ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১

রংপুর-৩ আসন

জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে মাঠ কাঁপাচ্ছেন তৃতীয় লিঙ্গের রানী

তাহমিন হক ববী, রংপুর থেকে ফিরে

প্রকাশিত: ২৩:৪৬, ২ জানুয়ারি ২০২৪

জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে মাঠ কাঁপাচ্ছেন তৃতীয় লিঙ্গের রানী

গণসংযোগ করছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী জিএম কাদের ও স্বতন্ত্র প্রার্থী আনোয়ারা ইসলাম রানী

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রংপুর-৩ আসনে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হয়েছেন তৃতীয় লিঙ্গের আনোয়ারা ইসলাম রানী। এই আসনে আওয়ামী লীগের বা স্বতন্ত্র প্রার্থী না থাকলেও মাঠ কাঁপাচ্ছেন তৃতীয় লিঙ্গের স্বতন্ত্র এই রানী। ছয় প্রার্থীর মধ্যে জাতীয় পার্টির জিএম কাদেরের সঙ্গে লড়াই হবে রানীর- এমনটাই মনে করছেন সাধারণ ভোটাররা। ঈগলের মতো দুরন্ত গতিতে রানী প্রচারে এগিয়ে যাচ্ছেন। তবে দলের সমর্থককে নিয়ে এগিয়ে চলেছেন জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদেরও। 
 দ্বাদশ  রংপুর-৩  আসন থেকে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী তুষার কান্তি ম-লকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। ভোটযুদ্ধে লাঙ্গল ও ঈগল ছাড়াও সুপ্রিম পার্টির আব্দুর রহমান রেজু একতারা, বাংলাদেশ কংগ্রেসের একরামুল হক ডাব, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সহিদুল ইসলাম মশাল এবং ন্যাশনাল পিপলস পার্টির শফিউল আলম আম প্রতীকে লড়ছেন। কিন্তু তাদের প্রচার নেই বললেই চলে। 
রংপুর সিটি করপোরেশনের ৯ থেকে ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড ও সদর উপজেলার পাঁচ ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত রংপুর ৩ আসনটি বিগত সময়ের ন্যায় এবারও  জাতীয় পার্টি তাদের ঐতিহ্য ধরে রাখতে চায়। তবে এ নিয়ে সাধারণ ভোটারগণ হিসাব নিকাশ করতে শুরু করেছে। 
একটা সময় ছিল যখন জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীক রংপুরের মানুষের মনে আবেগ সৃষ্টি করত। অবশ্য জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক সামরিক শাসক জেনারেল এইচএম এরশাদ যখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলেন, তখনো জাতীয় পার্টি রংপুরে ততটা জনপ্রিয় ছিলনা। এরশাদের মূল জনপ্রিয়তা দেখা যায় ১৯৯০ সালে  তাকে কারাগারে যেতে হয়। কারাগারে থাকা অবস্থায় এরশাদ ১৯৯১ এবং ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে পাঁচটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পাঁচটিতেই জয়লাভ করেন। অথচ সে দুটি নির্বাচনে তিনি প্রচারে কোনো সুযোগ পাননি। এরপর ২০০১ সালের নির্বাচনেও জাতীয় পার্টি রংপুর জেলার সব আসন থেকে জয়লাভ করে।

১৯৯১, ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালের নির্বাচনে রংপুর জেলার ছয়টি আসনের সবগুলোতে জাতীয় পার্টি জয়লাভ করে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে রংপুর জেলার ছয়টি আসনের মধ্যে তিনটি চলে যায় আওয়ামী লীগের হাতে।যদিও  এরশাদ যতদিন বেচে ছিলেন ততদিন রংপুর অঞ্চলে তার ব্যক্তিগত প্রভাব ছিল। কিন্তু তার মৃত্যুর পর জাতীয় পার্টির সেই প্রভাব অনেকটাই কমেছে।
বিগত সময়ে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে আওয়ামী লীগের আলী উকিল এবং দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মুসলিম লীগের কাজী আব্দুল কাদের এমপি নির্বাচিত হন। জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠার পর ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে শফিকুল গনি স্বপন এবং চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এইচ এম এরশাদ (উপনির্বাচনে মোফাজ্জল হোসেন মাস্টার) নির্বাচিত হন।

পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত এই আসনে এরশাদ এবং তার পরিবারের সদস্যরাই সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে আসছেন। এবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও প্রার্থী হয়েছেন এরশাদের ছোট ভাই এবং জাতীয় পার্টির বর্তমান চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদের।
জাতীয় পার্টির এক সময়ের দুর্গ ছিল বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের ৩৩টি আসন। তবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোটগতভাবে অংশ নিয়ে দলটি দখলে রাখতে পেরেছে মাত্র সাতটি আসন। এরমধ্যে রংপুর-৩ আসন একটি। এখানে সিটি করপোরেশন মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী। অন্য আসনের তুলনায় রংপুর অঞ্চলের মধ্যে কেবল এই আসনে জাতীয় পার্টির শক্ত অবস্থান রয়েছে।
এবারের নির্বাচনে প্রতীক বরাদ্দের পাঁচদিন পরে জিএম কাদের ২৩ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু করেন। জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান প্রয়াত এইচএম এরশাদ এবং মা-বাবার কবরসহ মাওলানা কেরামত আলীর (রহ.) মাজার জিয়ারতের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রচার শুরু করেন তিনি। দুদিন রংপুরে অবস্থানকালে নিজ আসনের বাইরে মিঠাপুকুর ও পীরগঞ্জের প্রার্থীর পক্ষে পথসভা করে ফিরে যান তিনি। সেই থেকে তার পক্ষে গণসংযোগ, লিফলেট বিতরণ ও মিছিল-সমাবেশ করছেন নেতাকর্মীরা।

