ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

আজও স্বীকৃতি মেলেনি জব্বার নগরের

শেখ আব্দুল আওয়াল, গফরগাঁও

প্রকাশিত: ২২:২০, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

আজও স্বীকৃতি মেলেনি জব্বার নগরের

ভাষা শহীদ আব্দুল জব্বার স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগার 

১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে শহীদ ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলা পাঁচুয়া (জব্বার নগর) ১৪ বছরেও মেলেনি জব্বার নগরের স্বীকৃতি। রাখা হয় না কোনো দৈনিক পত্রিকা, ভাষা শহীদ আবদুল জব্বার গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরটি সারাবছরই থাকে দর্শকশূন্য। নতুন প্রজন্মের কাছে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা বাংলা ভাষার চেতনা ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশে নির্মিত হয় ‘ভাষাশহীদ আব্দুল জব্বার গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর’। এলজিইডির তত্ত্বাবধানে ৬২ লাখ ৯০ হাজার টাকা ব্যয়ে এটি নির্মিত হয়। 
মহান ভাষা আন্দোলনের শহীদের স্মৃতি রক্ষায় ২০০৮ সালে ১৯ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় উপদেষ্টা আনোয়ারুল ইকবাল এবং ভাষা সৈনিক আবদুল মতিন, ভাষা সৈনিক বেগম রওশন আরা ও ভাষা সৈনিক ডা. হালিমা খাতুন গফরগাঁওয়ের পাঁচুয়া গ্রামে ভাষা শহীদ আবদুল জব্বারের বাড়ির আঙ্গিনায় উদ্বোধন করেন। জব্বারের নামে গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর। উদ্বোধনের সময় পাঁচুয়া গ্রামটি জব্বার নগর হিসেবে ঘোষণা করেন। কিন্তু ঘোষণার এক যুগের বেশি পার হলেও স্বীকৃতি মেলেনি জব্বার নগরের। 
রাওনা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান সাহাবুল আলম বলেন, ‘নাম পরিবর্তনের বিষয়ে আমরা এখনো কোনো গেজেট পাইনি। গফরগাঁও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে শহীদ আবদুল জব্বার গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরটি যেন আরও পরিপূর্ণতা পায় সেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং দর্শনার্থী বাড়ানোর জন্য বিভিন্নভাবে প্রচার চালানো হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, জব্বার নগরের স্বীকৃতির বিষয়টি যত দ্রুত সম্ভব ওপর মহলে লিখিত আকারে পাঠানো হবে।

ভাষা সৈনিক হওয়া অনেক গর্বের ॥ আব্দুল কাদের
নিজস্ব সংবাদদাতা, লালমনিরহাট থেকে জানান, লালমনিরহাটের ১২ ভাষা  সৈনিকের মধ্যে আব্দুল কাদের অন্যতম। আবদুল কাদের ১৯৫২ সালে লালমনিরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র থাকাবস্থায় ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫২ সালে লালমনিরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ে ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এ পরিষদের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।

২৩ ফেব্রুয়ারি হরতালের সমর্থনে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন করে বাড়িতে চলে যাওয়ায় পাকিস্তানবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত হন ভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্যরা। তার নেতৃত্বে ২৩ ফেব্রুয়ারি হরতাল সমর্থনে লালমনিরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। খবর পেয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার অভিযান চালায়।

ছাত্রনেতারা বিদ্যালয়ের জানালা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টাকালে পুলিশ তাদের ধরে এনে থানায় আটকে রাখে। কিন্তু তারা তখন থানা হাজত থেকেই রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই স্লোগান দেওয়া শুরু করেন, একপর্যায়ে পুলিশ তাদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন সংগ্রামে সারাদেশের মতো সক্রিয় ভূমিকায় ছিল লালমনিরহাটের ছাত্রসমাজ ও রাজনৈতিক নেতারা। তারা ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে মাতৃভাষার দাবিতে আন্দোলন করেছেন।

জেলায় জীবিত ও প্রয়াত নারী-পুরুষ মিলে ১২ জন ভাষাসৈনিক ছিলেন, আশরাফ আলী, ড. শাফিয়া খাতুন, মনিরুজ্জামান, আবদুল কুদ্দুস, কমরেড শামসুল হক, মহেন্দ্র নাথ রায়, আবিদ আলী, জরিনা বেগম, জাহানারা বেগম (দুলু), সিরাজুল ইসলাম ও জহিরউদ্দিনসহ ১১ জন প্রয়াত হয়েছেন। তাদের মধ্যে আবদুল কাদের বেঁচে আছেন।

বয়সের ভারে ভাষাসৈনিক আবদুল কাদেরের শরীরের অবস্থা ভালো নেই। খুব একটা ভাল যাচ্ছে না তার দিন, নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে সদর উপজেলার মহেন্দ্রনগর ইউনিয়নের হাঁড়িভাঙা (হলদিটারি) গ্রামে বসবাস করছেন। আবদুল কাদের জানান, মাতৃভাষার জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করেছি, ভাষা সৈনিক হওয়াটা ছিল কৃতিত্বের, অনেক গর্বের।

লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ উল্যাহ জানান, তাদের আন্দোলনের জন্য আজ আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি, লালমনিরহাট জেলা প্রশাসন প্রতিবছর ভাষা সৈনিকদের স্মরণে বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকে, এ বছর মিলাদ মাহফিল, আলোচনা সভা, সম্মাননা স্মারকসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।

অবহেলায় পড়ে আছে শহীদ মিনার
নিজস্ব সংবাদদাতা, গোবিন্দগঞ্জ, গাইবান্ধা থেকে জানান, অযত্ন অবহেলা আর তদারকির অভাবে পবিত্রতা হারাচ্ছে গোবিন্দগঞ্জের প্রধান দুটি শহীদ মিনার। নিয়ন্ত্রণহীন থাকার সুুযোগে শহীদ মিনার চত্বর দুটি ময়লা আবর্জনা, লেপ-তোশক তৈরির কারখানা আর অটোরিক্সা স্ট্যান্ডে পরিণত হয়েছে। চরম অবহেলায় বর্তমানে এক রকম লোকচক্ষুর আড়ালে যেতে বসেছে গোবিন্দগঞ্জ পৌরশহরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও শিল্প এলাকা কোচাশহরের শহীদ মিনার দুটি।

এর মধ্যে গোবিন্দগঞ্জ পৌরশহরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বেদিতে সারাবছর নির্বিঘেœ লেপ তোশক আর বালিশ তৈরি করায় পরিণত হয়েছে এসবের কারখানায়। এ ছাড়াও শহীদ মিনারের সামনে চা, বিস্কুট ও সবজির দোকান দেওয়ায় ঢাকা পড়েছে শহীদ মিনার। গোবিন্দগঞ্জ পৌর কর্র্তৃপক্ষ শহীদ মিনারের গেটে তালা দিয়ে এর পবিত্রতা রক্ষা করার চেষ্টা করলেও তা আর নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি।

অন্যদিকে শীতাতাপ পোশাকের জন্য বিখ্যাত শিল্পাঞ্চল কোচাশহরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারটি সারাবছরই দখল হয়ে থাকে অটোরিক্সার স্ট্যান্ড হিসেবে। গোবিন্দগঞ্জ নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক এম এ মোতিন মোল্লা বলেন, শহীদ মিনারের বেহাল অবস্থা বিরাজ করলেও তা দেখার কেউ নেই। গোবিন্দগঞ্জ পৌর মেয়র মুকিতুর রহমান রাফি বলেন, শহীদ মিনারের পবিত্রতা রক্ষার জন্য নানা পদক্ষেপ নিয়েছিলাম। কিন্তু পরে বেশকিছু কারণে তা ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। তারপরেও পবিত্রতা রক্ষায় পৌরসভার আন্তরিকতার ঘাটতি নেই।

বরিশালে ৩১১ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নেই শহীদ মিনার
স্টাফ রিপোর্টার, বরিশাল থেকে জানান, ভাষা আন্দোলন ৭২ বছরে পা রাখলেও শতবর্ষীসহ অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেই শহীদ মিনার। ফলে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা ভাষা শহীদদের স্মরণ করতে পারে না। এমনকি অনেক বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে তাদের প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে ছুটি ভোগ করেন।

আর এ কারণেই মহান ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মৃতির প্রতি দেশের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের শ্রদ্ধা নিবেদন ও ভাষা সৈনিকদের অবদান সম্পর্কে জানার আগ্রহ সৃষ্টি হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন কবি ও সাহিত্যিক শিকদার রেজাউল করিম। তথ্যের সত্যতা স্বীকার করে জেলা শিক্ষা অফিসার জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, আমি এখানে আসার পর অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করে সফল হয়েছি। পর্যায়ক্রমে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হবে।

রাজবাড়ীতে ৫৭৪ 
নিজস্ব সংবাদদাতা রাজবাড়ী থেকে জানান, সরকারি ও বেসরকারি প্রাথমিক মাধ্যমিক মাদ্রাসা ও কলেজ পর্যায়ের মোট ৭৬৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৫৭৪ শহীদ মিনার নেই। শহীদ মিনার না থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ভাষা শহীদদের যথাযথ শ্রদ্ধা জানানো সম্ভব হয় না। আশ্বাস দিয়েছেন রাজবাড়ী জেলা প্রশাসক আবু কায়সার খান।

সেনবাগে ৩৬ 
নিজস্ব সংবাদদাতা, সেনবাগ, নোয়াখালী থেকে জানান, সেনবাগ উপজেলার ২১টি মাদ্রাসা, ৫টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ১৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নেই শহীদ মিনার। উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আব্বাস আলী উপজেলার ১১৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১৫টিতে শহীদ মিনার না থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মোস্তাফা হোসেন ২৮ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৫টিতে শহীদ মিনার নেই বলে নিশ্চিত করেন।

×