের সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। ..’ 

মোড়েলগঞ্জের কুরুপেরদাইড় গ্রামের দরিদ্র কৃষক বীরেন্দ্রনাথ বাছাড়ের মেয়ে জ্যোতি বাছাড় এর অনুরূপ পুলিশে চাকরি হয়েছে। জ্যোতির মা শিপ্রা বাছাড় বলেন, আমাদের ভিশন কষ্টের সংসার। কখনও ভাবিনি ঘুষ বা’ তদবির ছাড়া আমার মেয়ের চাকরী হবে। ভগবানের অসীম কৃপায় মাত্র ১২০ টাকায় সেই চাকরি হয়েছে। এখন আমি মরেও শান্তি পাব।’’ তিনিও প্রধানমন্ত্রী, আইজিপি এবং বাগেরহাটের পুলিশ সুপারের প্রতি বার বার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে থাকেন। আর চাকরি হওয়া জ্যোতি বাছাড় বলেন, এভাবে চাকুরী হবে বুঝতে পারিনি। আমার পরিবারের কোন সক্ষমতা নেই, যে চাকুরীর জন্য টাকা দেবো। তার উপরে এমন কেউ পরিচিতও নেই, যে আমার জন্য সুপারিশ করতে পারে। সাহস নিয়ে আবেদন করেছিলাম। চাকুরী হয়েছে। এখন দেশের সেবা করতে চাই।’

এভাবেই বাগেরহাটে ঘুষ, সুপারিশ, হয়রানি ছাড়াই পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকরি পেয়েছেন ৩৭ তরুণ-তরুণী। ঈদের ২ দিন আগে এভাবে চাকরি পাওয়ায় এদের সবাই মহাখুশী। আবেগ আপ্লুত প্র্রত্যেক অভিভাবক। টাকা-পয়সা ছাড়া যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকুরী হওয়ায় সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ জানান তারা।

নিয়োগ প্রদানের নানা প্রক্রিয়া ও ধাপ সম্পন্ন করার পর রবিবার সন্ধ্যার দিকে বাগেরহাট জেলা পুলিশ লাইন্সের ড্রিল শেডে পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকুরীপ্রাপ্তদের নাম ঘোষনা করেন নিয়োগ কমিটির সভাপতি ও পুলিশ সুপার আবুল হাসনাত খান (পিপিএম)। নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে নিজেদের নাম শুনে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন ভবিষ্যত পুলিশ কনস্টেবল ও তাদের অভিভাবকরা। এরপরেই নিয়োগপ্রাপ্তদের ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো হয়।

নিয়োগপ্রাপ্তদের বেশিরভাগ হতদরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হওয়ায় ঘুরে দাঁড়ানোর নতুন স্বপ্ন তাদের চোখে-মুখে। নিজ যোগ্যতায় চাকরী হওয়ায় দেশ সেবায় এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যাশা তাদের। অনলাইনে আবেদনের মাধ্যমে মাত্র ১২০টাকায় চাকরী পাওয়ায় প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানান অভিভাবকরা।

বাগেরহাটের পুলিশ সুপার আবুল হাসনাত খান (পিপিএম) জনকণ্ঠকে বলেন, ‘চাকুরী নয়, সেবা’ এই শ্লোগানে আমরা স্বচ্ছতার সাথে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছি। কোনো অসাধুপায় অবলম্বনের সুযোগ দেওয়া হয়নি কাউকে। কোনো সুপারিশ বা চাপ ছিল না। মেধাবী এবং শারীরিক যোগ্যতা সম্পন্ন তরুণ-তরুণীদের আমরা চাকরি দিয়েছি। আশা করি, নতুন নিয়োগপ্রাপ্তরা পুলিশ বিভাগ ও দেশের সম্মান বৃদ্ধি করবেন।’ 

এস

×