রংপুর শহরে জাতীয় পার্টি কার্যালয়ের সামনে সীমিত আকারে একটি কর্মিসভা করেছেন। তার তরফ থেকে উল্লেখযোগ্য কোনো জনসংযোগ এলাকাবাসীর চোখে পড়েনি। শহরে অল্পকিছু পোস্টার লাগানো ছাড়া অন্য কোনো প্রচারে আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। এ ছাড়া বাকি পাঁচজন প্রার্থীর মধ্যে আনোয়ারা ইসলাম রানী ছাড়া অন্য প্রার্থীদের জনসংযোগে খুঁজেই পাওয়া যায়নি। শহরে যেসব পোস্টার রয়েছে সেগুলোর মধ্যে জিএম কাদের এবং আনোয়ারা ইসলাম রানীর পোস্টার বেশি। কয়েক প্রার্থীর পক্ষে শহরে অল্প সময়ের জন্য মাইকিং করতে দেখা গেছে। 
আনোয়ারা ইসলাম রানী বলেন, শুধু লাঙ্গল ও আমি মাঠে আছি, আর কোন প্রতিদ্বন্দ্বীকে দেখছি না। বিষয়টি বুঝলাম না। তৃতীয় লিঙ্গের রানী তার প্রচারে মাঠ-ঘাট চষে বেড়াচ্ছেন। ঈগলের মতোই দুরন্ত গতিতে ছুটছেন ভোটারদের দ্বারে দ্বারে। রানী বলেন, গত বছরের ২ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী রংপুরে জনসভা করেছেন। আমি আমার এলাকার তৃতীয় লিঙ্গের সকলকে নিয়ে তাকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানিয়েছিলাম। আমি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দৌড়ে পৌঁছাতে পারিনি।

তাই স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছি। কারণ জাতীয় পার্টি এলাকার কোনো উন্নয়ন করেনি। তারা ভোটের সময় আসে। ফায়দা লুটে ঢাকা চলে যায়। হিজরা রানী বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমি যেখানেই যাচ্ছি, ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। মানুষের একটাই কথা, এবার ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। কেবল রানী আপাকে ভোট দিতেই কেন্দ্রে যাব। মানুষের মাঝে একঘেয়েমি এসেছে। তারা এখন পরিবর্তন চাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, জাতীয় পার্টি ঘুঘুর মতো বারবার এখানে এসে ধান খেয়ে চলে গেছে। তারা রংপুরের মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। এবার মানুষ আর সে সুযোগ দেবে না।
মানিক মিয়া নামের এক ভোটার বলেন, রানী রংপুরের উন্নয়নে যেসব কথা তুলে ধরছেন তা যুক্তিসঙ্গত। দিনরাত তিনি ছুটছেন ভোটারদের দ্বারে দ্বারে। তার জনপ্রিয়তা অনেকগুণ বেড়েছে। 
তবে রংপুর জাতীয় পার্টির ঘাঁটি, এখানে বিকল্প কোনো চিন্তা করে লাভ নেই বলে জানিয়েছেন সদর উপজেলার মোমিনপুর ইউনিয়নের ভোটার এমদাদ হোসেন। তিনি বলেন, মানুষ এখনো লাঙ্গল এবং এরশাদকে ভুলে যায়নি। বরাবরের মতো এবারও লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী এ আসনে জয়ী হবেন।

অপর দিকে প্রচারে জিএম কাদের সরাসরি না থাকলেও কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে না দাবি করে জাপার কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান ও রংপুর মহানগরের সাধারণ স¤পাদক এবং নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক এসএম ইয়াসির  বলেন, রংপুরের মানুষের জন্যই আমরা, জাতীয় পার্টি। যেখানেই যাচ্ছি ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। রংপুর জাতীয় পার্টির দুর্গ। বরাবরের মতো এবারও লাঙ্গলে ভোট দিয়ে মানুষ পাশে থাকবেন বলে বিশ্বাস করি। 
এদিকে জাপা চেয়ারম্যান সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে রংপুর নগরীর কোর্ট চত্বরে গণসংযোগকালে সাংবাদিকদের বলেন ২৬টি আসনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করলেও দেশের প্রায় সব আসনেই প্রার্থী দিয়েছিল সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। তবে সমঝোতার আসনগুলোর বাইরে বেশিরভাগ জায়গাতেই তেমন আলোচনায় নেই জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা।

ভোটের মাত্র এক সপ্তাহ আগে একদিনে দেশের পাঁচটি আসনে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা। এর মধ্যে দুজন প্রার্থী দুটি করে আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন।
জিএম কাদের বলেন, অনেক সময় অনেক প্রার্থী নির্বাচনের শেষ পর্যন্ত থাকেন না, কেউ আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে প্রকাশ করেন, আবার কেউ ঘোষণা করেন না। কেউ এমনিতেই বসে যান। পার্টির প্রার্থীদের মধ্যে আমার একটা নির্দেশ আছে, যারা নির্বাচন করতে চান, করতে পারেন। নির্বাচন করতে না চাইলে সেটিও সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা রয়েছে।

×